বঙ্গ-নিউজ: জেলে সম্প্রদায়ের বাক প্রতিবন্ধী দারিদ্র ক্লিষ্ট যুবতী বাসন্তীকে নিয়ে একটি সংবাদ পত্র জাল পড়িয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর সারা বিশ্বে হৈচৈ পড়ে যায়। বিষয়টি আমার মনে আজও দাগ কাটে। তাই একটু উল্লেখ করতে ইচ্ছে হয়।
১৯৭৪ সালের একটি ঘটনা। ’৭১ সালে দেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীন দেশে সব কিছু ধ্বংস করে রেখে যায় পাক হানাদার বাহিনী। পরপর আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানাদেয় দেশটিতে। সে বছরও বন্যায় সারা দেশকে বিপর্যস্ত করে তুলে। মানুষের অভাব এক অভাবনীয় পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে যায়। অর্থনীতি ছিল খুবই নাজুক। ব্যাংক-বীমা শিল্প কারখানা সবই কেবল পুনঃনির্মাণ শুরু হয়। রাস্তা ঘাট ছিল না। সকল সেতু, ব্রীজ কার্লভার্ট রেল পথ সব ধ্বংস প্রাপ্ত, কেবল মেরামতের কাজ চলছে। দেশে তখন চরম খাদ্য সংকট দেখা দেয়। স্বাধীনতার বিপক্ষে সপ্তম নৌবহর প্রদানকারী পাকিস্তানের দোসর আমেরিকা তখন বাংলাদেশে খাদ্য সরবরাহের চুক্তি করলেও খাদ্য ভর্তি গমের জাহাজ আমাদের দেশের কাছাকাছি থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এসব খাদ্য শস্য শেষে সমুদ্রে ফেলে দেয়। তবুও আমাদের দেশের ভুখা মানুষের জন্য সাহায্য করে না। মানবতার এমন বিপর্যয়ে তথাকথিত রাজনীতিক ও পাক-মার্কিন দোসর রাজনীতিকরা সুযোগটা লুফে নেয়। আরও কাজে লাগাতে তারা তৎপর হয়। আমাদের দেশে তাৎক্ষণিক ভাবে তখন খাদ্যের সন্ধান করতে করতে দেশে বিরাট দুর্ভীক্ষ দেখা দেয়।
এই দুর্ভীক্ষ এমনি মারাত্মক হয় যে, রাস্তায় রাস্তায় মৃত দেহ পড়ে থাকতেও দেখা গেছে। সেই দুর্ভীক্ষে সরকারী হিসাবে ২৭,০০০ হাজার মানুষ মারা যায় অনাহারে। বেসরকারী হিসাবে আনুমানিক ১ লক্ষ থেকে প্রায় ৪.৫০ লক্ষ মানুষ মারা যায়। প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বসে থাকেনি। দেশের এমন টালমাটাল অবস্থায় ২২ নভেম্বর ১৯৭৪ দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় একটি ছবি ছেপে দেয়। চূয়াত্তরের দুর্ভীক্ষের প্রতিক এই ছবিটি ছিল কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার চিলমারী বন্দর হতে অদুরে বজরা দিয়ার খাতা গ্রামের হতদরিদ্র জেলে পরিবারের বাক প্রতিবন্ধীর। নাম তার বাসন্তী। একই পত্রিকার ফটো সাংবাদিক আফতাব আহমেদ নামের একজন অন্য একজন রিপোর্টার যার নাম শফিকুল কবির,তাকে নিয়ে এসে এই ছবিটি তুলে ছিলেন। সাথে ছিল স্থানীয় চেয়ারম্যান আনছার আলী। এই আনছার আলী ছিল মুলত মুসলিম লীগের এক নেতা, পরে আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের কর্মী হয়। শিবির পরিবর্তন হলেও তার আনুগত্য পরিবর্তন হয়নি। পরে অবশ্য অনুশোচনা করেছে।
ছবিটি তুলতে গিয়ে বাসন্তীকে মাছ ধরার জাল পড়ানো হয়। নিত্য ক্ষুধার জ্বালা যার পেটে জ্বলছে অহর্নিশ, তাকে পঞ্চাশ টাকার একটি নোট ধরিয়ে দিয়ে রাজি করিয়ে ছবিটি তুলা হয়। আরও অনেক মিথ্যা প্রতারনারও আশ্রয় নেয়। যে বাসন্তী, জগতের কোথায় কি ঘটছে সে সম্পর্কে কোন দিন ভাববার তার অবকাশ নেই,আর সে সক্ষমতাও নেই, সে একজন বাক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। সে কিনা রাতারাতি সারা বিশ্বের নিকট পরিচিতি পেয়ে যায় । দুভিক্ষের প্রতীক হয়ে উঠলো বাসন্তী। কিন্তু অবুঝ এই বাসন্তীর প্রাপ্তি মাত্র পঞ্চাশটি টাকা। আমেরিকা সহ পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্র কারীগন খুব আত্মতৃপ্তি লাভ করতে লাগলো এই দুর্ভীক্ষের সংবাদ প্রচারিত হওয়ায়। ইত্তেফাকের