ফারহানা আকতার এর কলাম –“ নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ –পর্ব- ৪০”

Home Page » সাহিত্য » ফারহানা আকতার এর কলাম –“ নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ –পর্ব- ৪০”
সোমবার, ২৮ জুন ২০২১



নতুন প্রজন্মের চোখে মুক্তিযুদ্ধ
২. ১৯৪৭- ভারত ভাগ (উপমহাদেশের বিভাজন ) :
ঠ.১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব ও পৃথক রাষ্ট্রের দাবি
ড.ক্রীপস মিশন

ঠ.১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব ও পৃথক রাষ্ট্রের দাবি :

লাহোর প্রস্তাব ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানদের রাজনৈতিক ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। কেননা, এ ঐতিহাসিক প্রস্তাব গ্রহণের পর মুসলমানদের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। তার পরিণতিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব। দ্বি-জাতি তত্ত ও লাহোর প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করেই ভারতবর্ষকে বিভক্ত করা হয়।

# লাহোর প্রস্তাবের প্রেক্ষাপট -
খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে ভারতে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অবনতি ঘটে। তবে আইন সভায় মুসলমানদের জন্য আসন সংরক্ষণ ও স্বতন্ত্র নির্বাচন অধিকার ও হিন্দু-মুসলমান বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। এই দুই সম্প্রদায়ের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানে সরকারী বেসরকারী পর্যায়ে কয়েকটি উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। অবশেষে ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন প্রণয়ন করে। এ আইন ভারতীয়দের সন্তুষ্ট করতে করতে পারিনি। তবে এ আইনের আত্ততায় প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন কার্যকর করার জন্য ১৯৩৭ সালে যে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে প্রায় সকল রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। প্রাদেশিক নির্বাচনে অধিকাংশ প্রদেশে কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম প্রদেশসমূহেও মুসলিম লীগ পরাজিত হয়। এমতাবস্থায় মুসলিম লীগ কংগ্রেসের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠনের প্রস্তাব করলে কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে। এমনকি মুসলিম লীগের সাথে কোনরূপ আলাপ-আলোচনা ছাড়াই কংগ্রেস মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহ মন্ত্রীসভা গঠন করে। কংগ্রেস শাসিত প্রদেশসমূহে মুসলিম বিদ্বেষী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। বন্দেমাতারাম কে জাতীয় সংগীত হিসেবে প্রবর্তনের চেষ্টা, স্কুলসমূহের পাঠ্যসূচীতে হিন্দু ধর্ম-দর্শন ও সাহিত্যকে বাধ্যতামূলককরণ, আযান নিষিদ্ধকরণ, নামাজের সময় মসজিদের সামনে দিয়ে বাধ্যযন্ত্রসহ মিছিল এবং সরকারী ভবনসমূহে কংগ্রেসের পতাকা উত্তোলন ইত্যাদি মুসলিম অনুভূতিকে আহত করে। তদুপরি কংগ্রেস নেতাদের ভারতে কেবল দুটি শক্তি ব্রিটিশ সরকার এবং কংগ্রেসের অস্তিত্বে সংμান্ত ঘোষণা, মুসলমানদের দারুণভাবে বিক্ষুদ্ধ করে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বা (যিনি এক সময় হিন্দু মুসলিম মিলনের প্রবক্তা ছিলেন) জওহরলাল নহেরেুর বক্তব্যের প্রতিবাদে তাঁর বিখ্যাত দ্বি-জাতিতত্ত¡ ঘোষণা করেন। দ্বি-জাতিতত্ত¡ মতে, ভারতে হিন্দু-মুসলিম দুটি আলাদা জাতি। তাদের ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পূর্ণ আলাদা। সুতরাং সা¤প্রদায়িক জটিলতা নিরসনে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন অপরিহার্য। দ্বি-জাতি তত্তে¡রই চরম বহি:প্রকাশ লাহোর প্রস্তাব। যার মাধ্যমে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের পরিণত করা হয়। অনেক ঐতিহ্যসিক মূল কারন। মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের দাবী প্রথম উত্থাপন করনে আলামা ইকবাল ১৯৩০ সাল। ১৯৩৩ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঞ্জাবী ছাত্র চৌধুরী রহমত আলী ভারতের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে পাকিস্তান নামক পৃথম রাষ্ট্র গঠানের প্রাস্তব করেন। ১৯৩৯ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পুনরায় মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন।
# লাহোর প্রস্তাবের মূলধারাসমূহ -
১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ অবিভক্ত পাঞ্জাবের রাজধানী লাহোরে মুসলিম লীগের অধিবেশনে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন। বিপুল উৎসাহ

