বঙ্গনিউজঃ চার হাজার টনের জাহাজের ধাক্কা সহ্যের ক্ষমতা থাকায় ফেরির আঘাতে পদ্মা সেতুর ক্ষতির তেমন আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ। তারা বলছে, ১০ হাজার টনের ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’ থাকায় রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প বা সমমানের কম্পন সহ্যক্ষমতা নির্মাণাধীন সেতুটির। তার পরও প্রশ্ন উঠেছে- পদ্মা সেতুর মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় কেন বারবার ধাক্কা খাচ্ছে ফেরি। বড় জাহাজ নির্বিঘ্নে চললেও ৩৯ দিনে পাঁচবার ফেরি ধাক্কা খেয়েছে।সংশ্নিষ্টরা বলেছেন, কয়েক দশকের পুরোনো ফেরির দুর্বল ইঞ্জিনগুলোর গতি বর্ষা মৌসুমে পদ্মা নদীর তীব্র স্রোতের কাছে অসহায়। সেতুর পিয়ার (পিলার) নির্মাণে নদীতে পানিপ্রবাহের পথ সংকুচিত হয়ে স্রোতের গতি আরও বেড়েছে। পিলারের আশপাশে স্রোত ও ঘূর্ণন থাকায় দুর্বল ইঞ্জিনের ফেরিগুলো বাতাস ও স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। স্রোতের টানে পিলারের দিকে গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে। চালকদেরও দক্ষতার অভাব রয়েছে। অথচ ফেরির চেয়ে অনেক বেশি ওজনের তেল ও পণ্যবাহী জাহাজ প্রয়োজনীয় ক্ষমতার ইঞ্জিন দিয়ে নির্বিঘ্নে দুই পিয়ারের মাঝের ১৫০ মিটারের মধ্য দিয়ে চলাচল করছে।পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেছেন, ফেরির নিজস্ব ওজন এবং যাত্রীসহ গাড়ির ওজন মিলিয়ে ৬০০ থেকে হাজার টন। এগুলোর ধাক্কায় সেতুর ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা তেমন একটা নেই। পদ্মা সেতু যে নকশায় তৈরি হয়েছে, তাতে চার হাজার টন জাহাজের ধাক্কা সহনীয়।ধাক্কা থেকে রক্ষায় সেতুর পিলারের চারদিকে ‘বেড়া’ নির্মাণ প্রয়োজন কিনা- এ প্রশ্নে প্রকল্প পরিচালক বলেছেন, বেড়া যাতে না দিতে হয়, সেই জন্যই তো চার হাজার টন ধাক্কা সহনীয় পিলার তৈরি করা হয়েছে। আগামী ২০০ বছর নদীতে যে ক্ষমতার জাহাজ চলবে, সেটা মাথায় রেখেই নকশা করা হয়েছে।গত ২০ জুলাই পদ্মা সেতুর ১৬ নম্বর পিলারে ধাক্কা খেয়ে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) রো রো ফেরি শাহ মখদুমের তলা ফুটো হয়ে যায়। এর আগে ২ ও ১৬ জুলাই একই পিলারে ধাক্কা লাগে ফেরির। ২৩ জুলাই সেতুর ১৭ নম্বর পিলারে ধাক্কা খায় ‘শাহজালাল’ নামে আরেকটি ফেরি। এতে ফেরির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, ‘হাল-প্লেট’ ভেঙে দেবে যায়। ফেরিতে থাকা গাড়িগুলোও একটির সঙ্গে আরেকটির ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সর্বশেষ গত সোমবার সেতুর ১০ নম্বর পিলারে ‘বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর’ নামে ফেরি ধাক্কা খায়। এতে আহত হন পাঁচজন। এ ঘটনার পর লৌহজং থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আবদুল কাদের জানিয়েছিলেন, ফেরির ধাক্কায় ১০ নম্বর পিয়ারের পাইল ক্যাপের সামান্য কিছু অংশের কংক্রিট খসে গেছে। এ ছাড়া সেতুর তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি।তিনি আরও বলেছেন, পদ্মা সেতুর নিচ দিয়ে ফেরির চেয়ে অনেক বড় নৌযান, ট্যাঙ্কার জাহাজ ১২০০ থেকে ১৩০০ টন জ্বালানি নিয়ে বাঘাবাড়ী, আরিচা, নগরবাড়ী যায়। কিন্তু পিলারের সঙ্গে ধাক্কা লাগে না। দুই পিলারের মাঝে দূরত্ব প্রায় ৫০০ ফুট। ফেরির প্রশস্ততা ৫০ ফুটেরও কম। তার পরও কেন বারবার ধাক্কার ঘটনা ঘটছে, সেটা বিআইডব্লিউটিসিই ভালো বলতে পারবে।