বঙ্গ-নিউজ: আগেই বলেছি, কুশান গান মুলতঃ রামায়ণের কাহিনি নির্ভর বর্ণনা। রামায়ণের কান্ড বা অধ্যায় সংখ্যা সাতটি। কুশান গানে যে কোন একটি করে পালা নিয়ে কুশান গান গাওয়া হয়। এক এক দিন এক একটি পালা সম্পন্ন হয়। একাধিক দিনেও চলে এই গান। অনেক সময় সপ্তাহ ব্যাপি এই গানের বিভিন্ন পালা মঞ্চস্থিত হয়। যেমন- রাবণের বিলাপ, মেঘনাদ বধ, শক্তি শেলে লক্ষণ,মহীরাবন বধ, লব-কুশ, অশ্বমেধ যজ্ঞ, সেতুবন্ধন, বালিবধ, সীতার বনবাস, কুম্ভকর্ণ বধ, বিভীষণের সপক্ষ ত্যাগ, রাম-রাবণের যুদ্ধ, সীতা দেবীর পাতালে প্রবেশ ইত্যাদি। এই পালাগুলো গিদালের উপস্থাপনার গুণে এমনই আবেগঘণ হয়ে উঠে যে, দর্শক সবাই অশ্রুসিক্ত ও আবেগ প্রবণ হয়ে পড়েন। আবেগাপ্লুত হয় যখন শিল্পী রাবণের বিলাপের মতো বিলাপ করে বলতে থাকে, “ এক লক্ষ পুত্র মোর সোয়া লক্ষ নাতী, রহিল না কেহ আর বংশে দিতে বাতি। কিংবা শক্তি সেলে লক্ষণ নিহত হলে রামের মনের ভাবটি চিন্তা করে বিলাপ দেখাতে গিয়ে শিল্পীর যে ভাবাবেগ প্রকাশ হয়ে থাকে তা সাবাইকে অশ্রুসিক্ত করে তুলে। ক্রন্দনরত ভাবে রামরূপী গিদাল দরদ কন্ঠে গেয়ে ওঠে- “ দেশে গেলে জিজ্ঞাসিবে সুমিত্রা মাতা, তোমরা তো ফিরেছ সবাই, লক্ষণ মোর কোথা “।
কুশান গানের বন্ধনার পরপর গানের মাধ্যমেই রামায়ণের সাতটি কান্ড সম্পর্কে অতি সংক্ষেপে ধারণা দেওয়া হয়। যেমন-
” আদি কান্ডে রামের জন্ম, বিবাহ সীতার
অযোধ্যাতে বনবাস, ত্যাজি রাজ্য ভার।
অরণ্য কান্ডেতে সীতা হরিল রাবণ
কিস্কিন্ধাতে বালি বধ, সুগ্রিব মিলন।
সুন্দরা কান্ডেতে হইলো সাগর বন্ধন
লঙ্কা কান্ডে উভয় পক্ষে বাঁধে মহারণ।
উত্তরা কান্ডেতে হলো কান্ডের বিশেষ
সীতা দেবী করিলেন পাতালে প্রবেশ।
কুশান গানের গিদাল প্রয়োজনে উপস্থিত গান রচনা ও রসসৃষ্টির খোড়াক দিতে পারঙ্গম হয়ে থাকে। এই কুশান পালা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে উপস্থাপিত হয়। গান শুরুর পূর্বে বন্ধনা গাওয়া হয়। চতুর্দিক বন্ধনা, গুরু বন্ধনা, চন্দ্র-সূর্য় বন্ধনা, দর্শক-শ্রোতা বন্ধনা ও সরস্বতীর বন্ধনার মাধ্যমে শুরু করা হয় এই গান। এই গানের কোন স্ক্রিপ্ট নাই। শুধুই গুরুমুখী বিদ্যা। তাই গুরুকেই গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে পালা শুরু হয়। যে কোন সঙ্গীতের বাণী গীতিকারের রচনা হলেও সঙ্গীতের সুর তাল লয় গায়কী ইত্যাদি হয়ে থাকে গুরুমুখী। তাই সার্বিকভাবে সঙ্গীতকে গুরুমূখী বিদ্যা বলা হয়ে থাকে।
