বঙ্গনিউজঃ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে গাজীপুর সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের করা কটূক্তির চার মিনিটের ভিডিও ভাইরাল হলেও মূল ভিডিও ছিল ৫১ মিনিটের। গাজীপুর মহানগর তাঁতী লীগের জ্যেষ্ঠ সহ সভাপতি মো. জামাল খানের গোপনে ধারণ করা ওই ভিডিওতে শোনা যায়, আওয়ামী লীগ থেকে সদ্য বহিষ্কৃত জাহাঙ্গীর আলম বলছেন, ‘মামুন মণ্ডল ও কিরণকে প্রত্যেক দিন একবার কইরা মাইরা ফেলা উচিত।’ অন্য এক জায়গায় বলছেন, ‘ধনীরা, মন্ত্রীরা কথা বললে আমি শুনি না। ৪-৫ কাউন্সিলর আমার উন্নয়নকে বাধা দিচ্ছে। চীনে হলে এদের মাইরা ফেলত। ওই কাউন্সিলরদের মাইরা ফেলাই উচিত। উন্নয়নে যারা বাধা দিয়েছে, চীনের জাতির পিতাও তাদের মেরে ফেলেছে।’
জাহাঙ্গীর আলম আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর এবার গাজীপুর সিটি মেয়রের উন্নয়নে বাধা দেওয়া না-কি তার দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদ করার কারণে ওই ৪-৫ কাউন্সিলরের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আসলে তাদের সঙ্গে কী নিয়ে বিরোধ শুরু মেয়র জাহাঙ্গীরের? সেই রেশ থেকেই এ বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হয়।
গাজীপুর সিটির ৩৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মামুন মণ্ডল ও ৪৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আসাদুর রহমান কিরণের কথা ভিডিওতেই বলেছেন মেয়র জাহাঙ্গীর। এই দুই কাউন্সিলরের সঙ্গে তার বিরোধ অনেকাটা প্রকাশ্যেই রূপ নিয়েছিল। এ দুইজন ছাড়াও তিনি ইঙ্গিত করেছেন ৪৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূরুল ইসলাম নূরু ও ২৭ নম্বরের জাবেদ আলী জবেকে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মামুন মণ্ডলের সঙ্গে মেয়র জাহাঙ্গীরের বিরোধ বেশি দিনের না হলেও সাবেক ভারপ্রাপ্ত সিটি মেয়র ও ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আসাদুর রহমান কিরণের সঙ্গে বিরোধটা বেশ পুরনো। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র বিএনপির এমএ মান্নান জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনের মামলায় গ্রেপ্তার হলে ২০১৫ সালের মার্চে প্যানেল মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন কিরণ। গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খানের ঘনিষ্ঠজন কিরণের ভারপ্রাপ্ত মেয়র হওয়া মেনে নিতে পারেননি জাহাঙ্গীর। এই মেনে নিতে না পারা থেকেই তার সঙ্গে বিরোধের সৃষ্টি হয়। এছাড়া আজমত উল্লা খানকে সমর্থন করাও বিরোধের একটা কারণ হিসেবে দেখছেন আসাদুর রহমান কিরণ।
তিনি বলেন, আমি আড়াই বছর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। জাহাঙ্গীরের চেয়ে আমার অভিজ্ঞতা একটু হলেও তখন বেশি ছিল। এ কারণে তার কাছে ভিড়তে দেয়নি। কোনো কাজে যদি ভুল ধরি কিংবা বুঝে ফেলি। জাহাঙ্গীর নির্বাচিত হয়ে নিজের ইচ্ছামতো চালাতে থাকেন সিটিকে। দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম সভাতেই প্যানেল মেয়র নির্বাচিত করার বিধি-বিধান লঙ্ঘন করা দিয়ে যাত্রা শুরু করেন জাহাঙ্গীর। তার মেয়াদের তিন বছর চলে গেলেও এখনও পর্যন্ত প্যানেল মেয়র নির্বাচিত করেননি।
