বঙ্গ-নিউজ ডটকম:‘দুপুরের খাবার টেবিলে ইলিশ মাছ, বেগুন ভাজি আর ডাল ছিল। কিন্তু কাঁটা বাছতে সময় লাগবে বলে সে মাছ খেল না। বলল, নেত্রীর সভা আছে। এখনই যেতে হবে। রাতে এসে খাব। কিন্তু আর সে ফিরে আসেনি। এখন আর আমি মাছ খেতে পারি না।’কথাগুলো বলেই কাঁদতে শুরু করেন শামীমা আক্তার। তাঁর স্বামী সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ল্যান্স করপোরাল মাহবুবুর রশীদ ছিলেন শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। সেই থেকে দুই ছেলেকে নিয়ে শুরু হয় শামীমার নতুন সংগ্রাম।মাহবুবের বাড়ি কুষ্টিয়া উপজেলার খোকসায়। ২০০১ সালে সেনাবাহিনী থেকে তিনি অবসর নেন। কিছুদিন পরই শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে যোগ দেন। শামীমা বলেন, ‘যোগ দেওয়ার সময় নাকি শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “মাহবুব, আমার নিরাপত্তার চাকরি অনেক ঝুঁকির।” মাহবুব তখন বলছিল, “নেত্রী, সারা জীবন আপনার পাশে থাকব।” আমার স্বামী জীবন দিয়ে নেত্রীর পাশে থেকে গেলেন।’
মাহবুবের মারা যাওয়ার ঘটনা কীভাবে জানলেন—এমন প্রশ্নের জবাবে শামীমা জানান, বোমা হামলার খবর শুনে তিনি দুই ছেলেকে বাসায় রেখে দ্রুত শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদনে চলে যান। মাহবুবের খোঁজ করার পর লোকজন তাঁকে শেখ হাসিনার কাছে নিয়ে যান।
শামীমা বলেন, ‘আমি তাঁকে (শেখ হাসিনা) জিজ্ঞাসা করি, মাহবুব কোথায়? তিনি আমার কাঁধে হাত রাখেন। বলেন, “ওর গুলি লেগেছে। অপারেশন হচ্ছে।” আমি তখনো জানি না মাহবুব মারা গেছে। ওই বাড়িতেই আমি মাহবুবের সঙ্গে চাকরি করতেন এমন একজনকে দেখি। তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, মাহবুব কোথায়? কিন্তু সেও কোনো কথা বলে না। একজন আমাকে চিনতে পারেনি। তিনি আমাকে বলেন, “মাহবুব তো মারা গেছে।” আমি তখন প্রথম জানতে পারি আমার স্বামী আর নেই। পরদিন রাতে প্রথম লাশ দেখি।’
প্রথম আলো ডটকমের কাছে নয় বছরের আগের স্মৃতিচারণা করতে করতে শামীমা বাকরুদ্ধ হয়ে যান। পাশে থাকা বড় ছেলে আশিকুজ্জামান মাকে সান্ত্বনা দেয়। শামীমা বলতে থাকেন, স্বামী মারা যাওয়ার কয়েক মাস পর ঢাকার হাজারীবাগের বাসা ছেড়ে কুষ্টিয়ায় যান। কুষ্টিয়া জেলা স্কুলে ভর্তি করেন দুই ছেলেকে। শেখ হাসিনার দেওয়া টাকা আর সেনাবাহিনীর রেশন দিয়ে সংসার চলত। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সেই রেশন বন্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় আরও অভাব-অনটন। কিন্তু স্বামী চাইতেন ছেলে দুটো লেখাপড়া করুক, উচ্চশিক্ষিত হোক। তাই ছেলে দুটোর লেখাপড়া চালিয়ে নেন শামীমা। বড় ছেলে এ বছর উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে। ছোট ছেলে কুষ্টিয়া জেলা স্কুল থেকে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছে। সে ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। ঢাকায় লেখাপড়া করবে। এ কারণে ঈদের আগে আগে ঢাকায় চলে এসেছেন।
দুই সন্তানকে নিয়ে শামীমা মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট এলাকার একটি ছোট্ট বাসায় থাকেন। বাসাজুড়ে দারিদ্র্যের ছাপ। শামীমা জানালেন, চরম অর্থকষ্টে আছেন। ট্রাস্ট থেকে পাওয়া আট হাজার আর স্বামীর পেনশনের তিন হাজার টাকা, এই নিয়ে চলতে হচ্ছে। শামীমা বলেন, ‘আমি যদি ৩২ নম্বরে একটা ছোট চাকরি পেতাম। ছেলে দুটোকে নিয়ে বেঁচে থাকতে পারতাম।’ দেশের কাছে কোনো চাওয়া আছে? শামীমার উত্তর, ‘আমার স্বামীকে যারা এভাবে মারল, আমি তাদের বিচার চাই।’
নারায়ণগঞ্জের মাসদাইর এলাকায় বাড়ি রতন শিকদারের। দুই সন্তান নিয়ে থাকতেন ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় তিনিও নিহত হন। রতন শিকদার যখন মারা যান, তখন তাঁর বড় ছেলে নিয়াজুল হকের বয়স ছিল আট বছর। আর মেয়ে আমেনা জাহান স্বপ্নার বয়স মাত্র তিন বছর। এই দুই সন্তানকে আগলে এখনো বেঁচে আছেন স্ত্রী রোজী বেগম।
পশ্চিম যাত্রাবাড়ী এলাকার একটি ছোট্ট বাসায় দুই সন্তান নিয়ে তিনি থাকেন। রোজী বেগম বলেন, ‘২১ আগস্ট রাত ১১টার দিকে জানতে পারি আমার স্বামী মারা গেছে। পরদিন সকালে দুই সন্তান নিয়ে আমি স্বামীর লাশ নিতে আসি। কিছুদিন পর নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে একটা ছোট্ট বাসা নিই। আমার বড় ভাই সব খরচ দেয়। আমি আমার স্বামী হত্যার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই’।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় নিহত শামসুদ্দিনের পরিবার এখন ঢাকার খিলগাঁওয়ের ত্রিমোহনি এলাকায় থাকেন। শামসুদ্দিনের স্ত্রী আয়েশা বেগম বলেন, ‘স্বামী মাছের ব্যবসা আর আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন। ২১ আগস্টের হামলায় তিনি মারা যাওয়ার পর চার ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে আমি আছি মহাকষ্টে। এক ছেলে দরজি, এক ছেলে গ্রিলের কাজ করে, দুই ছেলে বেকার। কেউ এখন আর আমাদের খোঁজ নেয় না।’
গ্রেনেড হামলায় নিহত যাত্রাবাড়ী যুবলীগের নেতা আতিক সরদারের পরিবারও চরম অর্থকষ্টে আছে। আতিক মারা যাওয়ার পর তাঁর স্ত্রী ছোট ছোট চার সন্তান নিয়ে চাঁদপুরের গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। আতিকের চাচা যুবলীগের কর্মী ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আতিকের মেয়েটা এসএসসি পাস করেছে। বাকি তিনজনই স্কুলে পড়ে। কেউ তাদের খোঁজ নেয় না। গ্রামের মানুষ যে যেভাবে পারে, তাদের সাহায্য করছে।’
কেবল এই চারটি পরিবারই নয়, ২১ আগস্টের হামলায় নিহতদের পরিবারগুলো গত নয়টি বছর ধরে শোক আর দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছে। তারা চায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের পাশে থাকুন। আর ২১ আগস্টের ঘৃণ্য হামলার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হোক।
বাংলাদেশ সময়: ২:০০:৩৭ ৪৩৭ বার পঠিত