লীড ফটো হিসাবে এই ছবিটি ছাপিয়ে বিশ্বব্যাপি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে উৎখাত কিংবা হত্যার প্রেক্ষাপট নির্মাণ করা হয়ে যায়। দেশে তো বটেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল ছবিটি। পরে ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব নিহত হয়েছিলেন। দেশী-বিদেশী স্বাধীনতা বিরোধী চক্র সকলেই শেখ মুজিবের ব্যর্থতার কথা প্রচারে উঠে পড়ে লেগে গেলো। তারই প্রেক্ষাপটে অন্যান্য ষড়যন্ত্রের সামগ্রিক সমষ্টির ফল হয় শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নির্ভেজাল একজন খাটি দেশ প্রেমিকের সপরিবারে নিহত হওয়া। এমন নির্মমভাবে সরকার উৎখাত হওয়া- যা বিশ্বে বিরল। সরকারের পরিবর্তন হলে আমাদের স্বাধীনতার প্রচন্ড বিরুদ্ধে যাদের অবস্থান ছিল তারা ক্রমান্বয়ে মোস্তাক ও জিয়া সরকারকে স্বীকৃতি দিতে লাগলো। আরও ব্যাপক অপপ্রচার চালিয়ে তাদের এই হত্যাকান্ডটিকে বৈধতা দিতে শুরু করে দিল। রাতরাতি বাংলাদেশ বেতার হয়ে গেলো রেডিও বাংলাদেশ। জয় বাংলার পরিবর্তে এসে গেলো “ বাংলাদেশ জিন্দাবাদ” শ্লো গান। তার পর পর যে কটি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি, তারা স্বীকৃতি দিতে লাগলো। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ। এই অবস্থায় তখন যে সব অপপ্রচার চালানো হয়, তাতে এটাই প্রমাণিত হয় যে, সব সাজানো অপপ্রচারই করা হয়েছিল। বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর ডালিম সদম্ভে ঘোষণা দিতে থাকে “শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে”। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে নিয়ে যেমন খুশী তেমন করে অপবাদ দিয়ে একাত্তরের পরাজিতরা উল্লাসে ফেটে পড়লো। পরে দেখা গেলো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্রের কলঙ্ক সমূহ তাঁর গা ফুটে বের হয়নি ,বাহির থেকে লেপন করা হয়েছিল। রাজনৈতিকেরা অনেক ফায়দা লুটেছেন এটা থেকে, কিন্তু সেই বাসন্তীর ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। বাসন্তী আজও জানে না যে সে বিশ্বের একজন পরিচিতা দুর্ভীক্ষের প্রতীকরূপী এক নারী। সাংবাদিকগনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পর বের হয়ে আসে আসল রহস্য। হলুদ সাংবাদিকতা ও নোংড়া রাজনীতির খোলস থেকে বেড়িয়ে আসে আসল রূপ।
আগেই বলেছি, সচিত্র সংবাদটি প্রচারিত হয়েছিল ২২ নভেম্বর,১৯৭৪ সালে। তাও প্রকাশিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর পৃষ্ঠপোষকতা লাভকারী স্বাধীনতার স্বপক্ষের সাংবাদিক জনাব তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার পত্রিকা “ ”দৈনিক ইত্তেফাকে”। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর এই হতভাগ্য বাসন্তীদের উপরও চাপ আসে। তারা যেন কোন ভাবেই না বলে যে, তাকে টাকা দিয়ে জাল পড়িয়ে ছবি তোলা হয়েছে। বাসন্তীর কাকাতো বোন দুর্গতির কপালেও চরম দুর্গতি নেমে এসেছিল। বাসন্তীর সাথে একই ভাবে নির্দেশ মতো পাট পাতা মুখে জাল পড়া অবস্থায় তোলা হয়েছিল এক সাথে দুজনের একটি ছবি। পরে বিভিন্ন সময়ে প্রচন্ড চাপে পড়ে এই দুর্গতিরা নিরুদ্দেশ হয়। আর চাল-চূলো বিহীন বাসন্তী পড়ে থাকে দেশে।
ছবি তুলার সময় ভাবলেশ হীন বাসন্তী কিছু না বললেও তার এক কাকা বুদুরাম অসহায়ের মতো বলেছিলেন,” চেয়ারম্যান সাব, ছেঁড়া হউক আর ফাড়া হউক, একনা তো শাড়ি আছে , উয়ার উপরত ফির জাল খান ক্যা পড়ান; ইয়ার মানে কি? “
চলবে-
বাংলাদেশ সময়: ২০:২৩:৫৩ ৪০৯ বার পঠিত #প্রাসঙ্গিক #ভ্রমণ #সাতটি দিন #সীমান্ত