ও উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে ২৪ মার্চ প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। লাহোর প্রস্তাবের মূল ধারাগুলো হলো-
(১) নিখিল ভারত মুসলিম লীগ দৃঢ়তার সাথে পুনঃঘোষণা করছে যে, ১৯৩৫ সালের ভারতশাসন আইনে যে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা রয়েছে তা এ দেশের উদ্ভূত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিত অসঙ্গত ও অকার্যকর। তা ভরতীয় মুসলমানদের কাছে অগ্রহণযোগ্য।
(২) সমস্ত সাংবিধানিক পরিকল্পনা নতুনভাবে বিবেচনা না করা মুসলিম ভারত অসন্তুষ্ট হবে এবং মুসলমানদের অনুমোদন ও সম্মতি ব্যতিরেকে সংবিধান রচিত হলে কোন সংশোধিত পরিকল্পনা হলে তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না।
(৩) নিখিল ভারত মুসলিম লীগের চুড়ান্ত অভিমত এরূপ যে, ভারতে কোন শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা কার্যকর হবে না বা মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না যদি তা নম্নি বর্ণিত মুলনীতির ওপর ভিত্তি করে রচিত না হয়ঃ (ক) ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী স্থানসমূহকে সংলগ্ন অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে, (খ) প্রয়োজন অনুযায়ী সীমানা পরিবর্তন করে এমনভাবে গঠন করতে হবে যেখানে ভারতেবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান এলাকাগুলো স্বাধীন নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের প্রকট করা হবে সংশিষ্ট অঙ্গরাষ্ট্র বা প্রদেশসমূহ হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম।
(৪) এ সমস্ত অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থরক্ষার জন্য তাদের সাথে পরামর্শ সাপেক্ষে সংবিধানে কার্যকর ও বাধ্যতামূলক রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করতে হবে।

# লাহোর প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়া -
(ক) বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া : লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও বাংলাদেশের পৃথক রাষ্ট্র সত্তার সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় এ.কে. ফজলুল হক মনে করেন, বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতা বাঙ্গালি মুসলমানদের হাতে আসবে এবং এ ক্ষমতা তারা নিজেরা ভোগ করবে, কোন কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের হাতে তুলে দিবে না। সোহরাওয়ার্দী মনে করেন, এর ফলে প্রত্যেক প্রদেশ এর উপযোগী শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে, সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হবে। তিনি আরো বলেন, মুসলিম লীগের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুসলমানরা তাদের প্রদেশে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে তারা এই দলের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলবে। বাংলাদেশের মুসলিম লীগের নেতাদের এমনি আশা আকাংখা সত্তে¡ও লাহোর প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বি-জাতি তত্ত¡ যুক্ত করায় এবং একে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করায় এর প্রস্তাবক ফজলুল হক এর সমর্থন করেন নি। কারণ লাহোর প্রস্তাবে দ্বি-জাতি তত্ত বা পাকিস্তান শব্দের উল্লেখ ছিল না। যদিও শেষ পর্যন্ত অবাঙালি নেতাদের তৎপরতায় দ্রুত লাহোর প্রস্তাব ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এর ফলে মুসলিম লীগের অবাঙালি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বাঙালি নেতৃবৃন্দের দ্বনদ্ব প্রকটরূপ নেয়।
(খ) হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া : কংগ্রেস ও হিন্দু নেতাদের মধ্যে লাহোর প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এই প্রস্তাবের সমালোচনা করে মহাত্মা গান্ধী বলেন, যদি আমরা শ্রী জন্নিাহ অভিমত গ্রহণ করি, তা হলে বাংলাদেশে ও পাঞ্জাবের