কিরণ বলেন, প্রথম সভাতেই প্যানেল নির্বাচিত করার জন্য মামুন মণ্ডলসহ আমরা কয়েকজন জোর দাবি জানিয়েছিলাম। এতে জাহাঙ্গীর খুশি হতে পারেননি। ফলে আমার প্রতি তিনি আরও নাখোশ হন। কাউন্সিলরদের নিয়ে প্রতিমাসে একটি করে মিটিং করার কথা থাকলেও সেটা তিনি করেননি। কারণ তার অনিয়মের কথা আমি তুলে ধরেছি সভায়। মেয়র জাহাঙ্গীর আসলে গাজীপুর সিটিকে একটি ভিন্ন রাজ্য বা মুল্লুকে পরিণত করতে চেষ্টা চালিয়েছেন। যে মগের মুল্লুকে তিনি হতে চেয়েছেন ‘একচ্ছত্র অধিপতি’। যেখানে তার হুকুমের দাস ছাড়া বাকিরা থাকবেন অত্যাচারিত ও সুবিধা বঞ্চিত নাগরিক। আমরা দু’একজন এর প্রতিবাদ করতেই দূরে সরিয়ে দেন।
কাউন্সিলর মামুন মণ্ডল বলেন, আমি আগামী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে লড়ব বলে ঘোষণা দিয়েছি, ইতোমধ্যেই মাঠ গোছানোর কাজও শুরু করেছি। এটা জাহাঙ্গীরের ভালো লাগেনি। এছাড়া ইজতেমা ময়দানে সংস্কার কাজ করার কথা বলে ১৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন মেয়র জাহাঙ্গীর; তার এই দুর্নীতির কথা বারবার বলেছি। এ কারণে তার চোখের কাঁটায় পরিণত হয়েছি।
মামুন বলেন, করোনাকালে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে নগরবাসীর জন্য ত্রাণ পাঠানো হয়। মেয়র তার পছন্দের কাউন্সিলরদের নিয়ে লাখ লাখ মানুষের কাছে ত্রাণ বিতরণ করেন। কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হলো, ত্রাণ সামগ্রীর ব্যাগে ‘সিটি মেয়র জাহাঙ্গীরের উপহার’ লিখে বিতরণ করা হয়। এরপর কাউন্সিলর আসাদুর রহমান কিরণ, জাবেদ আলী জবে, নূরুল ইসলাম নূরু ও আমি এর প্রতিবাদ করি। রাষ্ট্রের সঙ্গে এমনকি নগরবাসীর সঙ্গে এটাও তার একটা প্রতারণা। প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ দিয়েছেন, সেই ত্রাণ নিজের বলে চালিয়ে দেওয়া এক ধরনের ধৃষ্টতা। তার এমন নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদ করার কারণে মূলত আমাদের দূরে সরিয়ে রেখেছেন। এ কারণেই হয়ত তিনি বলেছেন, ‘মামুন মণ্ডল ও কিরণকে প্রত্যেকদিন একবার কইরা মাইরা ফেলা উচিত’।
জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনের সময় তৎকালীন সিটি মেয়র বিএনপির এমএ মান্নানের জন্যও ছিল মেয়র জাহাঙ্গীরের দরদ। মামুন মণ্ডল বলেন, মেয়র মান্নানকে গ্রেপ্তার করা এবং ২৮ মাস জেল খাটানো সরকারের উচিত হয়নি বলে মন্তব্য করেছিলেন জাহাঙ্গীর। ওই ভিডিও বহুদিন ফেসবুকে ঘুরেছে।
এছাড়া টেন্ডার ছাড়া রাস্তা-ঘাট নির্মাণ করার উদ্যোগকে কয়েকজন কাউন্সিলর মেনে নিতে পারেননি। ফলে তাদের সঙ্গেও তার বিরোধ তৈরি হয় বলে জানা যায়।
তবে এ বিষয়ে মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। যদিও তিনি ভিডিওতে বলেছেন, ‘৪-৫ কাউন্সিলর আমার উন্নয়নে বাধা দিচ্ছে। ওই কাউন্সিলরদের মাইরা ফেলাই উচিত’।
বাংলাদেশ সময়: ২১:২৮:১৬ ৩৫৮ বার পঠিত #আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার #মেয়র জাহাঙ্গীর #মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের করা কটূক্তি