রাজাদের আছে এক সুবিশাল দেহরক্ষী বাহিনী। যেটির নাম হ্যান্স ম্যাজেস্টেট কনজেনস গার্ড। বিশ্ব চেনে ‘কিংস গার্ড’ নামে। কিংস গার্ডেরা মূলত নরওয়ের রাজপরিবার, রাজপ্রাসাদ ও নরওয়ের রাজধানী অসলো পাহারা দেয়। এই কিংস গার্ডদের একটি ইউনিট, কিছু বছর অন্তর অন্তর যোগ দেয় স্কটল্যান্ডের মিলিটারি কুচকাওয়াজে। প্রথাটি চলে আসছে ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ থেকে। এই কুচকাওয়াজের নাইটহুড সম্মান পেয়েছে পেঙ্গুইন । আজ তুলে ধরছি নিলস ওলাফের আর্মি ব্রিগেডিয়ার হবার গল্প।
লার্স ক্রিশ্চিয়ানসেন ছিলেন নরওয়ের এক ধনকুবের জাহাজ মালিক ও তিমি শিকারি। আন্টার্কটিকা মহাদেশ ও তার প্রাণিজগৎ নিয়ে ক্রিশ্চিয়ানসেনের ছিল অসীম আগ্রহ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে তিনি একটি অদ্ভুত পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। উত্তর গোলার্ধের নরওয়েতে পেঙ্গুইনের একটি বানিজ্যিক খামার গড়তে চেয়েছিলেন। অথচ পেঙ্গুইন দক্ষিণ গোলার্ধের প্রাণী।
আন্টার্কটিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, চিলির নির্জন সৈকতে বাস করে প্রায় ১৮ টি প্রজাতির পেঙ্গুইন। অ্যাডেলি পেঙ্গুইন, আফ্রিকান জ্যাকঅ্যাস পেঙ্গুইন, চিনস্ট্র্যাপ পেঙ্গুইন, গ্যালাপাগোস পেঙ্গুইন, জেন্টু পেঙ্গুইন, রকহুপার পেঙ্গুইন, কত রকম নাম তাদের। তবে এদের মধ্যে সেরা দুটি প্রজাতি হল এম্পেরর পেঙ্গুইন ও কিং পেঙ্গুইন।
লার্স ক্রিশ্চিয়ানসেনের অবশ্য পেঙ্গুইন সংরক্ষণের উদ্দেশ্য ছিল না। পেঙ্গুইনের মাংস বেচাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। কিন্তু পরিকল্পনাটি সফল হয়নি। তাঁর জাহাজগুলির ক্যাপ্টেনরা বেশ কিছু পেঙ্গুইন ধরে নিয়ে এসেছিলেন নরওয়েতে। কিন্তু উত্তর গোলার্ধের পরিবেশে সেগুলিকে বাঁচানো যায়নি।
লার্স ক্রিশ্চিয়ানসেন যখন পেঙ্গুইনের মাংস বেচার স্বপ্ন দেখছিলেন, ঠিক তখনই উত্তর গোলার্ধকে পেঙ্গুইনদের বাসভূমি করে তোলার চেষ্টা করছিলেন ক্রিশ্চিয়ানসেনের ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিসচিয়ান সালভিসেন। তিনিও ছিলেন নরওয়ের একজন বিখ্যাত ধনকুবের, তিমি শিকারি ও অসংখ্য বাণিজ্য জাহাজের মালিক। ক্রিশ্চিয়ান সালভিসেন চেয়েছিলেন নরওয়েকে পেঙ্গুইনের দ্বিতীয় বাসভূমি বানাতে।
সালভিসেনের মনে হয়েছিল নরওয়ের পরিবেশ তাঁর প্রিয় প্রাণী পেঙ্গুইনদের টিকে থাকার পক্ষে আদর্শ। নরওয়েতে হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা আছে, বরফ ঢাকা সৈকত আছে, সমুদ্রে পর্যাপ্ত খাবার আছে। দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে তিনিও নিয়ে এসেছিলেন বেশ কিছু পেঙ্গুইন। কিন্তু একটাও বাঁচেনি। ১৯১১ সালে প্রয়াত হয়েছিলেন ক্রিসচিয়ান সালভিসেন। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর দুই ছেলে থমাস ও ফ্রেডরিককে বলেছিলেন তাঁর অপূর্ণ সাধের কথা।
ক্রিসচিয়ান সালভিসেনের মৃত্যুর পর কোম্পানির মালিক হয়েছিলেন তাঁর দুই পুত্র থমাস ও ফ্রেডরিক সালভসেন। কোম্পানিটির সদর দফতর ছিল স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গে। সেই সুত্রে দুই ভাইকে নরওয়ে থেকে নিয়মিত যেতে হত এডিনবার্গে। এডিনবার্গেই তাঁরা পেয়েছিলেন বাবার স্বপ্নপূরণের সুযোগ।
