বঙ্গ-নিউজ: উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং ভাওয়াইয়া গবেষক ডঃ হরিপদ চক্রবর্ত্তীর মতে “ ভাওয়াইয়া প্রেমের গান। আরো গভীরভাবে দেখলে বলা যায়, প্রোষিতভর্তৃকার গান বা বিপ্রলম্ভ শৃংগার রসের গান। নারীর বিরহ ব্যকুলতাই এই গানের মর্মবাণী। এখানে নায়ক কোথাও সাধু, নৌকার মাঝি, মইষাল বন্ধু, গাড়িয়াল বন্ধু,মাহুত বন্ধু আবার কোথাও রাখাল। বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের লোক সংগীত গুলোতে লক্ষ্য করলে দেখা যায় সেখানে প্রেমিক-প্রেমিকাকে স্বভাবতই রাধা-কৃষ্ণ রূপে বর্ণনা করা হয়। সেখানকার যে কোন নদীকেই যমুনা এবং নায়ক-নায়িকার মিলনস্থলকে বৃন্দাবন বানিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ভাওয়াইয়া গানে সেরকমটি দেখা যায় না। এ প্রসঙ্গে লোক সংগীত গবেষক ও লোক সংগীত সংগ্রাহক এবং উদিচী শিল্পী গোষ্ঠীর অন্যতম কর্ণধার হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতে উত্তর বঙ্গের গান পূর্ব বঙ্গের গানের চেয়ে অনেক বেশী জীবন ঘনিষ্ঠ। সেখানে তোরষা নদী যমুনা হয়ে যায় নি, আর চিলমারী বন্দরও বৃন্দাবন হয়ে যায়নি। সমস্ত শাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। সেখানে বিয়ে হওয়াটা “ বেচেয়া খাওয়া” এবং স্বামী দেবতাকে “ পানিয়া মরা” হিসাবে উল্লেখ করা হয়। ভাটিয়ালীতে যেখানে সংসার বৈরাগ্য অনেক সময়ই স্বধর্মচ্যুত, ভাওয়াইয়া সেখানে জাগতিকতায় তীব্র প্রতিবাদী। কাব্যগুণেও এর উৎকৃষ্টতা অতি উচ্চে।
ভাওয়াইয়া গানে রাধাকৃষ্ণের প্রতীক তেমনভাবে দৃষ্ট না হওয়ার কারণ হিসাবে প্রাচীন কালে এই অঞ্চলে শৈব ধর্মের আধিপত্যকে উল্লেখ করেছেন অনেকে। ভাওয়াইয়া গানের আর একটি লক্ষনীয় বিষয় হলো পরকীয়া। এখানে আমাদের রক্ষণশীল সমাজের দৃষ্টিকটু এই বিষয়টিকে দৃষ্টি নন্দন করে উপস্থাপন খুব লক্ষণীয় বিষয়। ভাওয়াইয়া গানে যুবতী নারীর সংগে তার স্বামীর অনুপস্থিতিতে বা তার ব্যর্থতায় অথবা নির্যাতনের সুযোগে দেবর বা অন্য কোন পুরুষের সংগে যে প্রেম ভাব প্রকাশ পায় তা আমরা সহজেই মেনে নিতে বাধ্য হই এর সুন্দর সরস এবং প্রানবন্ত উপস্থাপনের কারণে। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতে, “ অপূর্ব লোক কাব্যের দিক ছেড়ে দিলেও শুধু মেলোডির আকৃতি ও তীক্ষ্নতার দিক দিয়ে বাংলা কেন, ভারতের লোক সংগীতেরও বিরল সম্পদ এই ভাওয়াইয়া।
অতি সাধারণ জীবনের দৈনন্দিন সুখ-দুঃখের কথাগুলো আরো সাধারণ ভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম ভাওয়াইয়া গান। বিলাস বা কোন উচ্চাকাঙ্খা তারা পোষণ করে না। সাধ্যের মধ্যেই করনীয় টুকু করতে পালে তারা সুখী। স্বামীর অলসতা এবং বন্ধু নিয়ে আড্ডা দেওয়া প্রতিদিনের একটি কাজ । এই কাজ টুকু স্ত্রীর নিকট খুব অসহ্য হয়ে পড়ে। তাই স্বামীকে ভর্থৎসনা করে গায় এমন একটি গান-
আরে ওকি নালমণির বাপ
তোমার আইলসেমি স্বভাব,
ও তোমরায় খাইবেন বসিয়া,
গাও জ্বলে মোর চলন দেখিয়া।
পাইছেন একখান উঁচা পিড়া,ঢেপছে বসিয়া রন,
আজ বলেন বাতের বিষ, কাল বলেন ফির জ্বর
ও তোমার ব্যরাম পালায় না,
গাও জ্বলে মোর চলন দেখিয়া।
বাউদিয়ালার আড্ডা জমে, ফুড়ায় গুয়া-পান
তোমার ওগলাই সোনার চাঁন
ঘ্যানর ঘুনর কতই শোনং, তালিয়া নাগিল কান।
যামু মুই বাড়ি ছাড়িয়া ।।
বসি খাইলি রাজাও ফুড়ায়
তাও কি না পান থিত,
কুন্ঠে মাঘ মাসিয়ার শীত
তোমার জারই পালায় না।।
দেবর ক্ষেতে হাল চাষ করতে গেছে। ভাত নিয়ে যাবে ভাবী। কিন্তু অনেক বিলম্ব করে যাওয়ার জন্য দেবর গোসসা করে বসে। তখন ভাবী দেবরের গোস্সা ত্যাগ করে খাবার অনুরোধ জানাতে থাকে এবং সিদল-শুকটা ভর্তা দিয়ে আউটাতে করে আনা খাবার খেতে বলে। এক পর্যায়ে পিঠে মাটি কেন, মাথার চুল এলোমেলো কেন, কোমরের কটি ছিঁড়িল কেমন করে ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেবর। ভাবীও উত্তর দেয় প্রতিটি প্রশ্ন ও খুনসুটির।
দেবরঃ- ও মোর ভাওজি ও, ও মোর ভাউজি-
পুবের বেলা ভাউজি পচ্চিমে গেলো,
পেটের ভোকে ভাউজি পরাণ মোর গেলো
এলাওং না আসিল ভাউজি পন্তার খোড়া ধরি রে ।
ভাউজিঃ- ও মোর দেওরা ও ও
সকালে না বেড়াইছুং পথে, পন্তার খোড়া দেওড়া নিয়া হাতে
হাটিবার না পাওং দেওরা ঐ না কোমরের বিষে রে ।
দেবরঃ-ও মোর ভাউজি ও ও
তোমার পন্তা ভাউজি তোমরায় খাও,
সকাল সকাল ভাউজি বাড়ী যাও
গোরা গাও ভাউজি অইদে হইবে কালারে, ভাউজি—
ভাওজিঃ- ও মোর দেওরা ও ও
গোস্সা ছাড় দেওরা খাবার ধর
হাসি মুখে দেওরা আও কর
সিদল-শুকটা দেওরা আনছুং আউটা করি রে।
চলবে-
বাংলাদেশ সময়: ২০:২০:৩৭ ৩৮৯ বার পঠিত #প্রাসঙ্গিক #ভ্রমণ #সাতটি দিন #সীমান্ত