প্রথম পর্বের পর..
হাজার হাজার লাশের পাহাড় তৈরি হওয়ার পর জার্মান বাহিনী বুঝতে পারে, তাদের পন্থা বদলাতে হবে। তারা এমন এক অস্ত্র নিয়ে আসে যার ধারেকাছে কিছু দুনিয়া এর আগে দেখেনি। কামান এর আগে অনেক যুদ্ধেই ব্যবহার হয়েছে, কিন্তু যুদ্ধের এ পর্যায়ে জার্মানি যে কামান নিয়ে আসে সেটা অন্যমাত্রার। একশ বছর আগের নেপোলিয়নের করা যুদ্ধে ব্যবহৃত কামানের ওজন ছিল ৫০০ কেজি। সেটা যে গোলা ছুড়ত, তার ওজন ছিল ৫.৫ কেজি আর সেটা ২ কি.মি. দূর পর্যন্ত গোলা ছুড়তে পারত। বেলজিয়ামে ব্যবহৃত সর্ববৃহৎ জার্মান কামানের গোলার ওজন ছিল নেপোলিয়ন আমলের কামানের ওজনের চেয়েও বেশি। আর সেসব গোলার পাল্লা ছিল ১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত। ভয়ঙ্কর এই মারণাস্ত্র আবারও প্রমাণ করে যে, যন্ত্রের সামনে মানুষ কত অসহায়। সেই সাথে জার্মান ইঞ্জিনিয়ারিং কোন পর্যায়ের সেটাও ধারণা করা যায়। এতই শক্তিশালী ছিল এই কামান যে, গোলা ছোড়ার আগে গোলন্দাজকে ৩টি ফুটবল মাঠের সমান দূরে যাওয়া লাগত। শুধু তা-ই না, গোলা ছোড়ার সময় তাদের চোখ, কান আর নাকে তুলা দিয়ে রাখা লাগত, এবং মুখ হা করে থাকা লাগত যাতে তাদের কানের পর্দা ফেটে না যায়।কামানের বিরুদ্ধে মোকাবেলা করার কোন উপায় বেলজিয়ামের ছিল না। তাদের দুর্গগুলো ভেঙে পড়তে থাকে। জার্মান বাহিনী বেলজিয়ামের প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম হলেও, বেলজিয়ামে তাদের অনেক বড় দুটো ক্ষতি হয়। প্রথমত, বেলজিয়ামের দুর্গগুলোর কারণে জার্মানির ফ্রান্স আক্রমণ বিলম্বিত হয়। আগেই বলা হয়েছে, জার্মানির হাতে সময় কম। পশ্চিমে তাদের যত দেরি হবে, পূর্বে রাশিয়া তত এগিয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, বিশ্ব দরবারে তাদের ভাবমূর্তি ধূলিসাৎ হয়ে যায়। নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বেলজিয়ামে জার্মানি শুধু সামরিক আক্রমণ চালায়নি, বেসামরিক অনেক পুরুষ, নারী, এবং শিশুকে নির্যাতন ও হত্যা করে। জার্মানি এই নির্মম হত্যাকাণ্ড চালায় বেলজিয়ামকে তাদের অসহযোগিতার জন্য শিক্ষা দিতে। যেসব জায়গায় পৌঁছে তারা ব্রিজ বা রাস্তা ভাঙা পায়, সেই জায়গার আশেপাশের গ্রামে তারা তাণ্ডব চালায়। উদ্দেশ্য ছিল যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এই কাজ না করে। এসব হত্যার কাহিনী বিশ্ব মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, অনেক ক্ষেত্রে অতিরঞ্জিতভাবে। ফলে অনেক নিরপেক্ষ দেশে জার্মানির বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হতে থাকে, যেটা যুদ্ধের শেষের দিকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।
যুদ্ধের ভয়াবহতা যখন উন্মোচিত হতে শুরু করেছে, তখন যুদ্ধের ময়দানে থাকা জার্মান বাহিনীর মানসিক অবস্থা ভেবে দেখা যাক। দেশের জন্য যুদ্ধ করা বলতে তৎকালীন মানুষের মনে ভেসে আসত— ঘোড়া ছুটিয়ে তরবারি নিয়ে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়া। ইতিহাস যুদ্ধকে একটা রোমান্টিক রূপ দিয়ে এসেছে বহুকাল ধরেই। কিন্তু শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার আগেই মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়ার মধ্যে রোমান্টিকতা কোথায়? বীরত্ব, শক্তি, রণকৌশল, সবকিছুই মূল্যহীন হয়ে পড়ে আধুনিক অস্ত্রের সামনে। আজ যারা বেঁচে গেল তারা বুঝতে পারে, কাল হোক, পরশু হোক, একদিন না একদিন কোনো এক অজানা শত্রুর গুলিতে তাদেরও একই পরিণতি হবে। মৃত্যুর মাঝে বসবাস তাদের, মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা। বেলজিয়াম দখল করে ফ্রান্সের দিকে অগ্রসর হলে ফ্রান্স সেনাধ্যক্ষ মার্ন নদীর তীরে জার্মান বাহিনীকে দমন করতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে জার্মান সেনাধ্যক্ষ হিন্ডেনবার্গের সহকারী সেনাপতি লুভেনডর্ফ টেননবার্গের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে রুশ বাহিনীকে পরাজিত করে।