পদ্মা সেতু প্রকল্প এবং বিআইডব্লিউটিসি সূত্রে জানা গেছে, নদীতে চলতি বর্ষায় স্রোত সেকেন্ডে দুই থেকে তিন মিটার। অর্থাৎ ঘণ্টায় স্রোতের গতি সাত কিলোমিটারের বেশি। বিআইডব্লিউটিসির যেসব ফেরি চলে সেগুলোর সর্বোচ্চ গতি ১০ দশমিক ২ কিলোমিটার। স্রোত ও নৌযানের গতি মিলিয়ে ঘণ্টায় ১৭ কিলোমিটার। কিন্তু ফেরির ৪৪০ থেকে ৫৬০ অশ্ব ক্ষমতার ইঞ্জিনগুলো এত গতির নৌযানকে নিয়ন্ত্রণের উপযোগী নয়। কখনও কখনও স্রোতের গতি ফেরির গতির চেয়ে বেশি হয়। ফলে স্রোতের তোড় ও বাতাসের ধাক্কায় ফেরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পিলারে আছড়ে পড়ে। আরেকটি কারণ হলো ফেরিগুলো সক্ষমতার চেয়ে বেশি ভারের গাড়ি পারাপার করে। ফলে ভরবেগের কারণে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরও খারাপ। সোমবার ধাক্কা খাওয়া ফেরিতে ২৫টি গাড়ি ও ৩৪১ জন যাত্রী ছিল।ফেরির মাস্টার দেলোয়ার হোসেন বলেছেন, সেদিন সন্ধ্যায় বাংলাবাজার ঘাট থেকে ১০ ও ১১ নম্বর পিলারের মধ্য দিয়ে শিমুলিয়ায় যাচ্ছিলেন। আকস্মিক একটি ইঞ্জিনচালিত ট্রলার সামনে এসে পড়ে। তীব্র স্রোত থাকায় ফেরিটি প্রথমে ট্রলারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে সেতুর পিলারে গিয়ে লাগে।পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক বঙ্গনিউজকে বলেছেন, নদীতে ৪১টি পিলার রয়েছে। সে কারণে নদীতে পানি চলাচলের পথ কিছুটা কমেছে। বিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী সরু জায়গা থেকে পানিপ্রবাহের সময় গতি বেড়ে যায়। সে কারণে পিয়ারের ক্যাপে বাধা পেয়ে সেতুর নিচে স্রোতের গতি কিছুটা বেশি। এই স্রোতের মধ্যে কীভাবে নৌযান চালাবে তা বিআইডব্লিউটিসির ব্যাপার।অন্যান্য বড় নৌযান নির্বিঘ্নে চললেও বিআইডব্লিউটিসির ফেরি কেন ধাক্কা খাচ্ছে- এ বিষয়ে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সমকালকে বলেছেন, ফেরি পুরোনো হলেও নৌপথের শ্রেণি মেনেই এগুলো চালানো হচ্ছে। পদ্মা সেতুর নিচে যে নৌ চ্যানেল রয়েছে, সেখানে বাঁক থাকায় পানিতে ঘূর্ণন তৈরি হয়। ফলে ফেরি নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। এ জন্য চালকদের সাবধানতার সঙ্গে ফেরি চালাতে হবে। ভরবেগ নিয়ন্ত্রণে ফেরিতে আগের তুলনায় কম গাড়ি ও যাত্রী পারাপারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথাও জানান তিনি।গত ২৩ জুলাইয়ের ধাক্কার কারণ অনুসন্ধানে বিআইডব্লিউটিসির তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্রোতের কারণে আড়াআড়ি হয়ে ‘শাহজালাল’ ফেরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পিলারে ধাক্কা খেয়েছিল। দায়ী ছিলেন ফেরির মাস্টার ও হুইল সুকানি। তারা স্রোত ও বাতাসের গতিবেগ লক্ষ্য না করে চলছিলেন। কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছে, বর্ষা মৌসুমে তীব্র স্রোতের বিপরীতে কম গতিসম্পন্ন নৌযানের পরিবর্তে শক্তিশালীর ইঞ্জিনের জলযান চালাতে হবে। সেতুতে ধাক্কার ক্ষতি এড়াতে পিয়ার ক্যাপের দু’পাশে রাবার ফেন্ডার (আবরণ) স্থাপন এবং ঘাট স্থানান্তর করা যেতে পারে।এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক এসএম আশিকুজ্জামানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে পদ্মা সেতু প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেছেন, রাবার ফেন্ডারের প্রয়োজন নেই। পদ্মা সেতুর নিচে ফেরি চলাচল বন্ধে ঘাট স্থানান্তরের বিষয়ে তিনি বলেন, এটি সিদ্ধান্ত নেবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।এদিকে স্রোতের তীব্রতা না কমা পর্যন্ত সেতুর নিচ দিয়ে ভারী যানবাহনবাহী ফেরি চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। গতকাল সেতু কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীরের মাস্টার দেলোয়ার হোসেন ও সুকানি আবুল কালাম আজাদকে সাময়িক বরখাস্ত করে ধাক্কার কারণ অনুসন্ধানে বিআইডব্লিউটিসি পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১:২৯:১৬ ৬৪৪ বার পঠিত # #ধাক্কা #নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী #পদ্মা #ফেরি #সেতু প্রকল্প