বঙ্গনিউজঃ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে দায়ের করা মোসারাত জাহান মুনিয়ার আত্মহত্যা প্ররোচনার মামলা থেকে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরকে অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে যৌক্তিক কারণ না থাকায় খারিজ করা হয়েছে পুলিশ প্রতিবেদনের ওপর দেওয়া বাদী নুসরাত জাহান তানিয়ার নারাজির আবেদন। গতকাল বুধবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের হাকিম রাজেশ চৌধুরী এই আদেশ দেন।
এর আগে মঙ্গলবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গুলশান থানার ওসি আবুল হোসেনের দাখিল করা প্রতিবেদনের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। বাদীপক্ষের বক্তব্য শোনার পর আদালত পরবর্তী সময়ে আদেশের জন্য রেখে দেন।
সায়েম সোবহান আনভীরকে অব্যাহতি দিয়ে দেওয়া আদালতের আদেশের পর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বিবাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তুহিন হাওলাদার বলেন, ‘সায়েম সোবহান আনভীর দেশের একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী এবং শীর্ষস্থানীয় ব্যাবসায়িক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। দেশে-বিদেশে তাঁর ব্যাপক সুনাম ও সুখ্যাতি রয়েছে। তাঁর সুনাম ক্ষুণ্ন করা এবং বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যাবসায়িক ক্ষতিসাধনের হীন উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ ষড়যন্ত্র এবং চক্রান্তমূলকভাবে তাঁকে এই মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। পুলিশ দীর্ঘ তিন মাসের তদন্তে আসামি সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে অভিযোগের সপক্ষে গ্রহণযোগ্য কোনো প্রমাণ পায়নি। পুলিশ প্রতিবেদন গ্রহণ ও আদালতের আদেশে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘বসুন্ধরা গ্রুপের বিরুদ্ধে এই চক্রান্তে বাদী নুসরাত জাহান তানিয়ার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী দেশি-বিদেশি শক্তিশালী চক্র। যারা দেশের গণতন্ত্র চায় না, উন্নয়ন চায় না, তারা এসব চক্রান্তে শামিল হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তারা নানাবিধ কুৎসা ও অপপ্রচার ছড়াতে থাকে। বাদী নুসরাতও সরাসরি এসব টক শো ও অনলাইন সভায় যোগ দিয়ে নানা অপপ্রচার করেন। আজ (বুধবার) আদালতের আদেশে বসুন্ধরার এমডি অব্যাহতি পাওয়ার মধ্য দিয়ে তাদের এসব চক্রান্ত মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার মাধ্যমে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’
আদালতের আদেশে বলা হয়েছে, ‘যেহেতু মামলার তদন্তে আসামির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না পাওয়ায় আসামিকে অব্যাহতির সুপারিশ করে গুলশান থানা পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে, এই প্রতিবেদন দীর্ঘ পর্যালোচনা করে গ্রহণ করা হলো। একই সঙ্গে যৌক্তিক কারণ না থাকায় বাদিনীর নারাজির আবেদন খারিজ করা হলো। আসামিকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।’
জানা গেছে, মামলার বাদী অভিযোগের সপক্ষে কোনো দালিলিক, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, মৌখিক বা আইনানুগ সাক্ষ্য বা ঘটনার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে না পারায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গত ১৯ জুলাই ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (ফাইনাল রিপোর্ট) দাখিল করেন। পুলিশ প্রতিবেদনে মুনিয়ার আত্মহত্যা প্ররোচনার মামলার অভিযোগ থেকে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এরপর আদালত এই প্রতিবেদনের ওপর গত ২৯ জুলাই শুনানির দিন ধার্য করেন। একই সঙ্গে মামলার বাদীকেও ধার্য তারিখে আদালতে হাজির থাকার নোটিশ পাঠানো