বঙ্গ-নিউজ: দইখাওয়ার নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন মত থাকলেও সবচেয়ে প্রণিধান যোগ্য হলো খেয়া পারাপার থেকে এই নামের উৎপত্তি । এক সময় দইখাওয়ার প্রায় তিন দিক দিয়ে ছিল জলাশয়। মানুষের আড্ডা দিবার জন্যও আসতে হতো এখানেই। আসতো দৈনন্দিন বাজার বা সাপ্তাহিক হাটের সওদা করতে। ফলে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। জমতো তখন তামাকের খুচরা বা পাইকারী বাজার। প্রচুর কেনাবেচাও হতো। ফলে লোকজনকে আসতে হতো খেয়া পার হয়ে। এই খেয়া চলতো মাত্র দুই বার, মতান্তরে দুই দিক থেকে। এই থেকে ধারণা করা হয় প্রথমে দুই খেয়া ও পরে অপভ্রংশ হয়ে দইখাওয়া হয়ে থাকতে পারে। পরে দইখাওয়ার দু’পার্শ্বে দুটি কালভার্ট তৈরী করা হয়। এখন সব পাকা রাস্তা হয়েছে।
দইখাওয়ায় বিকেলে জমে উঠতো ফুটবল খেলা। এই খেলা দেখতে চামটা ,কেতকীবাড়ি গেন্দুগুড়ি, তোষভান্ডার , হাতীবান্ধা থেকেও প্রচুর দর্শক চলে আসতো। বিভিন্ন অঞ্চলের টীম এসেও অংশ নিতো ফুটবল প্রতিযোগীতায়। দইখাওয়ার টীমও বাইরে খেলতে যেতো। এক সময় একটি প্রতিযোগীতা চলে দীর্ঘ দিন। ”আলী আসগার মিয়া এককালীন দানি শিল্ড” দিয়ে একটি খেলার টুর্ণামেন্ট ঘোষণা করা হয়। নির্ধারিত ফিস দিয়ে খেলায় অংশ গ্রহণ এবং এ ছাড়াও কতিপয় নিয়ম ও অধিকার সংরক্ষন করে এই কমিটি। অনেক কয়টি দল এই খেলায় অংশ নিয়ে ছিল। অসাধারণ প্রতিযোগীতা পূর্ণ হয়ে উঠে এই টুর্ণামেন্ট। খেলা প্রিয় দর্শক দুপুর গড়ালেই এসে ভীড় জমাতো দইখাওয়ায়। দইখাওয়ায় তখন অনেক শক্তিশালী ফুটবল টীম গড়ে উঠেছিল। প্লেয়ারদের মধ্যে সিনিয়র গ্রুপে খেলতেন নগেন্দ্র বর্মণ ( ব্ল্যাক নগেন)। এই ব্ল্যাক নগেন সম্পর্কে পরে আরও লিখার ইচ্ছে আছে। তাকে দেখেছি। কিন্তু তার খেলা দেখার সুযোগ আমার হয়নি। এই গ্রুপে আরও ছিলেন মোঃ আক্কাস আলী,আহমেদ আলী নাজির আহমেদ, ছিলেন মোঃ মুনির হোসেন ছিলেন ঢাঙ্গা আনছার । পরবর্তীতে ছিল উত্তর গোতামারীর সাবু মিয়া, আমজাদ হোসেন, জগৎ বর্মণ, নওদাবাসের পুষ্পজিৎ অধিকারী, ইন্দ্রজিৎ অধিকারী, কাজল অধিকারী, ঝুনু অধিকারী ও মতিলাল অধিকারী। মতিলাল অধিকারী ভালো গোল রক্ষক ছিলেন। গোল রক্ষক হিসাবে ভালো ছিল মনোরঞ্জন বর্মণও। দক্ষিণ গোতামারীর ছিল জগবন্ধু বর্মণ। আমঝুলের ছিল আব্দুল হক ও তার ভাই আবু হোসেন। এক সময় পাটের বড় ব্যবসায়ী বনচুকীর জনাব মলং হাজীর ছেলে মোঃ ওয়াহাব মিয়াও ভালো গোল রক্ষক হিসাবে খেলতেন। একবার একজন প্লেয়ারের প্রচন্ড আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে ওয়াহাব সাহেব চোখের একটু নিচে গালের দিকে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে ছিলেন। সেলাই দিতে হয়েছিল। তাঁর সেই সেলাইয়ের দাগটি আর মুছে যায়নি। বহন করতে হয়েছিল আমৃত্যুকাল। এই আঘাত লাগার কারণটি হলো, তখন কেহই বুট পরিধান করে খেলতো না। বড়জোর লম্বা ফিতা পায়ে জড়িয়ে ব্যান্ডেজ করে নিতো । অধিকাংশ খেলোয়ার খেলতো নগ্নপায়ে। প্রচন্ড আক্রমণের সময় পায়ের লম্বা নখের আঘাতে ওয়াহাব মিয়া জখম হন।