মুসলমানরা দু’টি স্বতন্ত্র ও পৃথক জাতি হয়ে পড়ে। মহাত্মা গান্ধী ভারত বিভাগকে ‘পাপ কাজ’ বলে মন্তব্য করেন। কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহেরু মুসলমানদের স্বতন্ত্র ও স্বাধীন আবাসভূমি গঠনকে অবান্তর বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন লাহোর প্রস্তাব মেনে নিলে ভারত হয়ে পড়বে বলকান রাষ্ট্রগুলোর মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুলিশী রাষ্ট্র। কলকাতার হিন্দু পত্রিকাগুলো লাহোর প্রস্তাবের তীব্র সমালোচনা করে এবং একে পাকিস্তান প্রস্তাব নামে আখ্যায়িত করে।
(গ) ব্রিটিশ সরকারের প্রতিক্রিয়া : ব্রিটিশ সরকার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় ভারতের হিন্দু মুসলমান উভয় স¤প্রদায়ের সমর্থন লাভে আগ্রহী ছিল। ১৯৪০ সালে পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হলে ভারতে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা মারাত্মক রূপ লাভ করলে ব্রিটিশ সরকার লাহোর প্রস্তাবকে গুরুত্বসহ বিবেচনা করে। এর ফলে ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারে যে, ভারতীয় মুসলমান স¤প্রদায় তথা মুসলিম লীগের সম্মতি ছাড়া ভারতবর্ষে শাসনতান্ত্রিক কোন সিন্ধান্ত নেয়া সম্ভব নয়। লাহোর
প্রস্তাবের বিরোধিতাকারী কংগ্রেসও এক পর্যায় পাকিস্তানের দাবি মেনে নেয়। ব্রিটিশ সরকার অখন্ড ভারতবর্ষের পরিবর্তে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পথ বেছে নেয়। এর ফলে ভারত উপমহাদেশ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান ( র্পূব পাকস্তিান ও পশ্চমি পাকস্তিান) রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
# লাহোর প্রস্তাবের তাৎপর্য ও প্রভাব -
ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে লাহোর প্রস্তাবের প্রভাব অপরিসীম। লাহোর প্রস্তাব জিন্নাহ ঘোষিত দ্বি-জাতি তত্তে রই একটি রাজনৈতিক সংস্করণ। মূলতঃ লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে ভারতবর্ষে মুসলমাদের জন্য অন্তত দু’টি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রস্তাব করা হয়। অবশ্য এর ভিত্তিমূল ছিল সা¤প্রদায়িক চেতনা। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতেই পাকিস্তানের সৃষ্টি।

ড. ক্রীপস প্রস্তাবের পটভূমি :
ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে ক্রীপস মিশন একটি উলেখযোগ্য অধ্যায়। ক্রীপস মিশন এমন এক সময় কাজ শুরু করে যখন ভারতের প্রধান দুই স¤প্রদায়ের (হিন্দু মুসলমান) মধ্যে চরম বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো। এমনকি এসময় বিভিনড়ব স্থানে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা সংঘটিত হয়। কংগ্রেস ভারতকে অখন্ড রেখে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র শোষনার জন্য ব্রিটিশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। অন্যদিকে মুসলমানরা দ্বি-জাতি তত্তের ভিত্তিতে লাহোর প্রস্তাবের আলোকে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাস ভূমি দাবি জানায়। ফলে হিন্দু মুসলমান সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। সংঘাতের বাস্তবতায় ভারতের রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। দূরপ্রাচ্যে জাপানের সমাগত বিজয়ের ফলে যুদ্ধ বিধ্বংসী রূপ নেয়। বিশেষ করে সিঙ্গাপুর ও বার্মার (মিয়ানমায়) পতনের পর ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। নেতাজী সুতাষ চন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দু ফৌজরে সহযোগিতায় জাপানীরা ভারতবর্ষ আমনর পরিকল্পনা করে। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের সাহায্য আশায় ভারতে একটি প্রতিনিধি দল পাঠায়। ব্রিটিশ সরকারের অর্থমন্ত্রী স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপস এর নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল ১৯৪২ সালের ২২ মার্চ ভারতের রাজনৈতিক সংঙ্কট মিমাংশায় একটি প্রস্তাব পেশ করে। প্রতিনিধি দলের প্রধানের নামানুসারে এই মিশনের নাম হয় ক্রীপস মিশন।