গিদাল ও দোয়ারী একই সংগে পরস্পর সংলাপ ও অভিনয়েও অংশ নিয়ে থাকেন। তাঁরা অভিনয় করেন কখনো রাম-রাবণ, কখনো লব-কুশ কখনো গুরু–শিষ্য, আবার কখনো বা সীতা-হনুমান ইত্যাদি চরিত্রে। অন্যান্য দোহার যারা, তারাও প্রয়োজনে অভিনয় করে থাকেন। আবার সংগীতের মাধ্যমেও বর্ণনা দিয়ে থাকেন। এইভাবে বিশেষ এক মাধুর্যে অনুষ্ঠিত হয় কুশান পালা। রামায়ণের মতো তথা মহাকাব্যের মতো কুশান গানেও কাব্যিকভাবে অনেক চরিত্রকে বিভিন্ন নামে ফুটিয়ে তুলা হয়। যেমন-রামকে কখনো বলা হয় রাঘব, কখনো দশরথাত্মজ, দাশরথি, সীতাপতি, বৈদেহীনাথ ,বৈদেহীরঞ্জন, কৌশল্যানন্দন, দেহীমনোরঞ্জন, রঘুকুলমণি, রাঘবেন্দ্র, রঘুবর, রঘুনন্দন, রঘুশ্রেষ্ঠ, সীতানাথ, রবিকুল রবি, রঘুকুলনিধি, রঘুচূড়ামণি, নরবর, রঘুপতি, রঘুনাথ, রঘুবংশ-অবতংশ, সীতাকান্ত, রাঘবচন্দ্র, রঘুকুলরাজা, বৈদেহীবিলাসী, রাঘবেশ্বর, মৈথিলীনাথ, নরপাল, বৈদেহীপতি, রক্ষোরিপু, মৈথিলীবিলাসী, রামভদ্র, মৈথিলীপতি, রক্ষোরিপু,, রঘুজ-অজ-অঙ্গজ-দশরথাত্মজ ইত্যাদি। আবার রাবণেরও তেমনি অনেক নাম ব্যবহৃত হয় যেমন- রাবণ, দশানন, লংকাপতি, রাক্ষসপতি, রাক্ষসরাজ, লংকেশ্বর, ইত্যাদি। মেঘনাথের ও রয়েছে ইন্দ্রজিৎ , রাবনী, মন্দোধরীপুত্র । প্রায় প্রত্যেকটি চরিত্রেরই একাধিক নাম ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
এই কুশান পালা ছাড়াও রামায়ণ নিয়ে অনেক গান অনুষ্ঠিত হয়-যেমন, রামায়ণ গান, রাম মঙ্গল গান রাম যাত্রা ইত্যাদি। রামায়ণ দুই ধরনের রয়েছে । পঞ্চদশ শতাব্দীর বাঙালি কবি কৃত্তিবাস ওঝা কর্তৃক বাংলা ভাষায় অনূদিত রামায়ণ কৃত্তিবাসী রামায়ণ বা শ্রীরাম পাঁচালী নামে পরিচিত। কৃত্তিবাসী রামায়ণ-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এটি পাঁচালীর আকারে পয়ার ছন্দে রচিত এবং মূল সংস্কৃত রামায়ণের আক্ষরিক অনুবাদ নয়। উপরন্তু কৃত্তিবাস রামায়ণ-বহির্ভূত অনেক গল্প এই অনুবাদে গ্রহণ করেছিলেন। তদুপরি, তিনি বাংলার সামাজিক রীতিনীতি ও লৌকিক জীবনের নানা অনুষঙ্গের প্রবেশ ঘটিয়ে তিনি বাল্মীকি-রামায়ণ উপাখ্যানের বঙ্গীকরণ করেন, যা অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত বাল্মিকী রামায়ণ অপেক্ষা ভিন্ন। যেমন রামায়ণের মূল রচয়িতা বাল্মিকী তাঁর রচনায় রামচন্দ্রকৃত দুর্গাপূজার কথা উল্লেখ করেন নি, এমনকি রামায়ণের অন্য কোনো অনুবাদেও তা দেখা যায় না। কিন্তু কৃত্তিবাস ওঝা তার রামায়ণে এটি কোনো তথ্যসূত্র ছাড়াই উল্লেখ করেন। এছাড়াও তিনি রামায়ণের চরিত্রগুলো তৎকালীন সাধারণ বঙ্গীয় সমাজের আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন, যা বাল্মিকী রামায়ণে বর্ণিত একই চরিত্রের সাথে একই রকম নয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, এই