বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো- হতাশা। যাকে আমরা আপডেট ভার্সনে বলি ‘ডিপ্রেশন।’ বিশ্ব পরিস্থিতির নানা প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন বয়সী মানুষ নানা ধরনের হতাশায় ভুগছেন। বিশেষ করে বর্তমানে ‘টক অব ওয়ার্ল্ড’ খ্যাত করোনা পরিস্থিতির কারণে এই হতাশা ক্রমশ বাড়ছে। করোনা বিশ্বের স্বাভাবিক অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এছাড়া শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি সর্বোপরি আর্থ-সামাজিক অবস্থায় একটি ভয়াবহ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এই করোনা পরিস্থিতির ফলে বিশ্বের মধ্যে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। চাকুরি হারিয়েছে অসংখ্য অগণিত মানুষ। শিক্ষাব্যবস্থায়ও নেমেছে ধ্বস। এ পর্যন্ত পৃথিবীতে প্রায় আটচল্লিশ লাখের মতো মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কারণে অসংখ্য মানুষ আবার হতাশার শিকার হচ্ছেন নিয়মিত। অসংখ্য মানুষ হতাশার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অনেকে আত্মঘাতীও হচ্ছেন। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা জানি, জীবন প্রবহমান একটি যাত্রা। আল্লাহ তায়া’লা আমাদের দুনিয়াতে পাঠানোর পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সময়টুকু গতিশীল করে দিয়েছেন। শিশু থেকে আমরা বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হই এবং একটা সময় আমাদের গতিশীল এই জীবনের যবনিকা ঘটে। ক্ষণস্থায়ী এই সময়টুকুতে আমাদের জীবনে যোগ হয় পাওয়া না পাওয়া, হারানো কিংবা হেরে যাওয়া। সর্বসাকূল্যে ব্যর্থতার বহিরূপ ‘হতাশা।’
অথচ একজন মুমিনের জীবনে ‘হতাশা’ নামক কোনো শব্দ নেই, থাকতে পারে না। এটি নিতান্ত ভীরু এবং দুর্বলচিত্তের মানুষের অনুভূতি। একজন সাহসী, ধৈর্যবান মুমিনকে হতাশা কখনও গ্রাস করতে পারে না। কারণ সফলতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধার নাম ‘হতাশা।’
হতাশাগ্রস্ত মানুষ আল্লাহ তায়া’লার রহমত থেকে বঞ্চিত হয়। হতাশ না হয়ে যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা রাখে; সে সর্বদা ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়া’লা বলেছেন, ‘বলুন, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছো, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা জুমার : ৫৩)
আমরা অনেক সময় হতাশাগ্রস্ত হয়ে ভাবি, ‘আল্লাহ আমার ওপর এত বড় বিপদ কেন দিলেন? আমি কী এমন পাপ করেছি? এত দুঃখ-কষ্ট কেন আমার?’ মূলত আল্লাহ তায়া’লা তার প্রিয় বান্দাদের দুঃখ-কষ্টের মাধ্যমে পরীক্ষা নেন। এ বিষয়ে কুরআনুল কারিমে বলেছেন, ‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করবো সামান্য ভয় ও ক্ষুধা এবং জানমাল ও ফসলের কিছুটা ক্ষতি দিয়ে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও, যাদের ওপর কোনো মুসিবত এলে বলে, নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর আর অবশ্যই আমরা তার কাছেই ফিরে যাবো।’ (সূরা আল বাকারা : ১৫৫-১৫৬)
