৭. ছয়দফা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ :
বাঙালিদের জাতীয় জীবনে ছয় দফা এর গুরুত্ব অপরসিীম ৷ ১৯৫২ সালে র্পূব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক র্কমীদের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘পাকস্তিান সাহিত্য সংসদ’ ৷ যদিও -পাকিস্তান - শব্দটি সংগঠনের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কিন্তু সংগঠনের র্কাযক্রম পরিচালিত হতো মূলতঃ বাংলা সাহিত্যের উন্নয়নের জন্য ৷ ১৯৫৩ সালে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের উদ্দেশ্যে সংগঠনরে পক্ষ থেকে যে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয় তা সম্পাদনা করেন ‘কবি হাসান হাফিজুর রহমান’৷ ১৯৫৫ সালের মাঝামাঝি পুরোদস্তুর ললিতকলা প্রতিষ্ঠান ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী (BAFA- Bulbul Academy of Fine Arts)” প্রতিষ্ঠা করেন ‘মাহমুদ নুরুল হুদা’ ৷ মাহমুদ নুরুল হুদা ছিলেন নিখিল বাংলার মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক ৷তিনি পর্যায়ক্রমে পূর্ব পাকিস্তানের যুবলীগ এবং পাকিস্তান গনতণ্ত্রী দলের স্হপতি ছিলেন ৷পরবর্তীতে সাহিত্য-শিল্পের বিকাশ সাধনের পরিপ্রেক্ষিতে ‘ছায়ানট’ নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয় ৷ বেগম সুফিয়া কামাল এবং ফরিদা হাসান যথাক্রমে এর সভাপতি এবং সম্পাদক নিযুক্ত হন ৷উল্লেখ্য , এই সংগঠন দুটো ‘১লা বৈশাখ’ উদযাপন শুরু করে বাঙালির জাতীয় দিবস হিসেবে ৷ এই সংগঠনের পক্ষ থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত , বেগম রোকেয়া, বেগম সুফিয়া কা্মাল, জাহানারা ইমাম, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষন, পল্লীকবি জসিমউদ্দীন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং অন্যান্য কবি- সাহিত্যিকগণের জণ্ম ও মূত্যুবার্ষিকী পালন করা শুরু হয় ৷প্রতিষ্ঠানগুলোর এই সমস্ত কর্মকান্ড বাঙালিদের বাঙালি সংস্কৃতি চর্চা ও বিকাশের পথে এক অনন্ত দ্বার উন্মোচন করে দেয় ৷পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শুধুমাত্র বাঙালির ‘বাংলা ভাষা’ কে রুদ্ধ করতে চায়নি বরং তারা এর সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত তথা বাঙালির শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিকেও গলাটিপে হত্যা করতে চেয়েছিল ৷ উপরোক্ত ব্যাক্তিবর্গ ছাড়াও এ সময় আমাদের বাংলা ভাষা, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে রক্ষার জন্য আরও এগিয়ে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্, অধ্যপক ড. আহমেদ শরীফ , মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বরেণ্য সাহিত্যিক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ,ড.কাজী মোতাহার হোসেন,অধ্যক্ষ ইব্রাহম খাঁ ,অধ্যাপক আবদুল গফুর প্রমুখ৷বাংলার এই বুদ্ধিজীবি মহল ১৯৬১ সালে পাকিস্তানের সামরিক আইন ও ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী সরকারের নানা বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্নভাবে গোটা পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্র-জয়ন্তী উদযাপন করা হয়৷রবীন্দ্র-জয়ন্তীর সেই মহতী অনুষ্ঠানে গোটা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহন পূর্ব পাকিস্তানের জনমনে বাঙালি-সংস্কৃতির জন্যে একপ্রকার গর্ব সঞ্চারিত হয় ৷ পূর্ব পাকিস্তানের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বলয় ভেঙে দেওয়ার ক্ষেত্রে পশ্চিমা শাসকদের ঘৃণ্য চক্রান্তের ওটাই ছিল একটি বড় প্রতিবাদ এবং এই প্রতিবাদকে পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র