কাব্যে “প্রাচীন বাঙালি সমাজই আপনাকে ব্যক্ত করিয়াছে।” বাঙালি সমাজে এই বইটি ব্যাপক জনপ্রিয় এবং বাংলার ঘরে ঘরে পঠিত। কয়েক শতাব্দী ধরে বইটি নানাভাবে পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত হয়েছে। ১৮০২ সালে উইলিয়াম কেরির প্রচেষ্টায় শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে কৃত্তিবাসী রামায়ণ প্রথম পাঁচ খণ্ডে মুদ্রিত হয়। এরপর ১৮৩০-৩৪ সালে জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের সম্পাদনায় দুখণ্ডে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বর্তমানে কৃত্তিবাসী রামায়ণের প্রাপ্ত মোট ২,২২১ টি হস্তলিখিত পুঁথি পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত রয়েছে।
বৈশিষ্ট্য ও অনন্যতা
শাক্ত ও বৈষ্ণব ভাবাদর্শের ছায়াপাত
মূল বাল্মীকি রামায়ণে রাম দেবতা নন — তিনি দেবোপম পুরুষোত্তম, মানুষী শক্তি ও বজ্রকঠোর বীর্যসত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণে রামচন্দ্র সকলের আরাধ্য অবতার, তুলসীচন্দনে লিপ্ত দেববিগ্রহ। তিনি কোমল করের ইঙ্গিতে সৃষ্টি-স্থিতি-সংহার করতে পারেন; বংশীধারী কৃষ্ণের মতই তাঁর চক্ষু প্রেমাশ্রুপূর্ণ। এই কাব্যের পুথিগুলিতে রাম ও রাবণের ভীষণ যুদ্ধস্থলকে গৈরিক-রেণু-রঞ্জিত হরিনাম সংকীর্তনভূমি বলে ভ্রম হয় এবং যুদ্ধের দামামা-রোল মাঝে-মাঝে বৈষ্ণব খোল-করতালের মৃদুতা গ্রহণ করে। এইভাবে সংস্কৃত রামায়ণ পরিবর্তিত হয়ে শাণিত তলোয়ারের চেয়ে বাঙালি ঘরের নয়নাশ্রুর প্রভাবশীল অস্ত্রের উপযোগী হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
বস্তুত, কৃত্তিবাসী রামায়ণে বাংলার শাক্ত ও বৈষ্ণব পরম্পরার দ্বন্দ্ব অনন্যভাবে ফুটে উঠেছে; উভয় লিপিকরদলের পরিমার্জনা কাব্যটিকে বিভিন্ন রসে পুষ্ট করেছে। বৈষ্ণব লিপিকরগণ তরণীসেন, বীরবাহু প্রভৃতি রাক্ষসবীরদের দ্বারা বৈষ্ণবীয় ভক্তিতে রামচন্দ্রের স্তবগান করিয়েছেন; অপরদিকে শাক্ত লিপিকরগণ যুদ্ধজয়ের নিমিত্ত (কমলাক্ষ রামের ‘কমল-আঁখি’র উৎসর্গ দ্বারা দেবী দুর্গা কর্তৃক লুক্কায়িত নীলপদ্মের স্থল পূর্ণ করে) শ্রীরামকে দিয়ে ‘অকাল-বোধন’ চণ্ডীপূজা করিয়েছেন। এভাবে মূল-অনুবাদটি বর্তমান আকারে পরিণত হয়েছে।