সুখ-দুঃখ মিলিয়েই জীবন। জীবন কারো কাছে ছোট। কারো কাছে বড়। কারো কাছে আনন্দের। কারো কাছে বেদনার। একজন ধনী সুখী মানুষকে প্রশ্ন করলে বলবে, সুখ অনুভব করার সময় কই? বাঁচবোই বা কতদিন? একজন অভাবী অসুখী মানুষকে প্রশ্ন করলে বলবে, আর বাঁচতে চাই না। দিন আর শেষ হয় না। মরতে পারলেই এখন বাঁচি। জীবনের প্রতি কখনো মায়া হয়। কখনো ঘৃণা হয়। ভালো বন্ধু পেলে, প্রেমে পড়লে, সংসারে বা পরিবারে নতুন কেউ আসলে যেমন সন্তান আসলে বা হঠাৎ করে অনেক টাকার মালিক হয়ে গেলে জীবনের প্রতি মায়া জন্মায়। তখনই মনে হয়, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’। আবার টাকা-পয়সার অভাব হলে, ভালো বন্ধু না থাকলে, জীবনে প্রেম না থাকলে, সংসারে অশান্তি থাকলে, জীবনের মায়া আর কাউকে টানে না। কোনো মায়ার বাঁধনই তাকে আর বেঁধে রাখতে পারে না। হতাশায় জীবনের প্রতি আসে ঘৃণা।
তবে কথাগুলো সমাজের সকল স্তরের মানুষের কথা নয়। এই কথাগুলো কোনো একটি শ্রেণির মানুষের। অতি মাত্রায় যারা সুখ উপভোগ করেও আরো কিছু না পাবার কষ্টে ভোগে। ধনী-গরীব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই যেন জীবনের এই বৃত্তের কাছে এসে নিজেকে নিরুপায় মনে করে। সময় বদলেছে, সমাজ বদলেছে, বদলেছে আমাদের জীবনধারা। কিন্তু বদলায়নি জীবনের ধ্রুব বাস্তবতা। আর তাইতো জীবনের ক্ষুদ্রতা, সময়ের গতি নিয়ে মানুষের একজনের একেক রকম অভিযোগ।
জীবনটা কঠিন না, বাস্তবতা অনেক কঠিন। আর বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারি না বলে জীবন অনেক কঠিন মনে হয়। আমরা অনেকেই মনে করে থাকি, এই কঠিন জিনিসটি থেকে যতটা দূরে থাকা যায় ততটাই আমাদের জন্য ভালো। কিন্তু আসলেই কি তাই? অবশ্যই নয়। বাস্তবতাকে সত্য বলে যত দ্রুত আমরা মেনে নিতে পারবো ততই আমাদের জীবনের সমস্যা একে একে দূরে যেতে থাকবে। মেনে নিতে শেখাটা যত দেরিতে হবে ততই জীবনে দুঃখ বাড়তে থাকবে। জীবন আপনাকে যা দিয়েছে তাকে গ্রহণ করা এবং জীবন যে রকম তাকে সেভাবেই আত্তীকরণ করার যে সামর্থ্য, তার মধ্যেই সুখের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে।
সঠিকভাবে সুখ পরিমাপ করা অত্যন্ত কঠিন। সুখের উৎস অসংখ্য। ঘর বাঁধায় সুখ। উত্তম স্ত্রীতে সুখ। ভালো সন্তানে সুখ। বিত্তবৈভবে সুখ। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যে সুখ। কারো আবার কল্যাণকর কাজে বা সেবায় সুখ। সৎ জীবনযাপনে সুখ। ক্ষমতায় সুখ। কারো আনুগত্যে সুখ। নিরাপত্তায় সুখ। শান্তিতে সুখ। এ রকম আরো নানা বিষয়ে সুখ বিদ্যমান। ঠিক বিপরীতগুলো দুঃখের কারণ।
সুখের স্বপ্ন সবাই দেখে। সারা দিন যা কিছু দেখি কিংবা শুনি, ঐগুলি ধারাবাহিক ছবি ও আবেগের সমষ্টি। যা ঘুমের সময় মানুষের মনের মধ্যে স্বপ্ন হয়ে আসে। এগুলো খালি পেটে, খালি পকেটে অথবা খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখা কল্পনা হতে পারে। অবচেতন মনের কথা হতে পারে বা অন্য কিছুও হতে পারে। শ্রেণিবিন্যাস করা বেশ কষ্টকর। সাধারণত মানুষ অনেক স্বপ্ন দেখে। সবার সব স্বপ্নপূরণ হয় না। সেজন্য সব মনে রাখতে পারে না।
স্বপ্ন পূরণ হয়নি বলে নিজেকে দুঃখী ভাবাটাই হলো জীবনটাকে কষ্টের ভিতর ছুঁড়ে ফেলা। আপনি যখন নিজেকে দুঃখী এবং ছোট মনে করছেন তখন নিজের চাইতে নিচের অবস্থানের মানুষটিকে দেখুন। আপনার মতো কিংবা আপনার চেয়ে অনেক যোগ্য মানুষ আপনার চেয়ে অনেক বেশি দুঃখী। তারা অনেক কষ্টে আছে। দেখবেন আপনি অনেকের চাইতে বেশিই ভালো আছেন। এটা যেমন সত্য, আবার নিজেকে সামনে এগিয়ে নিতে চাইবেন তখন আপনি নিজের থেকে বড় অবস্থানের দিকে তাকাবেন। ভাবতে হবে, আমার মত যোগ্য ব্যক্তি আমার থেকে ভালো থাকলে, ভালো কাজ করতে পারলে আমি কেন পারবো না। জীবনের বাস্তবতা হচ্ছে, জীবন একই ধারায় চলে না। সুখ যেমন সারাজীবন থাকে না, দুঃখও তেমনই সারাজীবন থাকে না।