#ক্রীপস প্রস্তাবের বৈশিষ্ট্যসমূহ-
১৯৪২ সালের ২২ মার্চ স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপস ভারতের শাসনতান্ত্রিক অগ্রগতির জন্য যে সমস্ত প্রস্তাব পেশ করেন তা ছিল:
(১) ডোমিনিয়নের প্রতিষ্ঠা ক্রীপস মিশন প্রস্তাব: ভারতে একটি যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং একে একটি ডোমিনিয়নের মর্যাদা (Dominion status) প্রদান করার প্রস্তাব করা হয়। এ ডোমিনিয়ন অভ্যন্তরীণ কিংবা বৈদেশিক ব্যাপারে কোন বিদেশী শক্তির অধীনে থাকবে না।

(২) গণপরিষদ প্রতিষ্ঠা : ক্রীপস মিশন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পরেই ভারতে সংবিধান প্রণয়নের জন্য একটি গণপরিষদ (Constituent Assemblly) গঠনের প্রস্তাব করে। ভারতীয়দের কাছে হস্তান্তর ক্ষমতা সম্পর্কে গণপরিষদ ও ব্রিটিশ রাজের সাথে সন্ধি স্থাপনের প্রস্তাব এতে করা হয়।

(৩) গণপরিষদের গঠন প্রকৃতি : ক্রীপস প্রস্তাবে উলেখ করা হয় যে, যুদ্ধ শেষ হবার আগে যদি ভারতীয় নেতৃবৃন্দ নিজেদের মধ্যে কোন প্রকার সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম না হয়, তাহলে শাসনতন্ত্র প্রণয়নকারী সংস্থা যুদ্ধাবসানের অব্যবহিত পরে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী প্রাদেশিক আইনসভার নিমড়বকক্ষ একটি গণপরিষদ নির্বাচন করবে। গণপরিষদ পরে শাসনতন্ত্র রচনা করবে।
(৪) সংবিধান গ্রহণের ব্যাপারে প্রদেশের অধিকার : পৃথক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে প্রদেশগুলো ইচ্ছা করলে নতুন সংবিধান বা শাসনতন্ত্র গ্রহণ করতে পারবে কিংবা নিজেদের বর্তমান শাসনতান্ত্রিক কাঠামোই অক্ষুন্ন রাখতে পারবে। তারা যে কোন পর্যায়ে
পরে ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদান করতে পারবে। কোন প্রদেশ ইচ্ছা করলে পৃথক সংবিধান তৈরি করতে পারবে এবং উক্ত প্রদেশ ভারত ইউনিয়নের সমমর্যাদাসম্পন্ন হবে।

(৫) চুক্তি সম্পাদন : ক্রীপস প্রস্তাব অনুসারে প্রদেশগুলো তাদের ইচ্ছেমত পরিকল্পিত ভারত ইউনিয়নের বাইরে থাকতে পারবে অথবা ইচ্ছে করলে ব্রিটিশ সরকারের সাথে একটা পৃথক চুক্তিতে (Separate Treaty) আবদ্ধ হতে পারবে। ফলে প্রদেশগুলো আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার (Right of self determination) লাভ করবে।
(৬) অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন : সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলগুলোর সমন্বয়ে অবিলম্বে একটি অন্তর্বতীকালীন সরকার (Interim Government) গঠনের প্রস্তাব করে ক্রীপস মিশন। তবে দেশরক্ষার পূর্ণ দায়িত্ব ব্রিটিশ সরকারের হাতেই থাকবে বলে উলেখ করা হয়।
(৭) দেশীয় রাজ্য কর্তৃক চুক্তি সংশোধন : দেশীয় রাজ্যগুলো নতুন সংবিধান গ্রহণ করুক বা না করুক তারা নতুন সংবিধান অনুসারে তাদের সাবেক চুক্তি সংশোধন করে নিতে বাধ্য থাকবে বলে ক্রীপস প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়।

