সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ২৯ ; স্বপন চক্রবর্তী

Home Page » সাহিত্য » সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ২৯ ; স্বপন চক্রবর্তী
শুক্রবার, ৮ জুলাই ২০২২



স্বপন কুমার চক্রবর্তী

বঙ্গ-নিউজ: লেটো গান ও কাজী নজরুল।

প্রসঙ্গক্রমে ”লেটো” গানের কথাও একটু উল্লেখ করা প্রয়োজন হয়েছে। বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান, ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিকে চর্চার ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল হলো লেটো গান। বাংলার বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া অন্যতম আর একটি গান এই লেটো গান। এই গানটিও উত্তরাঞ্চলের কোন গান নয়। ভাটি অঞ্চল বা দক্ষিণাঞ্চলেরও নয়। এটি পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান অঞ্চলের এক সময়ের জনপ্রিয় একটি গান। এই গানেও ঘাটু গানের মতো রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়- বিরহ , বিচ্ছেদ বিরাগ ইত্যাদি নিয়ে গাওয়া হতো। এটিও একটি লোক গান। ঘাটু গানের সাথে বিস্তর কোন ফারাক নেই এই লেটো গানের। এটিও ষোড়শ শতাব্দির একটি পালা গান। পালাধর্মী গান হিসাবে লেটো দল তৈরী হতে একাধিক কন্ঠশিল্পী ও বাজনদার প্রয়োজন হয়। দলটি পরিচালনা করেন একজন কবিয়াল। এই প্রধান কবিয়ালকে গোদা কবি নামেও অভিহিত করা হয়। । অন্যান্য অংশ গ্রহনকারীগন বিষয় অনুসারে নানা নামে পরিচিত হন। যেমন-
গোদা কবি:- দলের পরিচালক এবং প্রধান কবি তিনি। অনেক সময় কবি গানের মতো লেটো গানও দুটি দলের মধ্যে প্রতিযোগীতা হয়ে থাকে। গোদা কবিই তখন হয়ে উঠেন দলের প্রাণ। তার নামেই দলের নামকরণ হয়ে থাকে।
বাই ছোকড়া বা রাঢ় :- সাধারণত দলের সুদর্শণ কিশোরগণ মেয়েদের পোশাক পড়ে নারীর ভুমিকায় অংশ গ্রহন করে থাকে। এদের ভিতরে রাজ কন্যা বা রাজ রাণীর ভুমিকায় যারা অভিনয় করে থাকেন তাদেরকে রাণী বলা হয়। অন্য মেয়েদের বলা হয় ছোকড়া বা রাঢ়।
পাঠক:-, রাজা , মন্ত্রী, রাজপুত্র সেনাপতি ইত্যাদি চরিত্রে যে পুরুষগণ অংশ নিয়ে থাকেন তাদেরকে বলা হয় পাঠক।
সংগাল:- নাচ , গান অভিনয়, নৃত্য ইত্যাদির মাধ্যমে যারা শ্রোতাদের হাস্যরসের যোগান দেন ,তারা সংগাল বা সঙ নামে পরিচিত।

