( একটি ছোট গল্প লেখার সামান্য প্রচেষ্টা)
অনেক দিন চেষ্টা করেছি কুসুমকে কিছু টাকা দিব। তার প্রতি কেমন যেন একটা দুর্বলতা এসে গেল। তাকে বলি
কুসুম !
-জ্বী স্যার,
তোকে যদি কিছু টাকা দেই ,তাহলে তো তোর কষ্টটা একটু কমবে। ফুলের ব্যবসাটা আর একটু বড় করতে পারবি। নাকি ?
না স্যার, কুসুম তৎক্ষনাৎ উত্তর দেয়। কেন ? আমি জানতে চাই।
বলে - রাতে মাস্তানরা আইসা চুলের মুঠি ধইরা সব কাইড়া লইয়া যাইবো। আর মাইরও খাওন লাগবো। ভেবে দেখলাম, সত্যিই তো, টাকা-পয়সার সঞ্চয় তাদের বরং জীবন বিপন্ন করতে পারে। তাদের নাই কোন সিন্ধুক, নেই কোন ভল্ট,নেই কোন ব্যংক হিসাব।
বৃষ্টি আসলে থাকিস কোথায় ?
-ওই গোদাম ঘরের বারান্দায়।
তোর মা আর কোন দিন আসে নি ?
-একদিন পলাইয়া আইছিল।
তারপর ?
-তারপরে আমারে আর ভাইডারে খুব আদর করলো। খাবার নিয়া আইছিল স্যার। পাশে আয়ল্যান্ডে চটের মধ্যে বহাইয়া আদর কইরা খাওয়াইছে। পরে সুন্দর কইরা আমার চুলে বেনী বাইন্দ্যা দিছে।
তারপর ?
-তারপর স্যার, বলেই চোখের জল মুছতে লাগলো। অনেক্ষণ পর কান্না থামিয়ে বলতে লাগলো-আল্লায় আমাগরে হতভাগা বানাইছে স্যার। আম্মায় কি করবো ?
কেন, কি হয়েছিল কুসুম ?
-আমাগো কাছে আওনের বারণ করছিল আমার মায়েরে। মায় তাও পলাইয়া আইছে- হেই বেডায় টের পাইয়া পাছে পাছে আইয়া চুলের মুঠি ধইরা আমাগো সামনে মায়েরে একটা বাঁশের লাঠি দিয়া খুব মারছে। ( কুসুম ”চুলের মুঠি ধইরা “ শব্দটা অহরহই বলে)। মায় তাও আমারে আর ভাইডারে জড়াইয়া ধইরা রাখছে। মাইরের চোডে মার কপাল থাইক্যা রক্ত বাইর অইল। সব তো স্যার আমাগো কপালেরই দোষ। বলে চোখের জল মুছতে লাগলো। পরে একটু শান্ত হয়ে আবার বললো, আমরা ডুকরাইয়া কানতাছি। তাও মায়েরে ছাড়ে না। কত মাইনষেরে বাঁচাইতে কইলাম, কেউ আইলো না। ফিইরাও কেউ তাকাইলো না। তখন আমাগো মায়েরে কইলাম, মারে তুই আর কোন দিন আমাগোরে দেখবার আইবি না। আমরা খুব ভালা আছি রে মা ,খুব ভালা আছি- বলেই উচ্চ স্বরে কাঁদতে লাগল । এই ব্যস্ততম নাগরিক জীবনে কুসুমদের মতো ভাগ্য বিড়ম্বিতদের আটপৌরে জীবনের সুখ-দুঃখ কাহিনী শোনার মতো ফুসরতৎ নগর বাসীর কোথায়? যানজট ছাড়া মানুষের ভীড়ে হেঁটেও চলা সহজ নয়। ফুটপাত দিয়ে হেঁটে চলতে থাকলে দুই মিনিটের রাস্তা দশ মিনিটেও অতিক্রম করার সাধ্য কারো নেই। এই নগরীতে কেউ কারো পরিচিত নয়, নয় আপনজন। কেউ কারো বিপদে আপদে ফিরেও তাকায় না। সবাই যেন জনারণ্যে একা।
আমি নিজেকে খুব অপরাধী ভাবতে লাগলাম। ভাবলাম, এইভাবে তাদের ক্ষতকে দগদগে ঘা না করাই ভালো ছিল। কষ্টের সুপ্ত ভিসুভিয়াস যেন জাগ্রত হয়ে গেলো। কষ্টটা যেন তাদের একমাত্র পাওনা, এমন ধারণা তাদের মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে গেছে। কুসুমরা ধরেই নিয়েছে যে, দুঃখ দুর্দশা শুধু তাদের মতো অভাগাদের জন্যই তৈরী করা হয়েছে। কাজেই এই কষ্ট একমাত্র তাদের প্রাপ্য। সেইদিন আর কোন কথা তাদেরকে জিজ্ঞেস করতে মন সায় দিলো না।
তবে আর একদিন অনেক কথা জানতে চেয়েছিলাম।
আচ্ছা কুসুম, ফুল বিক্রির টাকায়তে তোদের পেট চলে না। তার চেয়ে কোন বাসায় গিয়ে কাজের মেয়ে হিসাবে কাজ করিস না কেন ?