রয়াল স্কটল্যান্ড জুলজিক্যাল সোসাইটি ১৯১৩ সালে, এডিনবার্গের করস্টরফিনের পাহাড়ি এলাকায় তৈরি করেছিল একটি চিড়িয়াখানা। ৮২ একর এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা চিড়িয়াখানায় সারা পৃথিবী থেকে আনা হয়েছিল বিভিন্ন প্রাণী। রাশিয়ার বাঘ, দৈত্যাকার পাণ্ডা, কোয়ালা, শিপাঞ্জি, ভাল্লুক সহ নানা ধরণের পশুপাখি ছিল চিড়িয়াখানায়। প্রাণীগুলিকে রাখা হয়েছিল সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে।
বিশাল ব্যবসা সামলানোর সঙ্গে সঙ্গে বাবার অপূর্ণ সাধ পূরণ করার সবরকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন থমাস ও ফ্রেডরিক সালভিসেন। তাই ১৯১৩ সালেই এডিনবার্গ চিড়িয়াখানাকে তাঁরা উপহার দিয়েছিলেন একটি পেঙ্গুইন। চিড়িয়াখানায় পেঙ্গুইনটির জন্য তৈরি করা হয়েছিল বিশাল একটি জলাশয়। জলাশয়ে পাথর দিয়ে ছোট্ট একট দ্বীপ বানানো হয়েছিল, নাম দেওয়া হয়েছিল রক আইল্যান্ড।
দক্ষিণ গোলার্ধের প্রাণীকে উত্তর গোলার্ধে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সবরকম চেষ্টা করেছিল চিড়িয়াখানার কতৃপক্ষ। বাঁচানো গিয়েছিল পেঙ্গুইনটিকে। এডিনবার্গ চিড়িয়াখানার মুখ্য আকর্ষণ হয়ে উঠেছিল ছিল পেঙ্গুইনটি। সালভিসেনদের জাহাজ এডিনবার্গে চিড়িয়াখানায় এনে দিয়েছিল আরও কয়েকটি পেঙ্গুইন। কিং পেঙ্গুইন, জেন্টু পেঙ্গুইন, নর্দান রকহুপার পেঙ্গুইনদের নতুন বাসভূমি হয়ে গিয়েছিল এডিনবার্গ চিড়িয়াখানা। এই পৃথিবীর প্রথম চিড়িয়াখানা, যেটি উত্তর গোলার্ধে সফলভাবে পেঙ্গুইনদের প্রজনন ঘটাতে পেরেছিল। ১৯১৯ সালে দক্ষিণ গোলার্ধের বাইরে জন্ম নিয়েছিল প্রথম পেঙ্গুইন শাবক।
কিংস গার্ড ও প্রথম নিলস ওলাফ
নরওয়ের রাজাদের আছে এক সুবিশাল দেহরক্ষী বাহিনী। যেটির নাম হ্যান্স ম্যাজেস্টেট কনজেনস গার্ড। বিশ্ব চেনে ‘কিংস গার্ড’ নামে। কিংস গার্ডেরা মূলত নরওয়ের রাজপরিবার, রাজপ্রাসাদ ও নরওয়ের রাজধানী অসলো পাহারা দেয়। এই কিংস গার্ডদের একটি ইউনিট, কিছু বছর অন্তর অন্তর যোগ দেয় স্কটল্যান্ডের মিলিটারি কুচকাওয়াজে। প্রথাটি চলে আসছে ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ থেকে।
১৯৬১ সালে, কিংস গার্ডের লেফটেন্যান্ট নিলস ইগ্লিয়েন দল নিয়ে এসেছিলেন কুচকাওয়াজে। তখনই বেড়াতে এসেছিলেন এডিনবার্গ চিড়িয়াখানায়। পেঙ্গুইনদের কলোনি দেখে মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন নিলস ইগ্লিয়েন। চিড়িয়াখানার আধিকারিক নিলস ইগ্লিয়েনকে বলেছিলেন, এই পেঙ্গুইনদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নরওয়ে ও ক্রিসচিয়ানের স্বপ্ন। কিংস গার্ডের পক্ষ থেকে লেফটেন্যান্ট নিলস ইগ্লিয়েন তখনই একটি পেঙ্গুইনকে দত্তক নেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।
পেঙ্গুইনটি ছিল কিং পেঙ্গুইন (Aptenodytes patagonicus) প্রজাতির। কিং পেঙ্গুইন হল পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ পেঙ্গুইন। আয়তনে এম্পারার পেঙ্গুইনের পরেই এর স্থান। দক্ষিণ আটলান্টিক এবং দক্ষিণ ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জে এদের বসবাস। খাদ্য মুলত ছোট মাছ, স্কুইড ও ক্রিল জাতীয় চিংড়ি। খাবারের খোঁজে এরা সমুদ্রের ৩০০- ১০০০ ফুট পর্যন্ত ডুব দিতে পারে।
নিলস ইগ্লিয়েন চিড়িয়াখানা আধিকারিককে জানিয়েছিলেন কিং পেঙ্গুইনটির সমস্ত খরচ বহন করবে কিংস গার্ড। এরপর নিলস ইগ্লিয়েন ও তৎকালীন স্কটল্যান্ডের রাজা পঞ্চম ওলাফের নাম মিলিয়ে কিং পেঙ্গুইনটির নাম রাখা হয়েছিল ‘নিলস ওলাফ‘। কিংস গার্ডের প্রতীক বা ম্যাসকট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল নিল ।
সংকলনেঃ মাসুম আজাদ
বাংলাদেশ সময়: ১৩:২৫:১৬ ৩৩৩ বার পঠিত #আর্মি #এডিনবার্গ #চিড়িয়াখানা #নাইটহুড #পেঙ্গুইন