ফাইল ছবি-কাজী নজরুল ইসলাম

লেটোর লড়াই:- পালাধর্মী গান হিসেবে লেটোর দলের আবির্ভাব হলেও বিংশ শতাব্দির শুরুর দিকে লেটো গান ”কবিদের লড়াই” গানে পরিচিত হয়। এই সময় আসরে দুইজন কবিয়াল নামতেন নিজ নিজ দলবল নিয়ে। তাঁরা একটি কাহিনী সংক্ষেপে গানে গানে উপস্থাপন করতেন। এর পর তিনি প্রতিপক্ষের কবিয়ালদের প্রতি একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে আসর থেকে নেমে যেতেন বা মঞ্চে বসে থাকতেন। এরপর আসরে দাঁড়ায়ে অন্য কবিয়াল প্রথম কবিয়ালের রেখে যাওয়া প্রশ্নের উত্তর দিতেন। যাবার আগে প্রথম কবিয়ালের প্রতি একটি প্রশ্ন রেখে আসর থেকে নেমে যেতেন। দর্শকগণ কৌতুহল নিয়ে ভাবতেন যে এই কঠিন প্রশ্নের উত্তর বুঝি প্রতিপক্ষের কবি উত্তর দিতে সক্ষম হবেন না। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যেতো যে, প্রতিপক্ষের কবিও খুব চমৎকার ভাবে প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হয়েছেন। এইভাবে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যেমে লেটোর লড়াই চলতো ।
সাধারণত এই সব লড়াইয়ে জেতা কবিয়াল খ্যাতির সূত্রে দূরের গ্রামওে আমন্ত্রণ পেতেন। আর এই সব আমন্ত্রণের সূত্রে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও তাঁর দক্ষতার গুণে লেটু গানের সাথে যুক্ত হয়ে ছিলেন। হয়তো তাঁর দারিদ্র কিছুটা বাধ্য করে ছিল। তবে সঙ্গীতে দক্ষ হওয়াতে যে বেশী প্রাধান্য পেয়েছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নাই। তিনি পালাগান রচনা করতেন। এখান থেকেই শিল্পী জীবনের শুরু এবং উপস্থিত কবিতা ও গান রচনার কৌশল এই লেটো দল থেকেই। কবি নজরুল চলচ্চিত্রে এবং নাটকেও অভিনয় করে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে ছিলেন। তিনি ১৯১০ সালে সংসারের আর্থিক সংকট দূর করার জন্য ১১ বৎসর বয়সে লেটো দলে যোগ দেন। সে সময় লেটো গান ছিল পুরোদমে একটি লড়াইয়ের গান। প্রথম দিকে নজরুল লেটোর জন্য কাহিনী এবং গান রচনা করতেন। পরে লেটো দলে অভিনয় করেছেন। এই লেটো দলে কাজী নজরুল ইসলামের ওস্তাদ ছিলেন কাজী বজলে করীম। তিনি ওস্তাদের সংস্পর্শে এসে গান ও নাচ শিক্ষা লাভ করেন। একই সাথে দলের অন্যান্য বাদ্য যন্ত্রও শিখতে সক্ষম হন। এক সময় তিনি হন ভ্রমর কবি এবং দলের ওস্তাদের পদ লাভ করেন। এই সময়ে তিনি রচনা করেন “ মেঘনাদ বধ” ও পরে রচনা করেন চাষার সঙ, শকুনি বধ, দাতা কর্ণ, রাজপুত্র, কবি কালিদাস, আকবর বাদশা ইত্যাদি। মুলত এই কবিয়াল গানের ওস্তাদ কাজী বজলে করীম ও শেক চাকর ছিলেন নজরুলের গানের আদি গুরু। তাঁদের কাছ থেকেই নজরুল শিখে ছিলেন হারমোনিয়াম বাজানোর কৌশল, গান রচনার কৌশল,এবং সুর ও ছন্দ। শিখে ছিলেন বিস্তারিত হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী। হিন্দু শাস্ত্র ( মাইথলজি) সম্পর্কে প্রভূত জ্ঞান অর্জন সম্ভব হয় সম্ভবত এখান থেকেই। তাঁর রচিত ভক্তিমূলক গানের মধ্যে ইসলামী গানের প্রায় তিন গুণ বেশী গান রচিত হয় হিন্দু ধর্মের ভক্তিমূলক গান। শ্যামা সংগীত ,কীর্তন, মীরা ভজন, ভজন, ইত্যাদি। ইসলামী ভক্তি মূলক গানের সংখ্যা প্রায় তিন শত। আর হিন্দু ধর্মের উপর ভক্তিমূলক গানের সংখ্যা প্রায় ৯০০ শত। ধারণা করা হয় এই লেটোর গানের বিষয় বস্তু তথা হিন্দু ধর্মীয় কাহিনীর চর্চা তাঁকে এই বিষয়ে গান লিখতে বেশি সহায়তা করেছে। তা ছাড়াও হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার অধিকাংশ শ্রোতাদের চাহিদার প্রতি সম্মান দেখানোর কারণে হিন্দু