বঙ্গ-নিউজ: শ্যামা সংগীত ও কাজী নজরুল ইসলাম-৫
এ সম্পর্কিত আর একজন আলোচক বিস্তারিত লিখেছিলেন। তাঁর সে লেখাটিও পাঠকগণের কৌতুহল প্রশমিত করার জন্য এখানে তুলে ধরছি। লেখকের পরিচিতও নিচে দেওয়া হলো।
বরদাচরণের জীবনের একটি বিশিষ্ট দিক তুলে না ধরলে ছবিটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সেই দিকটি হল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে তাঁর একাত্মতা। কাজী নজরুল বরদা বাবুর কাছে ছিলেন বড় আদরের ‘কাজী ভায়া’। বরদাচরনের আধ্যাত্ম জীবনের নন্দন কাননে কাজী নজরুল ছিলেন পারিজাত বৃক্ষ।
নজরুল ইসলামের সাথে বরদাচরণ মজুমদারের প্রথম সাক্ষাৎ হয় নিমতিতার জমিদার বাড়ির এক বিয়ের আসরে। নিমতিতার জমিদার রায় জ্ঞানেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী বাহাদুরের কন্যার বিয়ে হয় এলাহাবাদের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট, কলকাতা নিবাসী যতীশ চন্দ্র রায়ের পুত্রের সাথে। কাজী নজরুল ইসলাম সেই বিয়েতে বরযাত্রী দলের সাথে এসছিলেন।১১
ঐ বিবাহ সভাতে বরদাবাবু এসেছিলেন লালগোলা থেকে কন্যা পক্ষের আমন্ত্রণে। এই সাক্ষাতের কথা কবি নজরুল স্বয়ং , বরদাবাবুর ‘ পথ হারার পথ’ বইটির ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, “ নিমতিতা গ্রামের এক বিবাহ সভায় সকলেই বর দেখিতেছে, আর আমার ক্ষুধাতুর আঁখি দেখিতেছে আমার প্রলয় সুন্দর সারথীকে। সেই বিবাহ সভায় আমার বধুরূপিনী আত্মা তাঁহার চিরজীবনের সাথীকে বরণ করিল। অন্তঃপুরে মুহুমুহু শঙ্খধ্বনি, হুলুধ্বনি হইতেছে- স্রক-চন্দনের শুচি সুরভি ভাসিয়া আসিতেছে। নহবতে সানাই বাজিতেছে। এমনি শুভক্ষণে আনন্দ বাসরে আমার সে ধ্যানের দেবতাকে পাইলাম। তিনি এই গ্রন্থ গীতার উদ্গাতা শ্রী শ্রী বরদাচরণ মজুমদার মহাশয়।” ১২
এর পর ১৯৩০ সালে ৮ই মে ( বৈশাখ ১৩৩৭) দুরারোগ্য বসন্ত রোগে মারা যান কবির দ্বিতীয় পুত্র ‘ অরিন্দম খালিদ’ যাঁর ডাকনাম ‘ বুলবুল’। এই শিশু মাত্র চার বৎসর বয়সেই সঠিক গানের সুর তুলে নিতে পারতেন কন্ঠে। ঐ শিশু অবস্থাতে তাঁর প্রতিভার স্ফুরণ দেখে সকলেই অবাক হয়ে যেতেন। তাঁর অকাল মৃত্যুতে নজরুলকে শোকস্তব্ধ ও পাগল করে তুলে ছিল। এরপরেই তিনি আধ্যাত্মিক ভাবনায় তাড়িত হন। এবং বুবুলকে একবার চোখের দেখার জন্য শরণাপন্ন হন বরদাচরণ মজুমদার মহাশয়ের। নজরুলের ভাষায় “ আমার কাননের বুলবুলি উড়ে গেছে । যে দেশে গেছ তুমি সে কি বুলবুলিস্তান ইরাণের চেয়েও সুন্দর? কোথায় সে? কোন পথে গেলে তাঁর দেখা পাওয়া যায়? আমাকে সে পথের সন্ধান দেবে কে?”১৩
শোক সন্তপ্ত পিতা বরদাচরণের কাছে তাঁর সমস্ত ঘটনা বললেন। জানতে চাইলেন কিসে স্বান্তনা আসে কিসে শান্তি পাওয়া যায়। বহু বুঝিয়ে বরদাবাবু সাময়িকভাবে কবিকে শান্ত করলেন। কিন্তু সারা জীবনের নিত্য সঙ্গী স্নেহ,মায়া , মমতার শক্ত বাঁধন ছেঁড়া তো সহজসাধ্য নয়। তাই কবি অতি বিনীতভাবে বললেন- “ ছেলেটিকে একবার দেখবার অদম্য ইচ্ছা কিছুতেই দমন করতে পারছিনা। কিন্তু বিগত আত্মা কি আর স্থূল দেহে ফিরে আসতে পারে?”
