বঙ্গনিউজ : শিক্ষায় মহামারীর ক্ষত সারানো যখন বড় চিন্তা, তখন এমন সিদ্ধান্ত আসায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন শিক্ষক ও গবেষকরা।আগামী বছর থেকে নতুন শিক্ষাক্রমে সপ্তাহে দুই দিন ছুটি রাখার পরিকল্পনা থাকলেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের কারণে তার আগেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শুরু হচ্ছে এর বাস্তবায়ন।
বিদ্যুৎ বাঁচাতে এখন থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুক্রবারের পাশাপাশি শনিবারও ছুটি থাকবে। সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়।
এর আগে ২০২৩ সাল থেকে প্রাথমিক থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই দিন করে সাপ্তাহিক ছুটি থাকবে বলে গত ফেব্রুয়ারিতে জানিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।
করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে গত দুই বছরে শিক্ষার ঘাটতি সারানো যখন বড় চিন্তা, তখন এমন সিদ্ধান্ত আসায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন শিক্ষক ও গবেষকরা। তবে ‘মানসম্মত শিক্ষা’ নিশ্চিতে দুই দিন ছুটি রাখার পক্ষেই মত দিচ্ছেন অনেকে।
অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলছেন, ‘কোয়ানটিটি এডুকেশনের’ চেয়ে এখন ‘কোয়ালিটি এডুকেশন’ নিশ্চিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষকরা দুই দিনের ছুটিতে প্রস্তুতির সময় পেলে মানসম্পন্ন শিক্ষা দিতে পারবেন বলে আশা তার।
“ক্লাসে শুধু পড়ালেই হবে না, সেখানে কোয়ালিটি এডুকেশন দেওয়া হচ্ছে কি না সেটাই মুখ্য বিষয়।”
নতুন সূচিতে সমন্বয় করার বিষয়ে তিনি বলেন, “স্কুলে কোয়ালিটি টাইম নিশ্চিত করতে হবে। স্কুলে বাচ্চারা যে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা থাকে, সেই সময়টার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে।
“ছয় দিন স্কুল না হলে যে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে তা কিন্তু না। পাঁচ দিনেই সে ছয় দিনের কাজ করবে। আর শুধু স্কুলেই তো বাচ্চারা সব শিখবে না। তাদের পরিবার থেকেও শেখাতে হবে।
এজন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া ও শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করার তাগিদ দিয়েছেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। করোনাভাইরাসের ঘাটতি কাটাতে শিক্ষার্থীদের কনটেন্ট বানিয়ে দেওয়ার পরামর্শ তার।
সরকারের নির্দেশনা আসার আগে থেকেই যেসব প্রতিষ্ঠান সপ্তাহে দুই দিন ছুটি দিয়ে আসছে, তার একটি হল ঢাকার রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ।
এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র ভাইস প্রিন্সিপ্যাল আসমা বেগম জানান, ওই দুই দিনের জন্য শিশুদের বাড়ির কাজ দিয়ে দেওয়া হয়।
“আমরা দুই দিন ছুটি দিই, এতে তেমন সমস্যা হয় না। আর শিক্ষকদের জন্যও তো সময় প্রয়োজন। এতে সপ্তাহের অন্য পাঁচদিন তারা শিক্ষার্থীদের আরও ভালোভাবে শেখানোর সুযোগ পাবেন। গুণগত শিক্ষা দিতে পারবেন।”
এই শিক্ষকের মতে, ছুটিতে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার পাশাপাশি গান, নাচ, আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কনের মত পাঠক্রমের বাইরের বিষয়গুলোতে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। তাই নতুন নির্দেশনাকে ‘যুক্তিসঙ্গত’ বলছেন তিনি।
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিলেও সবসময়ই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি দুইদিন থাকা উচিত বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মো. তারিক আহসান।
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “পৃথিবীর অন্যান্য দেশে দুই দিন করে ছুটি। এমনকি দুপুরে লাঞ্চের পরে এক ঘণ্টা ব্রেক থাকে সিস্টেমটা ‘মোর ব্রেইন ফ্রেন্ডলি’ করার জন্য।
“আমরা ধরেই নিয়েছি, সবকিছুই ক্লাসরুমে লার্নিং হবে। এই কনসেপ্ট থেকে বের হয়ে আসতে হবে।”
