ফারহানা আকতার এর কলাম –“ নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ –পর্ব- ৩৯”

Home Page » সাহিত্য » ফারহানা আকতার এর কলাম –“ নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ –পর্ব- ৩৯”
মঙ্গলবার, ২২ জুন ২০২১



নতুন প্রজন্মের চোখে মুক্তিযুদ্ধ
২. ১৯৪৭- ভারত ভাগ (উপমহাদেশের বিভাজন ) :

জ) জিন্নাহর চৌদ্দ দফা ও দ্বি-জাতি তত্ত¡ :

. চৌদ্দ দফা : ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর চৌদ্দ দফা প্রস্তাবনা একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রকৃতপক্ষে জিন্নাহর চৌদ্দ দফা ছিল নেহেরু রিপোর্টের প্রতিবাদনামা। হিন্দু মুসলমানের মিলনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার প্রেক্ষাপটে জিনড়বাহর তার বিখ্যাত চৌদ্দ দফা তৈরি করেন। ১৯২৯ সালে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে জিনড়বাহ এ দাবিগুলো উপস্থাপন করেন। নম্নিে জন্নিাহর চৌদ্দ দফা আলোচিত হলো -
১. শাসনতন্ত্র হবে ফেডারেল পদ্ধতির। অনুলিখিত ক্ষমতা থাকবে প্রদেশের হাতে।
২. সব প্রদেশকে একই ধরনের স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে।
৩. প্রদেশসমূহ আইন পরিষদে ও অন্যান্য নির্বাচিত সংস্থায় সংখ্যালঘুদের যথেষ্ট প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে।
৪. কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে মসলিম প্রতিনিধিত্ব মোট সদস্য সংখ্যার এক তৃতীয়াংশের কম হবে না।
৫. বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
৬. ভূ-খণ্ডগত কোন পুনর্গঠন দ্বারা পাঞ্জাব, বাংলা ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা ক্ষুণড়ব করা যাবে না।
৭. সকল সম্প্রদায়ের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ও শিক্ষার অধিকার স্বীকৃতি দিতে হবে।
৮. কোন সম্প্রদায়ের তিন-চতুর্থাংশে সদস্যের সম্মতি ছাড়া কোন আইন পরিষদ বা নির্বাচিত সংস্থা উক্ত স¤প্রদায়ের স্বার্থে সংশিষ্ট কোন আইন বা প্রস্তাব গৃহীত হলে তা বৈধ বলে বিবেচিত হবে না।
৯. সিন্ধুকে বোম্বে প্রেসিডেন্সি থেকে পৃথক করতে হবে।
১০. ভারতের অন্যান্য প্রদেশের ন্যায় বেলুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে শাসন সংস্কার প্রবর্তন করতে হবে।
১১. সমস্ত রাষ্ট্রীয় ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাসমূহের চাকুরীতে যোগ্যতা অনুসারে অন্যান্য ভারতীয়দের ন্যায় পর্যাপ্ত হারে মুসলমানদের নিয়োগ করতে হবে।
১২. মুসলমনদের সংস্কৃতি, ভাষা, শিক্ষা, ধর্ম, ব্যক্তিগত আইন বা দাতব্য প্রতিষ্ঠানসমূহের সংরক্ষণ ও উনড়বয়নের জন্য প্রয়োজনীয় আইন শাসনতন্ত্রে থাকতে হবে।
১৩. কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ মুসলমান মন্ত্রী ছাড়া কেন্দ্র বা কেন প্রদেশে মন্ত্রীসভা গঠন করা যাবে না।
১৪. ভারত ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত সব রাজ্যের সম্মতিছাড়া কেন্দ্রীয় আইনসভা কর্তৃক শাসনতন্ত্রে কোন পরিবর্তন আনা যাবে না।
১৯১৬ সালে লক্ষ্মো চুক্তির মাধ্যমে মুসলমানদের রাজনৈতিক দাবি দাওয়া ও আশা আকাঙ্খা বাস্তবায়নের যে শর্তাদি প্রদত্ত হয়েছিল তার প্রতি কংগ্রেস নেতাদের অশ্রদ্ধা ও অনীহা ব্রিটিশ ভারতের মুসলমানদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এ প্রেক্ষাপটে চৗদ্দ দফার রাজনৈতিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কেননা, এর মাধ্যমে বিভক্ত মুসলিম উপদলসমূহ ঐক্যবদ্ধ হয়। তাছাড়া পরবর্তীকালে ম্যাকডোনাল্ডের সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদে এই চৌদ্দ দফা সম্পূর্ণ মেনে নেয়া হয়।