# ক্রীপস মিশনের ব্যর্থতার কারণ -

ব্রিটিশ ভারতের শাসনতান্ত্রিক ক্রম-বিবর্তনের ইতিহাসে ক্রীপস প্রস্তাব কতকগুলো ক্ষেত্রে অগ্রগতির পরিচয় বহন করলেও স্বাধীনতা পাগল ভারতবর্ষের জনগণ এ প্রস্তাবটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। কংগ্রেস তাই এ প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে। কংগ্রেসের প্রত্যাখ্যান করার কারণ :
ক) অনতিবিলম্বে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রদানের কোন কথা প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়নি।
খ) এ প্রস্তাব অখন্ড ভারত গঠনের পরিপস্থী এবং জাতীয় স্বার্থবিরোধী।
গ) দেশরক্ষা বিভাগ ভারতীয়দের হাতে অর্পন করা হয়নি।
ঘ) এ প্রস্তাব অনিশ্চয়তার দোষে দুষ্ট। সুষ্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট কোন বক্তব্য এ প্রস্তাবে নেই।
ঙ) অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতাকে প্রচ্ছন্ন রাখা হয়েছে। চ) গণ-পরিষদ গঠনের প্রকৃতি অগণতান্ত্রিক।
মহাত্মা গান্ধী কংগ্রেসের পক্ষে ক্রীপস প্রস্তাবটিকে একটি ‘চড়ংঃ ফধঃবফ পযবয়ঁব’ হিসেবে চিহ্নিত করে এটাকে বর্জন করার আহবান জানান।

# মুসলিম লীগের প্রত্যাখ্যান করার কারণ -
১। এ প্রস্তাব সুষ্পষ্টভাবে মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবী মেনে নেয়নি;
২। মুসলমান সদস্যদের নিয়ে পৃথক গণপরিষদ গঠনের সুপারিশ এ প্রস্তাবে নেই;
৩।ক্রীপস মিশন গণপরিষদ নির্বাচনের জন্য পৃথক নির্বাচনী এলাকার সুপারিশ করেনি।
৪। সংখ্যালঘু স¤প্রদায়গুলোর স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে ক্রীপস মিশনের সুপারিশসমূহ অপর্যাপ্ত;
৫। দেশীয় রাজ্যগুলোর গণপরিষদের অংশ গ্রহণ বাধ্যতামূলক না করায় মুসলিম লীগ একে অন্যায় বলে মনে করে।

ক্রীপস প্রস্তাব ভারতের রাজনৈতিক নেতা ও জনগণকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। পরসম্পাবিরোধী স্বার্থের সংঘাত ও দাবি আদায়ে অনড় থাকায় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ক্রীপস মিশন প্রস্তাব প্রত্যাখান করে। ফলে ভারতের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানে এ প্রস্তাব পরোপুরি ব্যর্থ হয়। (চলবে) ৷

ফারহানা আকতার
তথ্যসূত্র : বুকস্ , ইন্টারনেট ৷
লেখক: ফারহানা আকতার, ডিরেক্টর এন্ড এ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, ইন্টারন্যাশনাল রবীন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কলামিস্ট, কথাসাহিত্যিক এবং সহ-সভাপতি, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ ৷

লেখকের অন্যান্য বই

বাংলাদেশ সময়: ১৪:১৪:২২   ১০১৯ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

সাহিত্য’র আরও খবর


সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন: স্বপন চক্রবর্তী
ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা “আমি তো গাঁয়ের মেয়ে ”
৫০ বছরের গৌরব নিয়ে জাবির বাংলা বিভাগ বিশাল ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ উৎসব আয়োজন করেছে
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা- ‘তোমার খোঁজে ‘
অতুলপ্রসাদ সেন: ৩য় (শেষ ) পর্ব-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন;পর্ব ২-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন-স্বপন চক্রবর্তী
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা ” যাবে দাদু ভাই ?”
বাদল দিনে- হাসান মিয়া
ইমাম শিকদারের কবিতা ‘ছোট্ট শিশু’

আর্কাইভ