প্রতিপক্ষের প্রতি যুদ্ধক্ষেত্রে ভূপতিত হয়ে রাক্ষস বীরবাহুর বিনীত “অকিঞ্চনে দয়া কর রাম রঘুবর” এবং রাক্ষসশ্রেষ্ঠ দশানন রাবণের “অপরাধ মার্জ্জনা করহ দয়াময়” উক্তিতে বাংলার কৌপিনসার শিখাযুক্ত বৈষ্ণবভক্তের রূপ প্রতীয়মান হয়। বিভীষণপুত্র তরণীসেন রামনামের অঙ্গশোভা করে বৈরাগীর সাজে যুদ্ধে গমন করেন এবং বিপক্ষ যোদ্ধা রামচন্দ্রের শরীরে ভগবানের বিশ্বরূপ অবলোকন করেন। সমাগত যুদ্ধার্থীর ভক্তিতে রাম-লক্ষ্মণও শ্রীচৈতন্য-নিত্যানন্দের মতো বৈষ্ণবোচিত বিনয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে অশ্রুপাত করতে থাকেন। মনে করা হয়, রামায়ণের এইসব পরিবর্তন তখনকার বঙ্গীয় সমাজজীবনের প্রকৃতি (বৈষ্ণব-নীতি) অনুসারেই সংঘটিত হয়েছিল।
তবে মূল বাল্মীকি রামায়ণের প্রতিধ্বনিও কাব্যটির বিভিন্ন পুথিতে অল্পবিস্তর শ্রুত হয়, যেমন:
সর্ব্ব সুলক্ষণ যার হয় অধিষ্ঠান।
হিংসার ঈষৎ নাই, চন্দ্র সূর্যের সমান।
ইন্দ্র যম বায়ু বরুণ যেই বলবান।
ত্রিভুবনে নাই কেহ তাহার সমান।
রাম ও লক্ষ্মণের সৌহার্দ্য, কৌশল্যার শোকসন্তাপ, ক্ষাত্রতেজ ও ব্রহ্মচর্যের চেয়ে সীতার গৃহবধূর মত লজ্জাবনত মাধুরী — রামায়ণের কৃত্তিবাসী অনুবাদেই অধিকতর সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, জনসংখ্যার দিকে বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় গ্রন্থ হলো রামায়ণ। তবে সেটা একটু ভিন্ন আঙ্গিকের। অকেটা মাইকেল মধুসূধন দত্তের মেঘনাদ বধ কাব্যের মতো।
রামায়ণ শুধু কাব্য গ্রন্থ নয় , একটি মহাকাব্য। মহাকাব্যের সকল বৈশিষ্ট্যই এর মধ্যে বিদ্যমান আছে। ইন্দোনেশিয়া মুসলিম দেশ হলেও অনেকাংশেই ভারতীয় সংস্কৃতিকে তারা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তাদের বিমানের নাম গারুড় ইন্দোনেশিয়া ( Garuda Indonesia )। এই গরুড় হলো হিন্দু দেবতা ভগবান বিষ্ণুর বাহন। শুধু তাই নয়, অনেক কিছুতেই তাঁরা ভারতের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধারণ করেন। তাদের নাম রাখার ক্ষেত্রেও দেখা যায় সুকর্ণ, সুহার্তো. সুকর্ণপুত্রী, মেঘবতী ইত্যাদি। আবার একটা মিলনায়তন রয়েছে যার নাম কন্যা-জায়া। মুদ্রা এবং নোটের মধ্যে ব্যবহার করা হয় গণেশের ছবি। ২০১৩সালে ইন্দোনেশিয়া আমেরিকাকে একটি সরস্বতী মূর্তী উপহার দিয়েছে, যার উচ্চতা ১৬ ফিট। এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু সরস্বতীর মূর্তী বলে মনে করা হয়। ওয়সিংটন ডিসিতে ইন্দোনেশিয়ার দূতাবাসের কাছেই রয়েছে এই মূর্তীটি। উচ্চতা বেশী হওয়ায় এটা দর্শকদেরকে খুব আকৃষ্ট করে। এই ঘটনা সারা পৃথিবীর কাছে সৌহার্দের প্রতীক হয়ে আছে। সরস্বতীর পায়ের কাছে তিনটি বাচ্চার মূর্তী রয়েছে, মনে হচ্ছে তারা বিদ্যাভ্যাস করছে। একটি পদ্ম ফুলের উপর স্থাপিত এই মূর্তীটি শ্বেত পাথরের তৈরী। মূর্তীটির গায়ে রয়েছে স্বর্ণের অলংকার।
চলবে-
বাংলাদেশ সময়: ২০:৫৩:১২ ৪৬৯ বার পঠিত #প্রাসঙ্গিক কথা #সাতটি দিন #সীমান্ত ভ্রমণ