বঙ্গনিউজঃ দেশের তরুণ প্রজন্ম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। করোনা মহামারি শুরুর পর ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ৮ মার্চ পর্যন্ত, সর্বমোট আত্মহত্যা করেছে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন। এর মধ্যে ৩২২টি কেস স্টাডিতে দেখা যায়, আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ৪৯ শতাংশই তরুণ-তরুণী, যাদের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে।
মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, তরুণদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা এবং কোনো একটা চাপের মধ্যে পড়লে তখন হয়তো তারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে। বলা যায়, তরুণদের মধ্যে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাটা কমে যাচ্ছে, যেটা আশঙ্কার কথা। আত্মহত্যার কারণ সব সময় একটা হয় না, বহুমাত্রিক বিষয়। স্কুল-কলেজে পড়ুয়া তরুণদের মধ্যে এই হারটা বেশি। এটা বাড়ছে।
আত্মহত্যা নিয়ে নৃবিজ্ঞানীদের ভিন্নমত শোনা যায়। তারা বলছেন, একটা ছেলে মাস্টার্স পাশ করার পর তার বড় চাপ থাকে—তাকে একটা চাকরি নিতেই হবে, তাকে তার পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। বিয়ে করলে স্ত্রীর দায়িত্বও নিতে হবে। এসব তার জন্য চাপ। পাশাপাশি যেহেতু তাকে শেখানো হয়েছে, তার কষ্টের কথা কাউকে বলা যাবে না, কাঁদতে পরবে না এবং সে ‘পারবে না’—এ কথা বলা যাবে না। সুতরাং সে এসব চাপ নিতে না পেরে আত্মহত্যাপ্রবণ হচ্ছে।
আঁচল ফাউন্ডেশনের ‘করোনায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মানসিক বিপর্যয় :একটি প্রায়োগিক জরিপ’ থেকে জানা যায়, করোনাকালে দেশের ৮৪ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সংগঠনটি তরুণদের মানসিক ভারসাম্য নিয়ে কাজ করে। তারা গত ১২ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জরিপকালে দেশের ২ হাজার ৫৫২ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মতামত নেয়। জরিপে ঢাকা বিভাগ থেকে অংশগ্রহণকারীর হার সবচেয়ে বেশি, যা ১ হাজার ৪৮৪ জন বা ৫৮ দশমিক ২ শতাংশ।
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ বলেছেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮৪ দশমিক ৬ শতাংশই বিষণ্ণতায় ভুগছে। এটা আমাদের জন্য অশনিসংকেত। একজন শিক্ষার্থী যখন বিষণ্ণতায় ভোগে, তখন সে কোনো কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারে না। বিষণ্ণতা হচ্ছে আত্মহত্যার প্রাথমিক ধাপ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বব্যাপী নারীদের তুলনায় পুরুষেরা দ্বিগুণ সংখ্যায় আত্মহত্যা করছে। ব্যাপক মানসিক চাপে নানা ধরনের শারীরিক অসুখে বেশি ভোগে তারা। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী নারীর তুলনায় পুরুষের গড় আয়ু কম।
বাংলাদেশে মানসিক সহায়তাবিষয়ক প্রথম হেল্পলাইন ‘কান পেতে রই’। এই হেল্পলাইনের মূল উদ্দেশ্য সমাজের অনেক মানুষের মনের হতাশা, একাকিত্ব, মানসিক চাপ ও আত্মহত্যার প্রবণতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করা, মানসিক সমর্থন জোগানো। বিশ্বের ৪০টি দেশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
সংস্থাটি বলছে, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত তাদের হেল্পলাইনে ফোন করে কাউনসেলিং চেয়েছে প্রায় ১৩ হাজার মানুষ। তাদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশি। এই পুরুষদের মধ্যে ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি কল করেছেন। সংস্থাটির সমন্বয়ক অরুণ দাস বলছেন, বেশির ভাগই তাদের মানসিক কষ্টের উৎস হিসেবে উপার্জনের চাপের কথা উল্লেখ করে। তাদের একটা অংশ সম্পর্ক নিয়ে সমস্যার কথা বলে এবং মূলত মেয়েরাই এ বিষয়ে বেশি কথা বলে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার বলেন, ‘আত্মহত্যা কখনো স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া নয়। আমাদের জীবনে চাপ থাকবেই, নানা অনিয়ম-অবিচার থাকবে, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থাকবে। এসব ঘটনা মোকাবিলা করেই সামনে এগোতে হবে। প্রত্যেক মানুষ বেঁচে থাকার প্রবণতা নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। বহু চাপ মোকাবিলা করার দক্ষতা থাকতে হয়। সেটা তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়াটা ইদানীং মনে হচ্ছে আমাদের সন্তানেরা পাচ্ছে না।’ এছাড়া অভিভাবকদের একটা বড় ভূমিকা আছে। ছেলেমেয়েকে তারা কীভাবে মানুষ করছেন। এখনকার শিশুদের একলা বড় হওয়া, একটা ভার্চুয়াল জগতে বড় হওয়া, ভার্চুয়াল গেম খেলা, জীবনের বাস্তবতার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হচ্ছে না। ফলে এসব ছেলেমেয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে বেড়ে উঠছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন কনা ইত্তেফাককে বলেন, পুরুষেরা সমাজের পিতৃতন্ত্রের শিকার। ছোটবেলা থেকেই তাকে যেভাবে তৈরি করা হয় অনেক দায়িত্ব দিয়ে, তার কাঁদা যাবে না, তাকে সব দায়িত্ব নিতে হবে, তাকে পরিবারের সবাইকে দেখভাল করতে হবে—তখন সে কিন্তু একটা চাপের মধ্যে থাকে।
সূত্রঃ ইত্তেফাক
বাংলাদেশ সময়: ৮:৩৭:৫৮ ৫৮২ বার পঠিত #আত্মহত্যা #আত্মহত্যার কারণ #তরুণ প্রজন্ম #বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা