বঙ্গ-নিউজঃ সংঘবদ্ধ একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা করছে বলে সহিংস ঘটনাগুলোর তদন্তসংশ্নিষ্ট একাধিক সংস্থা দাবি করেছে। তারা প্রথমে কুমিল্লায় এবং পরে এর জের ধরে আরও কয়েকটি জেলায় পূজামণ্ডপে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করে। অপ্রীতিকর এসব ঘটনায় নেপথ্যে থেকে যারা মূল ভূমিকা পালন করেছে তাদের মধ্যে কয়েকজনের ব্যাপারে স্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও বলছেন, দু-এক দিনের তদন্তের অগ্রগতি সামনে আসতে পারে। এ ছাড়া র্যাব বলছে, কয়েকজনকে খুব অল্প সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে। জড়িতরা গা-ঢাকা দিলেও তাদের গ্রেপ্তার করে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে একাধিক সংস্থা তৎপর রয়েছে।
একজন কর্মকর্তা জানান, ফেসবুক ও ইউটিউবে ভুল তথ্য দিয়ে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা ছড়ানো তিন শতাধিক আইডি বন্ধ করতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) চিঠি দিয়েছে পুলিশসহ একাধিক সংস্থা। কুমিল্লার ঘটনার পর বুধবার থেকে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত এসব আইডি শনাক্ত করা হয়। এর মধ্যে ফেসবুক ও ইউটিউব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে গতকাল পর্যন্ত দুইশ আইডি বন্ধ করেছে বিটিআরসি।
শুক্রবার সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সমকালকে বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের অপচেষ্টা করে যারা অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করছে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে আমরা অত্যন্ত কঠোর। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শক্ত অবস্থানে আছে। কারা কেন কী কারণে সহিংসতা করেছে, তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। আশা করছি, কাল-পরশুর ভেতর তদন্তের বেশ কিছু অগ্রগতি দৃশ্যমান হবে।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল কে এম আজাদ সমকালকে বলেন, ‘যারা নেপথ্যে থেকে ভূমিকা রেখেছিল তাদের ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু তথ্য আমরা পেয়েছি। এখনই এর বেশি কিছু বলা ঠিক হবে না। বড় ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই পরিকল্পিতভাবে এসব ঘটনায় জড়িয়েছে একটি চক্র। জড়িতদের মধ্যে কেউ কেউ আছে যারা অতীতেও একই ধরনের ঘটনায় জড়িত ছিল। আমরা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেব। দ্রুত কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করতে পারব বলে বিশ্বাস রয়েছে।’
বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মিত্র বলেন, পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে তিনশর মতো আইডি বন্ধের অনুরোধ আমরা পেয়েছি। এর মধ্যে দুইশ বন্ধ করা হয়েছে। এসব ঘটনার শিকড়ে হাত দিতে হবে। যারা মূল হোতা তাদের শনাক্ত করা জরুরি। সেটা না হলে এর পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা থাকবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগের ডিসি আফম আল কিবরিয়া বলেন, সিআইডিসহ আরও বেশ কিছু সংস্থা কাজ করছে। শুধু আইডি বন্ধ নয়, যারা এসব পরিচালনা করছে এমন অনেকের নাম তালিকাভুক্ত করে গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হচ্ছে। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটকে তাদের ব্যাপারে তথ্য-প্রমাণ সরবরাহ করে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে সারাদেশে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে পুলিশ-র্যাব ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বৃহস্পতিবার ২২ জেলায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়। গতকাল শুক্রবার আরও ১৩টি জেলায় বিজিবি নামানো হয়। সব মিলিয়ে ৩৫টি জেলায় বিজিবি মোতায়েন রয়েছে। এর বাইরে গতকাল ঢাকা ও সিলেট মহানগরে বিজিবি মোতায়েন করা হয়।
বিজিবির পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান বলেন, সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের চাহিদা থাকলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিজিবি মোতায়েনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে দুই দিনে উচ্চ পর্যায়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ-র্যাবের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারদলীয় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের কাজে লাগানো হবে। কোনো এলাকায় বিশৃঙ্খলা তৈরি হলে বা কেউ মন্দিরে হামলা করার চেষ্টা করলে তা মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করবে তারা।
গত তিন দিনে সারাদেশে কত সংখ্যক গ্রেপ্তার করা হয়েছে এমন সুনির্দিষ্ট সংখ্যা জানাতে পারেনি তদন্তসংশ্নিষ্টরা। তবে এই সংখ্যা দেড় শতাধিক বলে জানিয়েছে একটি সূত্র।
উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তার দাবি, প্রাথমিকভাবে যে তথ্য তারা পেয়েছেন তাতে ধারণা করছেন, কুমিল্লার যে ঘটনা তৈরি করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অশান্ত করার প্লট সাজানো হয়েছে তার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনের ধর্মভিত্তিক একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্য আরও যাচাই-বাছাই চলছে। এ ছাড়া কুমিল্লার মন্দিরে হামলাকারীরা স্থানীয় নন বলেও প্রাথমিক তথ্য পেয়েছেন তদন্ত সংশ্নিষ্টরা। পরিচয় গোপন করতেই বাইরে থেকে এসে মুখোশ পরিহিত অবস্থায় হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা।
তদন্তসংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য, কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে যে কয়েকটি এলাকায় এখন পর্যন্ত অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেখানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব বেশি। ছদ্মবেশে যারা ধর্মভিত্তিক দলগুলোর হয়ে কাজ করছে, অনেকের সঙ্গে তাদেরও সন্দেহের তালিকায় রেখে তদন্ত চলছে।
সাইবার মনিটরিংয়ের সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তার ভাষ্য, কুমিল্লার ঘটনার পর যাদের আইডি থেকে উস্কানিমূলক মিথ্যা প্রচারণা সবচেয়ে বেশি চালানো হয়েছে তাদের আইডি শনাক্ত করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার মধ্যরাত পর্যন্ত একটি আইডির পোস্ট ৯ লাখের বেশি শেয়ার হয়েছে। গতকাল আইডি লিঙ্কটি বিটিআরসি বন্ধ করলেও অন্য কিছু লিঙ্ক থেকে তা দেখা যাচ্ছিল।
এ ছাড়া কুমিল্লার ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে গোলাম মাওলা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। র্যাব বলছে, কুমিল্লায় পূজাম পে ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য ছড়িয়ে দেন মাওলা।
অন্য একটি সূত্র বলছে, কুমিল্লার ঘটনা শুরুতে পেশাদারিত্বের সঙ্গে মোকাবিলা করতে ব্যর্থতার পরিচয় দেন কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি আনোয়ারুল আজিম। ঘটনার পরপরই তিনি সিভিল ড্রেসে মন্দিরে যান। এরপর ওসি যে বক্তব্য দেন তা রেকর্ড করে অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া কুমিল্লায় তিন দফায় মন্দিরে হামলা হলেও ফোন করে দীর্ঘ সময় পুলিশের সাহায্য পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করছে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন।
এ ব্যাপারে ওসি আনোয়ারুল আজিম সমকালকে বলেন, ‘যা করেছি তা সিচুয়েশন ডিমান্ড (পরিস্থিতির দাবি) করেছিল। এখন পর্যন্ত আমার এলাকায় ঘটনায় চারটি মামলা হয়েছে। ৩৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
বাংলাদেশ সময়: ১২:২০:৪৭ ৭৬৪ বার পঠিত #দাঙ্গা #ধর্ম #পূজা #শরদীয়াদূর্গাপুজা #ষড়যন্ত্র #সাম্প্রদায়িক