বঙ্গ-নিউজ: লেটো গান ও কাজী নজরুল ইসলাম-২
বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী নজরুল ১৯৩৪ সালে চলচ্চিত্রের সংগে যুক্ত হন। প্রথমে যে ছায়াছবিতে কাজ করেন তা ছিল গিরীশ ঘোষের কাহিনী ”ভক্ত ধ্রুব” । ছবিটির পরিচালনা, সংগীত রচনা, সূর সংযোজনা ও পরিচালনা এবং নারদের ভূমিকায় অভিনয় ও নারদের চারটি গানের প্লেব্যাক তিনি নিজেই করেন। ছবির আঠারোটি গানের মধ্যে সতেরটির রচয়িতা ও সুরকারের দায়িত্ব ছিল নজরুলের। এ ছাড়া তাঁর সংশ্লিষ্ট অন্যান্য চলচ্চিত্র গুলো হলো পাতালপুরী (১৯৩৫) গ্রহের ফের (১৯৩৭) বিদ্যাপতি বাংলা ও হিন্দী (১৯৩৮) গোরা (১৯৩৮), নন্দিনী ( ১৯৪৫) । এর মধ্যে ব্যবহৃত তাঁর গানের সংখ্যা প্রায় ৫০ টি। এ ছাড়া তাঁর রচিত দুটি নাটক আলেয়া ও মধুমালা সহ প্রায় ২০ টি মঞ্চ নাটকের সংগে যুক্ত ছিলেন। এই সবের জন্য প্রায় ১৮২ টি নজরুল সংগীত অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক হলো রক্তকমল, মহুয়া, জাহাঙ্গীর, কারাগার, সাবিত্রী, আলেয়া,সর্বহারা, সতী, সিরাজ উদদৌলা, দেবী দুর্গা , মধূমালা, অন্নপূর্ণা,নন্দিনী, হরপার্বতী,অর্জুন বিজয়, ব্ল্যাক আউট ইত্যাদি।
নজরুলের গানের শ্রেণীবিন্যাস:
সকল নজরুল সংগীত দশটি ভাগে বিভাজ্য। তবে এর উল্লেখ যোগ্য গুলো হলো- ভক্তিমূলক গান, প্রণয় গীতি, প্রকৃতি বন্ধনা, দেশাত্মবোধক গান, ব্যঙ্গাত্মক গান, সমবেত সংগীত, রণ সংগীত, এবং বিদেশী সুরাশ্রিত গান। নজরুল সংগীতের বিষয়বস্তু ও সুরগত বৈচিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে নজরুল বিশেষজ্ঞ আব্দুল-আজিজ-আল-আমান লিখেছেন- গানগুলি এক গোত্রের নয়। বিভিন্ন শ্রেনীর। তিনি একাধারে রচনা করেছেন গজল গান, কাব্য সংগীত বা প্রেমগীতি, ঋতু-সংগীত, খেয়াল, রাগ প্রধান, হাসির গান, কোরাস গান, দেশাত্মবোধক গান, গণসংগীত, শ্রমিক-কৃষকের গান, কোরাস গান, ধীবরের গান, ছাদ পেটার গান, তরুণ বা ছাত্র দলের গান, মার্চ-সংগীত বা কুচকাওয়াজ গান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গান, নারী জাগরণের গান, শ্যামা সংগীত, কীর্তন, বৈষ্ণব পদাবলী, অন্যান্য ভক্তিগীতি, ইসলামী সংগীত, শিশু সংগীত,নৃত্য সংগীত, লোক গীতি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া,সম্পানের গান, ঝুমুর গান, সাঁওতালি গান, লাউনি, কাজরী, বাউল, মুর্শেদী, এবং আরও নানা বর্ণের গান। বিদেশী গানের সংখ্যাও কম নয়। এ ছাড়া লুপ্ত প্রায় বা লুপ্ত রাগ-রাগিনীকে অবলম্বন করে “ হারামণি” পর্যায়ের গান এবং নতুন সৃষ্ট রাগ-রাগিনীর উপর ভিত্তি করে লেখা “নবরাগ” পর্যায়ের গানগুলি নজরুলের সংগীত প্রতিভার অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় বহন করে।
নজরুল সংগীত সংকলন সম্পর্কে উইকিপিডিয়া শ্রেনীবিন্যাস করেছে নিম্ন লিখিতভাবে- :-
১) গানের মালা সংগীত সংগ্রহ:- ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ,২৩ অক্টোবর। গানের সংখ্যা ৯৫টি ।
২) গীতি শতদল:- ডি এম লাইব্রেরী কর্তৃক প্রকাশিত ১০৪ পৃষ্ঠার এই সংখ্যাটির মূল্য ছিল দেড় টাকা। গানের সংখ্যা ছিল-১০১ টি।
৩) বুলবুল:- ডি এম লাইব্রেরী প্রকাশিত এই সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ১৫ নভেম্বর,১৯২৮ সাল। সুরশিল্পী দিলীপ কুমার রায়কে উৎসর্গীকৃত প্রথম সংখ্যাটি ও সাধারণ সংস্করণ সংখ্যাটির মূল্য ছিল যথাক্রমে এক টাকা ও পাঁচ সিকা। গান সংখ্যা ছিল ৪৯ টি।
৪) বুলবুল ( ২য় খন্ড ) প্রকাশ করেন প্রমীলা নজরুল । পরিবেশক ছিলেন ডি এম লাইব্রেরী। মূল্য ছিল আড়াই টাকা। গানের সংখ্যা ছিল ১০১ টি।
৫) গুল বাগিচা:-গ্রেট ইস্টার্ণ লাইব্রেরী কর্তৃক প্রকাশিত হয়। সময়-২৭ জুন,১৯৩৩। মুল্য –এক টাকা। বন্ধু জিতেন্দ্র নাথ ঘোষকে বইটি উৎসর্গ করেন। গানের সংখ্যা ৮৮ টি।
৬ ) চন্দ্র বিন্দু;-ডি এম লাইব্রেরী কর্তৃক ১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম প্রকাশিত হয়। ৬২ টি গান সম্বলিত এই সংখ্যাটির উৎসর্গে কবি লিখেন, “ পরম শ্রদ্ধেয় শ্রী মদা ঠাকুর শ্রী যুক্ত শরৎ চন্দ্র পন্ডিত মহাশয়ের শ্রীচরন কমলে।”
৭ ) চোখের চাতক;- গজল গানের এই বইটি প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে। মূল্য ছিল এক টাকা। রাজ সংস্করণের মূল্য ছিল পাঁচ সিকা। প্রতিভা সোম পরবর্তীতে প্রতিভা বসুকে বইটি উৎসর্গ করা হয়। গানের সংখ্যা ছিল ৫৩ টি।
৮) মহুয়ার গান:- ডি এম লাইব্রেরী কর্তৃক প্রকাশিত এই সংখ্যার গানের সংখ্যা ছিল ১৫ টি, মূল্য ছিল – দুই আনা। প্রকাশ কাল ১ জানুয়ারি, ১৯৩০ ।
৯ ) রাঙা জবা:- ১০০ টি শ্যামা সংগীত নিয়ে ১ বৈশাখ ১৩৭৩ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়। প্রকাশক ছিলেন ২৪ পরগনার রাজীব পুরের বেগম মরিয়ম আজিজ।
১০) সুর মুকুর:- প্রকাশ কাল ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে প্রকাশিত এই সংকলনে স্বরলিপির সংখ্যা ২৭ টি।
১১) সুরসাকী:- এটির প্রথম প্রকাশ কাল ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে। কালিকৃষ্ণ চক্রবর্তী কর্তৃক প্রকাশিত এই সংখ্যাটির মূল্য ছিল দেড় টাকা এবং গানের সংখ্যা ৯৯ টি।
১২) নজরুল গীতিকা:- প্রথম প্রকাশকাল ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে। বইটিতে জাতীয় সংগীত, ঠুংরী, হাসির গান,গজল , ধ্রুপদ,কীর্তন,বাউল ,ভাটিয়ালি, টপ্পা, এবং খেয়াল সহ মোট গানের সংখ্যা ১২৭টি।
১৩) সন্ধ্যা:- দু ‘একটি গান সহ এটি একটি কবিতা গ্রন্থ। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত বইটিতে ২৪ টি কবিতা ও গান রয়েছে।
১৪) বনগীতি:- প্রকাশকাল ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ। গানের সংখ্যা ৭১টি এবং বইটি কবি উৎসর্গ করেন ভারতের অন্যতম সংগীত কলাবিদ জমীরুদ্দিন খানকে।
১৫) জুলফিকার:- ২৪টি গান নিয়ে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে এটি প্রকাশিত হয়।