-করছিলাম স্যার। তয় ওইহানে আরও কষ্ট। খালি মারে। আমার ভাইডারে একেবারে সহ্য করবার পারে না। কয়, তোর ভাইডারে অন্য কোনহানে রাইখ্যা আয়। সারাদিন কাম করি। আর আমারে দুইডা খাওন দেয়,ভাইডারে কিছু দেয় না। আমি আমার খাওন ভাইডারে দিয়া দিতাম। অনেক সময় রাইতে আমি খালি একটু পানি খাইয়া ঘুমাইতাম। এই দেহেন স্যার- বলেই তার গায়ের শত ছিন্ন জামাটা একটু উঠিয়ে পিট দেখালো। দেখলাম ,শরীরের কোথাও এক তিল জায়গা খালি নেই শুধু নিষ্ঠুরতম আঘাতের চিন্হ ছাড়া। আঘাতে আঘাতে সমস্ত শরীর কেমন যেন কালো কালো দাগে ভরে গিয়েছে।
কুসুম জীবীকার তাগিদে আরও একটি কাজ করতো। কারণ ফুল বিক্রির টাকায় তেমন খাওয়া জুটতো না। রাজনৈতিক দলগুলো যখন হরতাল আহ্বান করতো,তখন তাকে দিয়ে ককটেল,বোমা ইত্যাদি বহন করাতো। পুলিশ তাদেরকে সন্দেহ করতো না, ছোট শিশু বলে। বিনিময়ে পাঁচ টাকা-দশ টাকা পারিশ্রমিক পেতো। ন্যায় কি অন্যায় সেটা কুসুমের বিবেকে খেলতো না। কুসুম ভাবতো, শিক্ষিত মানুষ বলছে ,তাই হাসি মুখে তা পালন করতো। ভাবতো নিশ্চয় কোন ভালো কাজ। বিনিময়ে কিছু টাকা পেতো। এই টাকাটা ছিল তার জন্য একটা বোনাস পাওনা। তাছাড়াও বলা হতো,বোমা ফাটালে পঞ্চাশ টাকা পাবি। রিক্সায় আগুন দিলে একশত টাকা, কারে আগুন দিলে দুশ টাকা,বাসে আগুন দিলে আরও বেশী বখশিস দেওয়া হবে। এমনি ভাবে প্রলোভন দেখানো হতো। মিছিলে গিয়ে শ্লোগান দিলে বিশ টাকা করে পেতো। ব্যানার ফেস্টুন বহন করা অথবা দেয়ালে পোস্টার লাগানো ইত্যাদিতে আরও কিছু বাড়তি আয় হতো। তবে পোস্টার উল্টো করে লাগালে কোন পয়সা তো পেতোই না, বরং জুটতো গালি। অনেক সময় মারপিটও হতো। (চলবে)
বাংলাদেশ সময়: ১০:২২:৪২ ৫৮৩ বার পঠিত # #কুসুম #ছোট গল্প #স্বপন চক্রবর্ত