শক্তিশালী দল আওয়ামী লীগ পরিপূর্নভাবে সমর্থন জানায় ৷১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ‘বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি’ এর ইস্যু থেকে কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের দৃষ্টি কিছুটা সরে আসলেও যুদ্ধ শেষে সরকার আবারও তার পূর্ব চরিত্রের প্রকাশ ঘটায় এবং পূর্ব পাকিস্তানে ‘বাংলা ভাষা-বাঙালি সংস্কৃতি ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ’ এর ভিতে পূনরায় আঘাত হানতে থাকে ৷ পশ্চিমাদের অত্যাচারে বাংলার আপামর জণসাধারন বিক্ষোভে ফেটে পড়ে৷এদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর তীব্র প্রতিবাদ জানানোর জন্য আওয়ামী লীগ দলটিকে আরও শক্তিশালী ও সুসংগঠিত করায় মনোনিবেশ করেন ৷পূর্ব পাকিস্তান আওয়মী মুসলিম লীগ পরিপূর্নভাবে একটি অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় ১৯৫৫ সালের ২১,২২,২৩শে অক্টোবরে অনুষ্ঠিত কাউ্ন্সিল অধিবেশনে ৷ এ প্রসঙ্গে দলের সাধারন সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান বার্ষিক রিপোর্টে লিখেছেন,
“প্রতিষ্ঠানকে অসাম্প্রদায়িকরণ প্রসঙ্গে একথা অনস্বীকার্য যে, যে সময় আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম হয়, তখনকার বাস্তব প্রয়োজন অনুযায়ী আমদের সংগঠনকে একটি সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হয়েছিল৷ ………………কিন্তু বর্তমানে সে অবস্হা আর নেই ৷প্রাচীন মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আজ অবসান ঘটেছে ৷ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল পাকিস্তানবাসীর নিজস্ব রাজনৈতিক জোট হিসেবে গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার মহান দায়িত্ব আজ আওয়ামী লীগ গ্রহণ করতে পারে , ……….আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে একথা ঘোষণা করতে পারি যে, দেশের সকল ধর্মের, সকল বর্ণের এবং সকল ভাষাভাষি মানুষকে একটি গণপ্রতিষ্ঠানে সমবেত করা প্রয়োজন ৷ বস্তুত, আওয়ামী লীগ দলকে দল-মত সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য অবারিত করার মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের প্রগতিশীল ভূমিকাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম হবো”৷
বাঙ্গালি জনগোষ্ঠীকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ নিপীড়ন থেকে রক্ষা করতে বাঙ্গালির নন্দিত জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬সালের ৫ ফেব্রুয়ারী পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে বিরোধী দলের এক কনভেনশনে ঐতিহাসিক “ছয় দফা দাবিনামা” প্রস্তাব তৎকালীন পাকিস্তানী কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট উত্থাপন করেন যা ছিল মূলতঃ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সত্যিকারের মুক্তির সনদ । যদিও তৎকালীন মুসলিম লীগ,জামাতী ইসলামী ও বামপন্থিবাদী কিছু কিছু রাজনৈতিক দল এই ছয় দফা কে সিআইএ এর দলিল , ভারতীয় দালালদের ষড়যণ্ত্রের ফসল ও মূল পাকিস্তানের অখণ্ডতা ধ্বংসের প্রস্তাব বলে বিষদাগর করেছিল৷কিন্তু তবুও থেমে থাকেনি দলের কর্মকাণ্ড৷ ছয় দফা প্রস্তাবকে বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালির মুক্তিসনদ হিসাবে আখ্যায়িত করেন। তবে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক চক্র ছয় দফার বিরুদ্ধে চরম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। তাদের মতে ছয় দফা হলো ‘বিচ্ছিন্নতাবাদের নীলনকশা’ কিংবা পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র’ ৷ পাকিস্তানী শাসক চক্রের এ প্রচারণা সত্ত্বেও পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠী ছয় দফাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করেছিল ৷