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়া’লা যেমন বলেছেন : ‘নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে সুখ রয়েছে।’ (সুরা আশ ইনশিরাহ : ৬) সুখ-দুঃখ নিয়েই জীবন। দুঃখ-কষ্ট সবাইকে ভোগ করতে হয়। ভোগ করাটা, এক একজনের একেক রকম। কেউ কুরবানির জন্য সবচেয়ে বড় গরু ক্রয় করে বাসার সামনে বেঁধে রেখে মানুষকে দেখিয়ে আনন্দ পায়। আবার বাড়ির সামনে গরিবের বাচ্চারা ওই গরু দেখে অনেক আনন্দ পায়। গরিবের মাঝে মাংস বিলি করে কেউ আনন্দ পায়। সেই মাংস নিয়ে রান্না করে মজা করে খেয়ে আনন্দ পায়। দেওয়ার মধ্যে যেমন আনন্দ আছে, পাওয়ার মধ্যেও তেমন আনন্দ আছে। যেমন-একটা পথশিশু শীতে কাঁপতে কাঁপতে ফুটপাতে ইট মাথায় দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পরে শীত কী সে বুঝতে পারে না। তেমনই একজন ধনীর সন্তান শীত লাগার পর লেপের নিচে শুয়ে ঘুমানোর পরে সেও বুঝলো না শীত কী। জীবনে আমরা সবাই কমবেশি ভুক্তভোগী। এর নামই তো জীবন। মানুষের জীবনটা সুখ-দুঃখ মিলিয়েই তৈরি। খুশি মনে কষ্টটুকু মেনে নিয়ে এগিয়ে চলার মধ্যে আছে অসীম আনন্দ। ভুলে গেলে চলবে না, আজকে যিনি খুব ভালো আছেন, কাল তিনি পথের ফকির হয়ে যেতে পারেন। দুঃখ যেমন আসে, সুখও আসে। তবে তার জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়া’লা এটাও বলেছেন : ‘নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গে স্বস্তি রয়েছে।’ (সূরা আল ইনশিরাহ : ৬)
এরপরও আমরা যদি হতাশা নামক বোঝাকে স্বেচ্ছায় বহন করে বেড়াই, তবে দুর্দশা বৈ সফলতা আসবে না। আর তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, হতাশাগ্রস্তদের জন্য রয়েছে দুর্ভোগ ও কষ্ট। মনে রাখতে হবে, আল্লাহ তায়া’লা তার বান্দাদের সাধ্যাতীত কোনো কিছু চাপিয়ে দেন না। যে যতটুকু বহন করার ক্ষমতা রাখে ঠিক ততটুকুই আল্লাহ তায়া’লা তার ওপর তা অর্পণ করেন। সেটা সুখ-দুঃখ, সাফল্য, অর্থ-সম্পদ যেকোনো কিছুই হতে পারে। কুরআনুল কারিমে এ বিষয়ে আল্লাহ তায়া’লা বলেন : ‘আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোনো কাজের ভার দেন না।’ (সূরা আল বাকারা : ২৮৬)
ইসলামী জীবনব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে- হতাশা একজন মুমিন বান্দাকে আল্লাহবিমুখ করে দেয়। আল্লাহ তায়া’লাকে স্মরণ, ইবাদত এসব কিছুকে থমকে দেয় হতাশা নামক অর্থহীন অনুভূতি। মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী, ছোট্ট এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে বিপদ-আপদ, মুসিবত থাকবে- এটা চিরন্তন সত্য। একটা মানুষ কখনোই পরিপূর্ণ সুখ ও শান্তিতে জীবন কাটায় না। দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অনটন, ব্যর্থতা এসব থাকবেই। এরপরও একজন আল্লাহর প্রকৃত বান্দার উচিত সর্বদা ধৈর্যধারণ করা, হতাশাকে প্রশ্রয় না দেওয়া। মহান আল্লাহর দরবারে বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং সাহায্য চাওয়া। আমরা মানুষ কোনো কিছুতেই ব্যর্থ হয়ে হতাশাকে স্বাগত জানাই। তারপর সেই হতাশা কাটাতে বিভিন্ন জনের দ্বারস্থ হই; সাহায্য বা মোটিভেট পাওয়ার জন্য। অথচ দুনিয়ার বাদশা আল্লাহ তায়া’লার দরবারে সাহায্য চাইতে বেমালুম ভুলে যাই। ‘যে আল্লাহ আমার অন্তরে হতাশার জন্ম দিয়েছেন। সেই আল্লাহর কাছে দয়া এবং রহমত কামনা করে হতাশা দূরীভূত করি’ এটাই একজন আল্লাহর বান্দার বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত।
লেখক : প্রাবন্ধিক, প্রকাশক ও সংগঠক
বাংলাদেশ সময়: ২৩:৩০:৫৩ ৬৭৫ বার পঠিত #প্রবন্ধ