পিতৃ হৃদয়ের আকুল আকুতি মানব প্রেমিক বরদাবাবুর মনে রেখাপাত করেছিল। তিনি অত্যন্ত স্নেহপূর্ণ স্বরে বললেন , “ ছেলেকে দেখার খুব ইছে হচ্ছে? বেশ, তুমি দেখতে পাবে। কিন্তু দেখো, কোনো কথা তুমি তাকে বলনা।” কবি সম্মত হয়ে ঘরে ফিরে গেলেন।
একটা মাসও পার হলনা , হঠাৎ একদিন সকালে কবি লালগোলায় এসে লুটিয়ে পড়লেন যোগীবর বরদাচরনের পায়ে। বললেন-“ আপনার কৃপায় ছেলের দেখা আমি পেয়েছি। আমার মন এখন শান্ত হয়েছে।” ছেলেটির দেখা পাওয়ার বিষয়ে তিনি বললেন- একদিন কবি তাঁর উপাসনা কক্ষে বসে গুরুদত্ত বীজমন্ত্র জপ করে চলেছেন; একটি কচি পায়ের শব্দে তাঁর একাগ্রতা ভেঙ্গে গেল। চোখ মেলে দেখলেন তাঁর আদরের বুলবুল ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে তার পোশাক পরিচ্ছদ খেলনায় ভরা আলমারিটি খুলে সব নেড়ে চেড়ে দেখল।আলমারিটি বন্ধ করল। তারপর স্তম্ভিত, শোকাহত পিতার মুখের পানে চেয়ে একটা মৃদু পরিচিত হাসি উপহার দিয়ে বুল্বুল্ সে ঘর থেকে উড়ে গেল। ১৪
লালগোলায় বরদা বাবুর বাড়িতে নজরুল ইসলাম বহুবার এসেছেন,এ বিষয়ে আমার পিতামহের নীকট বন্ধু ও লালগোলার প্রবীণ তম ব্যক্তি শ্রী রবীন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয়ের একটি আলোচনার উল্লেখ করেছেন ছবিলাল পাল তাঁর প্রবন্ধে –“ ডঃ সান্যাল একদিন গল্পচ্ছলে বলেন- আমরা তখন স্কুল ছাত্র, শুনলাম হেডস্যারের বাড়িতে কাজী নজরুল এসেছেন। আমরা কয়েকজন বন্ধু হৈ হৈ করে ছুটলাম স্যারের বাড়ি। দেখলাম স্যারের পায়ের কাছে কাজী সাহেব বসে আছেন, আমরা গান শুনতে চাইলে তিনি আমাদের বললেন, এখন দাদা অসুস্থ আর তোমরা গান শুনতে এসেছ? বকাবকি করলেন আমাদের। আমরা ছেলের দল ক্ষুণ্ণ মনে ফিরে এলাম সেখান থেকে। পড়ে ঐ দিন বিকেলে আমরা কলকলি পাড়ে ঘুরতে বেড়িয়েছি, দেখি কাজী সাহেব কালীবাড়ি বটতলার নীচে একা বসে আছেন। আমাদের তিনি হাতছানি দিয়ে ডেকে বসালেন এবং তিনটি গান স্বেচ্ছায় গেয়ে শোনালেন। আমাদের কে কে গান গায় জানতে চেয়ে তিনি নিশিথ রায়ের ( লালগোলা এম.এন.একাডেমীর প্রাক্তন শিক্ষক শ্রী সুখেন্দু রায়ের পিতা) কন্ঠে কয়েকটি গান শুনে তাঁর তারিফ করেন”১৫
বিদ্রোহী কবি ও যোগীবরের সম্পর্কে লিখতে গেলে একটি আলাদা গ্রন্থ হয়ে যেতে পারে তাই বেশি আলোচনায় এবার আর গেলাম না , অন্য সময় সুযোগ পেলে এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনায় যাব। শ্রদ্ধেয় নলীনী কান্ত সরকার , দিলীপ কুমার রায়, বারীন ঘোষ সকলেই লালগোলা এসেছেন বরদাবাবুর সাথে সাক্ষাৎ করতে। নেতাজীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয় কলকাতায়। নেতাজী পরপর দুই দিন এসে তাঁর সাথে দেখা করেন কলকাতা ভবানীপুরে ডাঃ অমিয়মাধব মল্লিকের মোহিনী মোহন রোডের বাসভবনে।১৬
এঁরা প্রত্যেকেই কাজী নজরুল ইসলামের সুহৃদ। কবির সাথে যোগীবর বরদাচরণ মজুমদারের শেষ দেখা হয় বরদাবাবুর মৃত্যুর আগের দিন।সে সম্পর্কে আলোচনা করে এই বিষয়ের ইতি টানব।
( চলবে )
বাংলাদেশ সময়: ২০:৩৭:১১ ৪৩৪ বার পঠিত #প্রাসঙ্গিক কথা #সাতটি দিন #সীমান্ত ভ্রমণ