তার ভাষায়, পড়ালেখার গুণগত মান নিশ্চিত করতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবারই শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা চাই, সেজন্যও দুই দিন ছুটি প্রয়োজন।
“শিক্ষকরা ছয় দিন ক্লাস করে যদি নিজেদের ব্যক্তিগত কাজের সুযোগ না পান, কাজের ভারে ওভারলোডেড থাকেন, তাহলে তারা কোয়ালিটি টাইম দিতে পারবে না। তখন ক্লাসরুমের শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
তারিক আহসান বলেন, “সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত সবকিছুই লার্নিং। যদি আমরা পরিকল্পনামাফিক তাদের শেখানোর ব্যবস্থা করি, দুই দিন ছুটি দিয়েও যদি বাড়িতে কাজ দিয়ে দিই, তাহলে সে সেগুলো করতে পারবে।”
নতুন শিক্ষাক্রমে এ বিষয়গুলো আছে জানিয়ে অধ্যাপক তারকি বলেন, “নতুন কারিকুলামে লার্নিংকে শুধু ক্লাসে অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়নি, ক্লাসের বাইরের কার্যক্রমেও সেটা রয়েছে।”
মহামারীর কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে দেশে দেড় বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এই ক্ষতি পোষাতে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়ার দাবি ছিল সব মহলেই। শিক্ষামন্ত্রীও বাড়তি ক্লাস নিয়ে শিখন ঘাটতি কমানোর আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন।
তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি বাড়ানোর আলোচনার মধ্যে গত ১২ অগাস্ট দীপু মনি বলেন, তাদের গবেষণায় কোভিডের ছুটিতে শিখন ঘাটতির চিত্র পাওয়া যায়নি, বরং শিক্ষার্থীদের ‘স্ব শিখনের দক্ষতা’ তৈরি হয়েছে।
এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেন, “মহামারীতে শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এরপর বাড়তি ছুটিতে যাওয়া ঠিক হয়নি।
এই সিদ্ধান্ত না নিয়ে অন্যভাবে জ্বালানি সাশ্রয় করা যেত মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমাদের দেশেই প্রাইভেট কারে চড়ে বাচ্চারা স্কুলে আসে। পৃথিবীর কোনো দেশে এটা নাই। আমেরিকায় প্রেসিডেন্টের বাচ্চারা পর্যন্ত স্কুল বাসে করে স্কুলে যায়।”
জ্বালানি সাশ্রয়ে অন্য কোনো ‘উদ্ভাবনী পন্থা’ বের করা যেত বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য।
“প্রথমে সরকারি গাড়ি কমাতে হবে। একজন বড় আমলার তিনটা করে গাড়ি থাকে। একটা তার নিজের, একটা স্ত্রীর, একটা ছেলে-মেয়ের। এগুলো বন্ধ করতে হবে।”
ঢাকার গভার্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ ভূঁইয়াও মনে করছেন, মহামারীতে শিক্ষায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুরোপুরি পূরণ করা সম্ভব নয়। তা কাটিয়ে উঠতে ‘যতটুকু সম্ভব’ চেষ্টা করছেন তারা।
তবে দুই দিন ছুটি থাকায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা লাভবান হবে মত দিয়ে তিনি বলেন, “আগে বৃহস্পতিবার হাফ ডে ছিল, এখন ফুল ডে করব। কিন্তু ওইদিন তিন পিরিয়ড করতে শিক্ষার্থীদের কষ্ট করে আসতে হত, অভিভাবকরাও আসতেন।
“এখন একদিন কম আসতে হবে। এতে জ্বালানি খরচের পাশাপাশি সময়ও বাঁচবে শিক্ষার্থীদের।”
সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির এই সভাপতি জানান, দুইদিন ছুটি রাখা শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল।
“সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের অনেক সময় দিতে হয়। এখন তারা যদি একটা দিন বেশি ছুটি পান, নিজেরা প্রিপারেশন নেওয়ার সুযোগ পাবেন। আরও স্বতঃস্ফূর্তভাবে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতে পারবেন। এতে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হতে পারবে।”
ছুটি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আসার পর শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিও আশা করছেন, দুইদিন ছুটি পেলে শিক্ষকরা অনেক বেশি এনার্জি নিয়ে কাজ করতে পারবেন।
বাংলাদেশ সময়: ১১:৩০:০২ ২৯০ বার পঠিত #কলেজ #বাংলাদেশ #বিশ্ববিদ্যালয় #শিক্ষা প্রতিষ্ঠান #স্কুল