ধর্মীয় গানের দিকেই বেশি মনোযোগী হতে হয়। উপরন্তু রাধা-কৃষ্ণের কাহিনী নির্ভর লেটো গান তথা হিন্দু ধর্মীয় গান তাঁকে বেশি চর্চা করতে হয়। ফলে এই বিষয়ে নিখুঁত ভাবে প্রভূত ধারণা লাভ করতে সক্ষম হন কাজী নজরুল ইসলাম। ব্যবসায়িক দিকটিকেও বিবেচনায় নিতে হয়েছিল। এইচ এম ভি ( হিজ মাস্টার্স  ভয়েস ) কোম্পানীতে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তিনি যে সকল গান করেছিলেন, তা ছিল সবই শ্রোতাদের চাহিদার দিকে নজর রেখে। তিনি ১৯২৮ সালের মার্চ মাসে এইচএমভি কোম্পানীতে যুক্ত হন। এই এইচ এম ভিতে নজরুল সংগীতের প্রথম রেকর্ড করা হয় যে শিল্পীর কন্ঠে তিনি ছিলেন শ্রী হরেন্দ্র নাথ দত্ত। রেকর্ড করা প্রথম গানটি ছিল, “ জাতির নামে বজ্জাতি সব,জাত জালিয়াতি খেলছ জুয়া”। আর প্রথম রেকর্ডকৃত ইসলামী গান ছিল “ ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ”। গানটি গেয়েছিলেন শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমেদ। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। ৮টি গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে কাজি নজরুল ইসলামের রচিত প্রায় দুই হাজার গানের রেকর্ড বের হয়েছিল। কাজী নজরুল ইসলামের রেকর্ড করা প্রথম শ্যামা সংগীত ছিল “ আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়” । শিল্পী ছিলেন মৃণাল কান্তি ঘোষ, আর সময়কাল ছিল ১৯৩২ সালের জুন মাস। নজরুল ছিলেন বাংলা গজল গানের স্রষ্টা। গণসংগীত ও গজলে যৌবনের দুটি বিশিষ্ট দিক সংগ্রাম ও প্রেমের পরিচর্যাই ছিল মুখ্য। নজরুল গজল আঙ্গিক সংযোজনের মাধ্যমে বাংলা গানের প্রচলিত ধারার বৈচিত্র আনয়ন করেন। তাঁর অধিকাংশ গজলের বাণীই উৎকৃষ্ট কবিতা এবং তার সুর রাগ ভিত্তিক। আঙ্গিকের দিক থেকে সে গুলি উর্দু গজলের মতো তালযুক্ত ও তালছাড়া গীত। কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম রেকর্ড করা নাটক ছিল “ ঈদুল ফেতর”। তাঁর জীবনের শেষ রেকর্ডকৃত গান দুটি ছিল ১) চীনও ভারত মিলেছে। ২) সংঘশরণ তীর্থ যাত্রা পথে। গান দুটি গেয়েছিলেন শিল্পী সত্য চৌধুরী ও জগন্ময় মিত্র।
লেটো গানের দলে নজরুল ছিলেন এক মধ্যমণি। সকলের নিকট ছিলেন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি লেটো দল ছেড়ে গেলে দল অনেকটা এতিম হয়ে পড়ে। তাঁর প্রতিভায় সকলেই যে মুগ্ধ হয়েছিল তার প্রমাণ মিলে অন্যদের রচিত গানে-
” আমরা এই অধীন, হয়েছি ওস্তাদ হীন। ভাবি নিশিদিন, বিষাদ মনে। নামেতে নজরুল ইসলাম,কি দিব তার গুণের প্রমাণ “ ইত্যাদি।
(চলবে)

বাংলাদেশ সময়: ২১:০৭:৫৯   ৪২৩ বার পঠিত   #  #  #




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

সাহিত্য’র আরও খবর


সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন: স্বপন চক্রবর্তী
ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা “আমি তো গাঁয়ের মেয়ে ”
৫০ বছরের গৌরব নিয়ে জাবির বাংলা বিভাগ বিশাল ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ উৎসব আয়োজন করেছে
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা- ‘তোমার খোঁজে ‘
অতুলপ্রসাদ সেন: ৩য় (শেষ ) পর্ব-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন;পর্ব ২-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন-স্বপন চক্রবর্তী
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা ” যাবে দাদু ভাই ?”
বাদল দিনে- হাসান মিয়া
ইমাম শিকদারের কবিতা ‘ছোট্ট শিশু’

আর্কাইভ