হয়। করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রেক্ষাপটে লকডাউনজনিত কারণে ওই দিন আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় শুনানি অনুষ্ঠিত হয়নি। পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয় ১৭ আগস্ট মঙ্গলবার। নির্ধারিত দিনে মামলার বাদী নুসরাত জাহান তানিয়ার পক্ষে আইনজীবী মাসুদ সালাউদ্দিন চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন দাখিল করেন। বাদিনী নারাজির পক্ষে আদালতে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেন। আদালত বাদীর বক্তব্য মনোযোগসহকারে শোনার পর নথি পর্যালোচনা করে পুলিশের দাখিল করা প্রতিবেদন গ্রহণ করেন।
আদালতে উপস্থিত আইনজীবীরা বলেন, ‘এই আদেশের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো, মুনিয়ার আত্মহত্যার প্ররোচনার জন্য যাঁকে আসামি করা হয়েছে তিনি আদতেই এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। আত্মহত্যার প্ররোচনার কোনো ঘটনা এখানে ঘটেনি।’
গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল হোসেন নিজেই মামলাটির তদন্ত করেন। দীর্ঘ তিন মাস তদন্ত করে পুলিশ বাদীর অভিযোগের সপক্ষে প্রমাণ না পাওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে বলা হয়, ‘এই আত্মহত্যা প্ররোচনার জন্য সংশ্লিষ্ট আসামির কোনো দায় পাওয়া যায়নি।’
আদালতে পুলিশের দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, মামলাটি তদন্তকালে সংগৃহীত প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন, ফরেনসিক পরীক্ষার প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেন তদন্ত কর্মকর্তা। ঘটনাস্থল ফ্ল্যাট মালিকসহ অন্য সাক্ষীদের জবানবন্দি নেন। এমনকি তদন্ত কর্মকর্তা মুনিয়ার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা বোর্ডে গিয়েও তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এসব তদন্তকালে তদন্ত কর্মকর্তা ভিকটিমের যাপিত জীবন সম্পর্কিত তথ্যাবলিও সংগ্রহ করেন। সার্বিক তদন্তে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মামলার বাদী কর্তৃক ভিকটিমের আত্মহত্যায় সহায়তা বা প্ররোচনার অভিযোগের বিষয়ে কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সাক্ষ্য-প্রমাণ পাননি তদন্ত কর্মকর্তা। এমনকি বাদী নিজেও তদন্ত কর্মকর্তার কাছে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি। গোটা তদন্ত কার্যক্রম তদারক করেন পুলিশের ঊধ্বর্তন কর্মকর্তারা। এরপর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি নিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা। এই প্রতিবেদন পাওয়ার পর মহানগর হাকিম আদালতও সময় নিয়ে তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করেন। এরপর আসামিকে অব্যাহতির আদেশ দেন।
উল্লেখ্য, গত ২৬ এপ্রিল গুলশানের একটি বাড়ি থেকে কুমিল্লার কোতোয়ালি থানা এলাকার উজিরদিঘির পাড় এলাকার বাসিন্দা মোসারাত জাহান মুনিয়ার মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার দিন একটি বিলাসবহুল পাজেরো জিপে করে কয়েকজন আইনজীবী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ গুলশান থানায় হাজির হন তাঁর বড় বোন নুসরাত জাহান তানিয়া। তাঁরা পুলিশের ওপর নানামুখী চাপ তৈরি করে এবং প্রাথমিক তদন্ত না করেই তড়িঘড়ি করে ‘আত্মহত্যার প্ররোচনা’ দেওয়ার অভিযোগ এনে গুলশান থানায় একটি মামলা করেন। মামলার অভিযোগে প্রাথমিক তদন্ত ছাড়াই বসুন্ধরা গ্রুপের এমডিকে আসামি করে মামলা নেয় পুলিশ। মামলার পরপরই বিভিন্ন টেলিভিশন টক শো ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বাদী ও তাঁর সহযোগীরা বসুন্ধরা গ্রুপের এমডিসহ বিভিন্নজনকে জড়িয়ে ষড়যন্ত্র ও উসকানিমূলক বক্তব্য দিতে থাকেন। এতে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগেই আসামি সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ শুরু করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুনিয়ার চ্যাটিংয়ের কয়েকটি স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়ে। এসব স্ক্রিনশটে দেখা যায়, নাজমুল করিম চৌধুরী শারুন হোয়াটসঅ্যাপে মুনিয়াকে লিখেছেন, ‘তুমি কিছু করলে বসুন্ধরা গ্রুপ শেষ হয়ে যাবে।’ এ ছাড়া বিভিন্নজনকে ব্ল্যাকমেইল করে মুনিয়ার টাকা দাবির কিছু স্ক্রিনশটও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়াও মুনিয়া ও মামলার বাদী নুসরাতের সঙ্গে বিভিন্নজনের চ্যাটিং ও ফোনের কল রেকর্ড পাওয়া যায়। যাতে বসুন্ধরা গ্রুপের বিরুদ্ধে বড় ধরনের ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনার প্রমাণ মেলে। এ ছাড়া মামলার বাদী নুসরাতের সঙ্গে শারুন চৌধুরী গোপন চুক্তি করেন। শারুন বসুন্ধরা গ্রুপের এমডিকে ফাঁসানোর জন্য ১০ কোটি টাকা বিনিয়োগের খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। পাশাপাশি বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যাবসায়িক প্রতিপক্ষ কিছু গ্রুপ নুসরাতকে এই ষড়যন্ত্রে মদদ জোগায় বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া গত ২৬ এপ্রিল গুলশান থানায় আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে মামলাটি হওয়ার পর থেকেই সরকারবিরোধী চক্র এখান থেকে সুযোগ নেওয়ার অপচেষ্টা করে। দেশে ও দেশের বাইরে অনলাইনে সরকারবিরোধী চক্র নানামুখী অপতৎপরতা শুরু করে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত একটি চক্র মুনিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় বিচার দাবি করে ডাকা মানববন্ধনে সরকার পতনের ডাক দেয়। ওই সমাবেশে বিএনপির অঙ্গসংগঠন মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাত, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সহসভাপতি ও সূত্রাপুর থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি ফরিদ উদ্দিন, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক মহাসচিব নঈম জাহাঙ্গীর, ভাসানী অনুসারী পরিষদের মহাসচিব শেখ রফিকুল ইসলাম বাবুল, নাগরিক ঐক্য কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মোশারফ হোসেনসহ বিএনপির বেশির ভাগ নেতাও বক্তব্য দেন।
এ ছাড়া ‘মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড’ নামের একটি সংগঠন নুসরাতকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশ ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে নানা বিষোদগার করে। এক পর্যায়ে তারা পুলিশকে হুমকি দেয়। ওই সময় বাদীর আইনজীবী বলেন, ‘আমরা পুলিশের তদন্ত মানি না। পুলিশের এই মামলার তদন্ত করার এখতিয়ার নেই।’ পরে জানা যায়, জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর ছেলে নাজমুল করিম চৌধুরী ওরফে শারুনের দেওয়া টাকায় ওই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সংগঠনটি। সংবাদ সম্মেলনের পরই টাকার ভাগাভাগি নিয়ে আয়োজকদের মধ্যে হাতাহাতি লেগে যায়।
এদিকে মুনিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর বড় ভাই আশিকুর রহমান সবুজ গত ২ মে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় জাতীয় সংসদের হুইপের পুত্র নাজমুল করিম চৌধুরী শারুনকে আসামি করা হয়েছে। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে গুলশান থানায় সায়েম সোবহান আনভীরের বিরুদ্ধে দায়ের করা আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলার তদন্ত সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত হত্যা মামলার তদন্ত স্থগিত রাখার আদেশ দেন। সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলেন, এখন আদালতের আদেশ অনুযায়ী শারুনের বিরুদ্ধে দায়ের করা হত্যা মামলার তদন্ত শুরু হবে।
বাংলাদেশ সময়: ৯:৪৬:০৫ ৮৫০ বার পঠিত # #আত্মহত্যা #ধর্ষণ #বসুন্ধরা #মামলা #মুনিয়া হত্যা #সায়েম সোবহান