পূর্বে উল্লেখ করেছি, দইখাওয়ার টীম আমন্ত্রিত হয়ে বাইরেও টুর্ণামেন্টে অংশ গ্রহণ করতো। তাদের সেই প্রতিটি খেলার প্রতিযোগীতা ছিল খুব আকর্ষণীয়, অপরাজিত থাকছে প্রায় সময়। এই অবস্থায় দুরে খেলতে গিয়ে ঈর্ষান্বিতদের দ্বারা একবার হাতীবান্ধা সদরে এবং আর একবার কেতকীবাড়িতে প্রচন্ডভাবে মারামারিতে পড়ে দইখাওয়ার অনেকে আহত হয়। তারপর থেকে টীমের অনেকে খেলায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
খেলা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রচুর অনুষ্ঠিত হবার কারণে দইখাওয়াতে কিশোর ও যুব সমাজের লোকদেরকে নেশাগ্রস্থ হতে দেখা যায়নি। এই খেলাধুলা অবশ্যই চিত্ত বিনোদন ও সুস্থ স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য জরুরী। খেলা মনের ও দেহের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। দইখাওয়াতে আরো অনেক খেলা হতো। যেমন দাড়িয়াবান্ধা,হাডুডু বা কাবাটি, ইত্যাদি। ঘরে এবং বাইরে মিলে এমন আরো অনেক জনপ্রিয় কিছু খেলা ছিল- যেমন-কানামাছি, তাস,লুডু,হ্যান্ডবল, লাঠিম, দাবা ইত্যাদি।
ওয়াহাব সাহেবের ভাগিনা মোঃ ফয়জার মিয়া ছিল খুব নাম করা একজন হাডুডু খেলোয়ার। সে অবশ্য ফুটবলেও ভালো খেলোয়ার ছিল। ” টাডিক,টাডিক, টাডিক” এই ধরণের শব্দ করে দম নিয়ে সে অনেকক্ষণ থাকতে পারতো। আর গায়ে প্রচন্ড শক্তি থাকাতে তাকে জড়িয়ে ধরেও কেহ আটকাতে পারতো না। অনেক সময় তাকে ধরে রাখতে সকলে সম্মিলিত ভাবে আক্রমণ করে বসতো। হাডুডু খেলার আর একজন প্লেয়ার ছিল মোঃ ওয়ালী উল্লাহ। এই ওয়ালী উল্লাহর সম্পর্কে পূর্বে উল্লেখ করেছি। খুব দীর্ঘ দেহী এই ওয়ালী উল্লাহ দম দিয়ে যখন প্রতি পক্ষের দিকে আক্রমণ করতেন, তখন দর্শকগণের দৃষ্টি থাকতো ওয়ালী উল্লাহর দীর্ঘ দেহটির দিকে। লুঙ্গি কাছা দিয়ে যখন তিনি এগিয়ে যেতেন তখন মনে হতো আবক্ষ একটি দেহকে দুটি খুঁটির সাহায্যে উপরে তুলে ধরে কে যেন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বিপত্তি দেখা দিতো তাকে যখন প্রতিপক্ষ ধরে ফেলতো। রেফারী তখন ফিতা দিয়ে না মেপেই বিজয়ী ঘোষণা করতো ওয়ালী উল্লাহকে। কারণ তার দেহটি সীমা রেখা চিহ্নিত অংশটির দুই তৃতীয়াংশ দাগ অতিক্রম করেছে ফেলতে পারতো তখন। তাঁকে পায়ে ধরে আটকালে তিনি লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেও দেহটির উপরের অংশটি চলে আসতো দাগের বাইরে। লম্বা ঠ্যাং দুটি তাঁর যথেষ্ট পরিমানে সহায়ক হতো। দাগ থেকে অনেক দুরে থেকেই ঝুঁকে পড়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে অপর পক্ষের খেলোয়ারের মাথা স্পর্শ করে ফেলতে পারতেন। ঠ্যাং দুটো ছিল তখন তাঁর জন্য মুল্যবান সম্পদ। লম্বা ঠ্যাং দুটি থাকাতে খেলার সময় কিছু বাড়তি সুবিধাতো তিনি ভোগ করেই থাকতেন। যাহোক, তখন খেলা হতো খুব উপভোগ্য।
চলবে-
বাংলাদেশ সময়: ২০:১০:১৩ ৪৭০ বার পঠিত #প্রাসঙ্গিক কথা #সাতটি দিন #সীমান্ত ভ্রমণ