নজরুল ইসলামের মোট গানের সংখ্যা কত তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। বাংলাপিডিয়া নজরুলের গানের সংখ্যা দ্বিসহস্রাধিক বলে উল্লেখ করেছে। উইকিপিডিয়াতে সেই সংখ্যার উল্লেখ রয়েছে ৫৬০০ বেশি গানের। আবার নজরুল সংগীতজ্ঞ শিল্পী, কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সংগীত বিভাগের প্রধান ড. রশিদুন নবী এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন যে, “কালজয়ী সঙ্গীতস্রষ্টা নজরুল ইসলাম সৃষ্টিসুখের উল্লাসে মেতে রচনা করেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার গান- যা বাংলা গানের ভুবনে আজও বিরল ও বিষ্ময়কর ঘটনা হিসেবে বিবেচিত।” কিন্তু জনাব নবী নজরুল ইন্সটিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত “ নজরুল সঙ্গীত সংগ্রহ” বইটি সম্পাদনা করতে গিয়ে বলেছেন নজরুলের গানের সংখ্যা প্রায় চার হাজারেরও অধিক। এখনও হয়তো প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারিত হয়নি। আশা করা যায় যে, নজরুলের গান নিয়ে গবেষণায় রত নজরুল ইন্সটিটিউট হয়তো প্রকৃত সংখ্যাটি বের করা সহ আরো অজানা তথ্য প্রকাশে সক্ষম হবেন। তবে নজরুলের গান সম্পর্কে ড. রশিদুন নবী এক চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন প্রায় আড়াইশ গান নজরুলের নামে প্রচারিত হয়ে আসছে যা আদৌ নজরুলের গান নয়। অন্যদিকে অন্যান্য গীতিকারের নামে প্রচলিত অনেক গানও রয়েছে যা আসলে কাজী নজরুলের গান। নজরুলের নামে প্রচলিত অন্যান্য গীতিকারের কয়েকটি গান নিচে উল্লেখ করছি।
১) আকাশের আর্শিতে ভাই-অখিল নিয়োগী
২) আজি নিঝুম রাতে কে বাঁশি বাজায়- তুলসী লাহিড়ী
৩) আমি জানি প্রিয়- অন্য গীতিকার
৪) আমি বন ফুল গো- প্রণব রায়
৫) আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই-রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর
৬) এ ঘোর বরিষায়-সুরেন চক্রবর্তী
৭) একদা তুমি প্রিয়ে-রবীন্দ্র নাথ
৮) এমনি বরষা ছিল সেদিন-প্রণব রায়
৯) এলো নন্দের নন্দন- ধীরেন মুখোপাধ্যায়
১০) ও আমার দেশের মাটি- প্রণব রায়
১১) চোখ মুছিলে জল মোছে না-ধীরেন মুখোপাধ্যায়
১২) কাহারই তরে কেন ডাকে-তুলসী লাহিড়ী
১৩)বাঁশরিয়া বাজাও বাজাও-গিরীন চক্রবর্তী
১৪) মেঘে আর বিজুরিতে মিশায়ে- প্রণব রায়
১৫)সবার দেবতা তুমি আমার প্রিয়-প্রণব রায়
বিখ্যাত নজরুল গবেষক অশোক কুমার মিত্রের “নজরুল প্রতিভা পরিচিতি “ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নজরুল যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন তাঁকে দেখতে যেসব লোকজন আসতেন ,সেই ঘনিষ্ঠ জনদের কেহ কেহ নজরুল সাহিত্য চুরি করেন। এই সব লোকদের কতিপয় ব্যক্তি নজরুল সাহিত্য কবিতা ও গানকে নিজ নামে চালিয়ে দেন। তিনি অবশ্য নামও উল্লেখ করেছেন। তাছাড়াও কবিতা গান ইত্যাদির প্রতি নজরুল খুব যত্নবান না থাকায়ও তাঁর সাহিত্য ও রচনা কালক্রমে অন্যের নামে বাজারে চলে যায়।
( চলবে)
বাংলাদেশ সময়: ২০:২৭:৫৬ ৪১৫ বার পঠিত #প্রাসঙ্গিক কথা #সাতটি দিন #সীমান্ত ভ্রমণ