১৯১৫ সালে রাশিয়া আক্রমণ করে ইউক্রেন ও ক্রিমিয়া অধিকার করে জার্মান বাহিনী। পরবর্তীতে রাশিয়া বিভিন্ন ভাবে জার্মান আক্রমণ করতে চাইলেও জার্মান বাহিনী তা দৃঢ়তার সাথে প্রতিহত করে।তুরস্ক জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিয়ে মিত্রশক্তির গতিরোধের জন্য দার্দানেলিস প্রণালী বন্ধ করে দেয়। ইঙ্গ-ফরাসী বাহিনী দার্দানেলিস প্রণালী দখল করতে চাইলে তুরস্কের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। যুদ্ধের প্রথমদিকের দাপুটে সার্বিয়াও যুদ্ধের দ্বিতীয় বছর অস্ট্রিয়ার কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। জাটল্যান্ডের নৌযুদ্ধে জার্মান নৌবাহিনীর সাথে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর যুদ্ধে জার্মান নৌবাহিনীর পরাজয় ঘটে, এবং জার্মানির অধিকাংশ যুদ্ধ জাহাজ ধ্বংস হয়ে যায়। ব্রিটিশদেরও অনেক যুদ্ধজাহাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এ যুদ্ধে জার্মান নৌবহর বিধ্বস্ত হলে জার্মান নৌবাহিনী বেপরোয়া হয়ে সাবমেরিন আক্রমণ শুরু করে। সাবমেরিন আক্রমণের মাধ্যমেই জার্মান ব্রিটিশ ব্যতীত যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ যাত্রীবাহী জাহাজ ও বাণিজ্যিক জাহাজের ক্ষতি সাধন করে। যার ফলে মিত্রশক্তির পক্ষে জার্মানির বিপক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
১ম বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকে মিত্রশক্তি অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে দাড়াতে পারেনি। ১৯১৭ সালে মিত্রশক্তির ভাগ্যে একে একে ভাগ্য আরও বিপর্যয় হতে থাকে। জার্মান বাহিনী বেলজিয়াম, সার্বিয়া, রুমানিয়া, পোল্যান্ড ও উত্তর ফ্রান্স দখল করে রাশিয়া ও ইতালিকে কোণঠাসা করে ফেলে। এ সময় রাশিয়ার রাজনৈতিক পট পরিবর্তন পূর্ব রণাঙ্গনের যুদ্ধ পরিস্থিতির মোড় সম্পূর্ণরূপে ঘুরিয়ে দেয়। বলশেভিক বিপ্লবের ফলে বিপ্লবী সোভিয়েত সরকার জার্মানির সঙ্গে ব্রেটলিটভস্কের সন্ধি সাক্ষর করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। জার্মানি পূর্ব রণাঙ্গন থেকে পশ্চিম রণাঙ্গনে সৈন্য সরিয়ে নিয়ে আবার ফ্রান্স ও বেলজিয়াম আক্রমণ করে। এমন সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে অংশগ্রহণ যুদ্ধের মোড় পরিবর্তন করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্র্ব্র যুদ্ধে অংশগ্রহণের ফলে ব্রিটিশ দীপপুঞ্জের বিরুদ্ধে জার্মানের নৌ-অবরোধ সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়ে। ১৮২৩ সালের ‘মনরো নীতি’ (Monroe Doctrine) অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে না। ১৯১৪ সালে ইউরোপের রাজনীতিতে ১ম মহাযুদ্ধ শুরু হলেও যুক্তরাষ্ট্র কোন পক্ষে না জড়িয়ে নিরপেক্ষতা বজায় রাখে। কিন্তু জার্মানি বেপরোয়া হয়ে ইংল্যান্ডের সাথে সাবমেরিন যুদ্ধ শুরু করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও কয়েকটি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। এরপর জার্মান সাবমেরিনের আঘাতে মার্কিন যাত্রীবাহী জাহাজ বিলাস তরণী আক্রান্ত হলে এক হাজার যাত্রীসহ জাহাজ ডুবে যায়।এমন পরিস্থিতিতে দু’দেশের সম্পর্কের অবনতি হয়। জার্মানির কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবাদ করলেও জার্মানি কোন উত্তর দেয়নি। এভাবে ঘটনাক্রমে চলতে থাকলে, জার্মানের উগ্রতা ধীরে ধীরে চরম আকারে প্রকাশ পেতে থাকে। ১৯১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আরও দুটি বাণিজ্য জাহাজ আক্রান্ত হলে যুক্তরাষ্ট্রের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়।
১৯১৭ সালের ৬ এপ্রিল জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে মিত্রশক্তির পক্ষে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৯১৮ সালে জার্মানি সামরিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে সর্বশেষ চরম অভিযানের প্রস্তুতি নেয়। জার্মান বাহিনী পরপর তিনটি প্রচণ্ড আক্রমণ করে মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। জার্মানি তার চূড়ান্ত অভিযানে সর্বশক্তি নিয়োগ করে হতবিহবল ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে। শীঘ্রই তুরস্ক, বুলগেরিয়া, অস্ট্রিয়া একে একে পরাস্ত হয়ে মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে। অপরদিকে জার্মানির অভ্যন্তরে নৌবাহিনী ও বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এমতাবস্থায় জার্মানির সম্রাট কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম প্রবল গণ অসন্তোষ ও বিদ্রোহের মুখে শেষ পর্যন্ত সিংহাসন ত্যাগ করে হল্যান্ডে পালিয়ে যায়। জার্মানিতে প্রজাতান্ত্রিক সরকার স্থাপিত হয়। ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর প্রজাতান্ত্রিক সরকার মিত্রশক্তির সাথে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি সাক্ষর করলে ১ম বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে।
( চলবে………)
সংকলনে: মাসুম আজাদ
বাংলাদেশ সময়: ১৫:০১:৫১ ৪১৫ বার পঠিত #আদ্যোপান্ত #ইতালি #ইতিহাস #প্রথম বিশ্বযুদ্ধ #ফ্রান্স #রাশিয়া