এই দাবি মূলতঃ পাকিস্তানের দুটি অঞ্চলের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য নিরসরনের জন্য তৈরী করা হয়েছিল৷ কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার এই ন্যায্য দাবিকে বিভিন্ন প্রকার ষড়যন্ত্র বলে অনবরত অপব্যাখ্যা করার প্রয়াস চালিয়েছে। যদিও এই কলামের একেবারে প্রথমদিকের পর্বগুলোতে তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের ২১ দফা,৬ দফা , ১১ দফা ও অন্যান্য দাবী-দাওয়াগুলো এবং ‘ভাষা আন্দোলন-এর প্রেক্ষাপট’ টি পর্ব -১৩,১৪,১৫,২০,২১এ বর্নিত হয় , তথাপিও পাঠকদের হৃদয়াঙ্গমের সুবিধার্থে ১৯৬৬ সালের ছয় দফা টি পূনরায় তুলে ধরা হলো :
ঐতিহাসিক ছয় দফা :
১। শাষনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় প্রকৃতি : লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামো হবে যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রকৃতির। সরকার হবে সংসদীয় ধরনের। প্রদেশগুলো ব্যাপক সায়ত্ত¡শাসন ভোগ করবে। সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গঠিত আইন সভা বা পার্লামেন্ট হবে সার্বভৌম।
২। কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা : পাকিস্তানের কেন্দ্রিয় সরকারের হাতে থাকবে কেবল দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে প্রদেশ বা অংগ রাজ্যগুলোর পূর্ন ক্ষমতা থাকবে।
৩। মুদ্রা ও অর্থ-সম্পর্কিত ক্ষমতা : দেশের দুই অঞ্চলের জন্য দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে। কিংবা দেশের দুই অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকবে। তবে সংবিধানে এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে এক অঞ্চলের মুদ্রা ও মূলধন অন্য অঞ্চলে পাচার হতে না পারে। সে জন্য একটি ফেডারেল ব্যাংকের অধীনে কার্যকরী মনিটরিং ব্যবস্থা থাকবে।
৪।রাজস্ব,কর ও শুল্ক সম্পর্কিত ক্ষমতা : সকল প্রকার ট্যাক্স খাজনা ও কর ধার্য এবং আদায়ের ক্ষমতা প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য আদায়কৃত অর্থের একটা নির্দিষ্ট অংশ কেন্দ্রীয় সরকার পাবে।
৫। বৈদিশিক বানিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা : বৈদেশিক মুদ্রার ওপর প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্যগুলোর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্যের জন্য প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্যের সরকারগুলো অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে আলপ-আলোচনা ও চুক্তি করতে পারবে।
৬।আঞ্চলিক বাহিনী গঠনের ক্ষমতা : আঞ্চলিক সংহতি ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্যগুলোর ‘সামরিক বা আধা-সামরিক বাহিনী’ গঠন ও রাখতে পারবে। নৌ সদর দপ্তর পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রামে স্থাপন করতে হবে। (চলবে)৷
তথ্যসূত্র : বুকস্,ইন্টারনেট ।
লেখক : ফারহানা আকতার, পরিচালক ও সহযোগী অধ্যাপক,ইন্টারন্যাশনাল রবীন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউট,ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি মেম্বার বাউবি, আইইউবি, লেখক, গবেষক এবং সহ-সভাপতি, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন ও সদস্য, সম্পাদকমন্ডলী ‘বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন জার্নাল’৷
বাংলাদেশ সময়: ১৪:১৩:৫৫ ১২৪৮ বার পঠিত # #দলিল #নতুন প্রজন্ম #প্রজন্ম #বাঙালি জাতীয়তা বাদ #মুক্তিযুদ্ধ #স্বাধীনতা #৬ দফা