( একটি ছোট গল্প লিখার একটু প্রচেষ্টা)
মেয়ে তার মতো করে কখনো গান, কখনো ছড়া, আবার কখনো প্রশ্নবাণে আমাকে জর্জড়িত করে চলছে। আমার একেবারে বাকরুদ্ধ অবস্থা। এই ভাবে চলে আমার নিত্যদিনের পথ চলা।
রিক্সায় যানজটে আটকে পড়ে একই জায়গায় দীর্ঘক্ষণ থেমে আছি। ভিক্ষুক এসে হাত পাতলো-একটা টেকা দেন স্যার,কিছু কিইন্যা খামু। হ্যাঁ বা না কোন উত্তর দিতে ইচ্ছে আর হচ্ছে না। আর উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত হাতও সরাবে না। এভাবেই একটি টাকা সাহায্য দিন, একটি চকলেট কিনুন,একটি চিরুনী,দাঁতের ব্রাশ,আধুনিক নামাজ শিক্ষা, অথবা একটি অতি মূল্যবান পুস্তক “ কি করলে কি হয়” – জেনে নিন,মাত্র বিশ টাকা ,ছোটদের সহজ ইংরেজী শিক্ষা আরো কত কি। যতক্ষণ রিক্সা থেমে থাকবে ততোক্ষণ চলতে থাকবে এই আবেদন। -তখন টেনশন ও বিরক্তিতে প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত হয়।
হঠাৎ ৯/১০ বছরের একটি মেয়ে এসে হাজির। চেহারা দেখে হঠাৎ বুঝতে অসুবিধা হবে তার প্রকৃত বয়স কতো। দারিদ্রক্লিষ্ট চেহারা তার কোন শ্রী প্রদর্শন করে না। প্রকৃত বয়স কত,তাও এক দৃষ্টিতে দেখে ঠাহর করা যায় না। অনেক মিনতী করে বলতে লাগলো , “ ফুল নেন স্যার, একটি ফুল নেন। আমি তার এই আবেদনে কোন উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করিনি। আবারও একই অনুরোধ- নেন না স্যার একটা ফুল, একটা রুডি কিইন্যা ছোড ভাইডারে খাওয়ামু। স্যার সকাল থাইক্যা কিছু খাই নাই, দেন স্যার, আল্লায় আপনার ভালা করবো “ – কথা বলতে বলতে সে তেল-চিরুনী বিরহিত বাদামী রংয়ের চুলে বার বার চুলকাচ্ছিল। একটু দুরেই ৫/৬ বছরের একটি ছেলে বসা। তার হাতে একটি চটের বস্তা। মেয়েটির বার বার অনুরোধ আমাকে ততোধিক বিরক্তিতে ফেলে দিল। আমার রাগ প্রচন্ড বাড়তে লাগলো। দু’একবার নিষেধ কাররার পরও রেহাই পাওয়া গেল না। কিন্তু এই আকুতির বিপরীতে আমার ততোধিক সন্দেহ হতে থাকলো। আমি শোনেছি ,ছোট ছোট বাচ্ছাদেরকে শহরে ভিক্ষা করানো হয়। ওদের পিছনে থাকে একদল দুষ্টচক্র। এমনকি একদম শিশু বাচ্চাদের টাকার বিনিময়ে ভাড়া করে এনে একটু বড় শিশুদের কোলে দিয়ে ভিক্ষা করানো হয়। দিন শেষে শিশুটিকে ফেরত দেওয়া হয়। ভিক্ষাকালে শিশুটির মাও অদুরে লুকিয়ে থাকে। মানুষজন প্রতারিত হয়।
আমি অন্তত একটি রাস্তারএকটি ছোট বালিকার নিকট প্রতারিত হতে রাজি নই। অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে একটা ধমক দিলাম। দেখলাম নির্বিকার বালিকাটি মুখটি ফ্যাকাশে করে আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে। ভাবলাম আপদ গেলো। আমার মেয়ে শৈলী সব কিছু পলকহীন চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। অবশেষে অনুনয়ের সাথে বলতে লাগলো- “ বাবা একটি ফুল কিনে নাওনা, আমি ফুল খুব পছন্দ করি। নাওনা বাবা একটা ফুল। না, ফুল নেব না -কেন বাবা? এমনি -নাও না বাবা একটি ফুল না নেব না, বললাম তো। -বাবা, আমাকে স্কুলে গিয়ে চকলেট কিনে দিতে হবে না। আমি চকলেটের জন্য বায়না ধরবো না। নাও না বাবা একটা ফুল। আমার শৈলীর আব্দার শুনতে পেয়ে ফুল নিয়ে মেয়েটি একটু দুরেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। চলে যায় নি। আমি দুটি ফুল কিনে নিলাম। এমন সময় পিছন দিকে হঠাৎ চীৎকার- ধর ধর ধর.। একটি মহিলা অনুরোধ করে সকলকে জানাতে লাগলো, “ ধরেন ভাই ধরেন! আমার গলার চেইনটা ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। একটু ধরেন। - দেখলাম দু’একজন মহিলাটির সাথে সুর মিলালো,-ধর ধর ধর। আমার রিক্সার পাশ দিয়েই দৌড়ে চলে গেলো। একটু দুরে গিয়েই স্বাভাবিক ভাবে নির্ভীক মনে হেঁটে রাস্তা অতিক্রম করলো। ওরা ছিনতাইকারী। যানজটে এভাবেই তাদের ছিনতাই কাজ চলে। দীর্ঘদিন ধরে প্রায় একই ভাবে যাতায়াত চলছে।
আমার মেয়ের তাগিদে প্রায় প্রতিদিন ফুল কিনতে হচ্ছে। ক্রমান্বয়ে এটি একটি নৈমিত্তিক কাজ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। যানজট থাক বা না থাক,রিক্সা ওয়ালাকে রিক্সা থামাতে বলে ফুল ওয়ালা মেয়েটির নিকট আমার মেয়ে চলে যায়। ফুল ওয়ালা মেয়েটিও মনে হয় এটির অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকে। আমার শত বকুনি বা বাধা তাকে দমাতে পারেনা। তারা একত্রিত হয়ে মনে হয় অভূত পূর্ব এক আনন্দ সাগরে ডুবে যায়। আমি কোন উপায়ান্তর না দেখে অসহায়ের মতো শুধু রিক্সাওয়ালাকে সাইড করে দাঁড়াতে বলি। শৈলীকে ফিরয়ে আনতে কখনো কখনো আমাকেও চলে যেতে হয় তাদের সেই ত্রিরত্ন সভায়।
ক্রমে ক্রমে ফুল বিক্রেতা মেয়েটি সম্পর্কে অনেক কথা জেনেছি। তোর নাম কিরে ? -কুসুম , তোর ভাইয়ের কি নাম ? -সুরুজ স্যার। পৈতৃক প্রদত্ত এই নাম অবশ্য এখন আর নেই। আধুনিক নগর সভ্যতা তাদেরকে নতুন ভাবে নামাকরণ করেছে ইতিমধ্যেই। একটি সাধারণ নাম হয়েছে “টোকাই”। তোদের সঙ্গে আর কে কে আছে ? -আর কেউ নাই স্যার। মিথ্যা বলার আর জায়গা পাস না! -না,মিথ্যা কথা আমরা কই না স্যার। ফের মিথ্যা ? একেবারে পাকা ট্রেনিং ! (চলবে)
বাংলাদেশ সময়: ১১:১৭:১৫ ৫০৯ বার পঠিত #কুসুম #চোট গল্প #স্বপন চক্রবর্তীর লেখা