. দ্বি-জাতি তত্ত¡ : ভারতর্বষরে ইতিহাসে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্তে¡র ঘোষণা ঔপনিবেশিক ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
কেননা, এ তত্তে¡র মাধ্যমেই ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়। দ্বি-জাতি তত্তে¡র মূল কথা হচ্ছে, ভারতবর্ষে দু’টি পৃথক জাতি রয়েছে- হিন্দু জাতি এবং মুসলমান জাতি। জিন্নাহর মতে, ভারতীয় মুসলমানদের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, আশা-আকাঙ্খা ভিনড়ব। তাদের ইতিহাসের নায়করাও ভিনড়ব। হিন্দুদের নায়ক মুসলমানদের শত্র“; তেমনি মুসলমানদের বীর হিন্দুদের কাছে খলনায়ক। এসব কারণে মুসলমান এবং হিন্দু কেবল স¤প্রদায় নয়, তারা দু’টি পৃথক সত্তা, পৃথক জাতিগোষ্ঠী। এ তত্তে¡র সমর্থনে জন্নিাহ বলেন, ‘ইসলাম ও হিন্দুদের প্রকৃত স্বরূপ কেন আমাদের হিন্দু বন্ধুরা বুঝতে পারে না, এটা আমি বুঝি না। ইসলাম ও হিন্দুবাদ শুধু ধর্ম নয়; প্রকৃতপক্ষে দু’টি স্বতন্ত্র ও সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা।’
১৯৪০ সালের ২২ মার্চ জিন্নাহ নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনে তাঁর সভাপতির ভাষণে দ্বি-জাতি তত্তে¡র ভাবধারা বিশেষণ করে বলেন যে, হিন্দু ও মুসলমানরা দু’টি পৃথক ধর্মীয় দর্শনের, সামাজিক আচারের এবং সাহিত্যের অধিকারী। তাদের সভ্যতা আলাদা এবং পরস্পরবিরোধী চিন্তা ভাবনা ও ধারণাকে আশ্রয় করে তাদের সভ্যতা গড়ে উঠেছে। জীবনের প্রতি এবং জীবন সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। হিন্দু ও মুসলমান স¤প্রদায় অনুপ্রেরণা লাভ করে ভন্নি ভন্নি ইতিহাস থেকে। একটি ধর্মীয় স¤প্রদায় সংখ্যালঘু এবং অপরটি সংখ্যাগুরু। কাজেই এ ধরনের দুটো জাতিকে এক জোয়ালে বাঁধলে তা μমান্বয়ে অসন্তোষ বৃদ্ধি করবে এবং শেষ পর্যন্ত ধ্বংস ডেকে আনবে। জিন্নাহ জোর দিয়ে বলেন যে, “যে কোন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী মুসলমানরা একটা জাতি। তাই তাদের একটা পৃৃথক আবাসভূমি প্রয়োজন, প্রয়োজন একটা ভূ-খণ্ডের এবং একটা রাষ্ট্রের।” (By any international standard the Muslims are a nation. So they are in need of a separate homeland, a territory and a state.)
জিন্নাহ তার দ্বি-জাতি তত্তে¡র পক্ষে ঘোষণা দেন যে, ভারত কখনও ঐক্যবদ্ধ ছিল, এক জাতি ছিল এটা ধারণা করা ঠিক নয়। তিনি বলেন :
“বারশো বছরের ইতিহাসে ভারত ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি, বরং দেখা গেছে, যুগের পর যুগ ভারত সর্বদা হিন্দু ভারত এবং মুসলিম ভারত এ দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। ভারতের বর্তমানের কৃত্রিম ঐক্য ব্রিটিশের অবদান। ব্রিটিশের বিজয় এ ঐক্য সাধন করেছে এবং ব্রিটিশ বেয়নেটের জোরেই এ ঐক্য বজায় রয়েছে। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের অবসানের সাথে সাথে সমগ্র ভারতের ভাঙ্গনের সূচনা হবে এবং বিগত এক হাজার বছরের মুসলিম শাসনে যে বিপর্যয় কখনো ঘটেনি সেই বিপর্যয় ঘটবে।”
. দ্বি-জাতি তত্তে¡র সমালোচনা :
জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত¡ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিকগণদের দ্বারা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। তাদের মতে, মুসলমানরা একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়; জাতি নয়। জাতি গঠনের প্রধান উপাদানসমূহ হলো : ভাষা, ভূ-খন্ডগত ঐক্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস ঐতিহ্য, খাদ্যাভাস, ধর্ম, মানসিক চেতনা প্রভৃতি। ধর্ম জাতি গঠনের অনেকগুলো উপাদানের মধ্যে একটি। শুধু ধর্মের ভিত্তিতে জাতি গঠিত হতে পারে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, ভারতের সমস্ত মুসলমানদের ভাষা এক নয়, তাদের মধ্যে ভূ-খণ্ডগত ঐক্যও নেই। ইতিহাসে কোনদিন উত্তরপশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল বা সিন্ধুর সঙ্গে বাংলা প্রদেশ একত্রিত ছিলো না। কাজেই কেবল ধর্মের ভিত্তিতে একটি কৃত্রিম রাষ্ট্রগঠন ঠিক হবে না। এ ধরনের রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নিয়ে তখনই অনেকে সন্দেহ পোষণ করেছিলেন। সত্যিকার অর্থে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের মধ্য দিয়ে জিনড়বাহর দ্বি-জাতি তত্তে¡র অসারতা প্রমাণ হয়েছে। প্রমাণ হয়েছে, মুসলমানরা একটি বৃহৎ ধর্মীয় সম্প্রদায়, জাতি নয়।
ঝ) ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের পটভূমি :
নেহেরু রিপোর্ট এবং জিনড়বাহর চৌদ্দ দফা ঘোষিত হবার পর ভারতের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা আরো প্রকট আকার ধারণ করে। হিন্দু মসলমানের সাম্প্রদয়িক সম্প্রীতির চরম অবনতি ঘটে। এমনি এক পরিস্থিতিতে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আইন অমান্য আন্দোলন (১৯৩০- ৩২) শুরু হয়। সামগ্রিকভাবে সাইমন কমিশনের সুপারিশ, নেহেরু রিপোর্ট, জিনড়বাহর চৌদ্দ দফা, আইন অমান্য আন্দোলন, লন্ডনের গোল টেবিল বৈঠক, পুণাচুক্তি, সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ- ১৯৩৫ সালে ঘোষিত ভারত শাসন আইনের পটভূমি হিসাবে কাজ করেছে।

ঞ) ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন :

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ভারতের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে এক গুররুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে। বস্তুতঃ ভারতীয় জনগণের মধ্যে জাতীয়তা যাদের উন্মেষ, রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ এবং ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের ব্যর্থতার ফলশ্রতি হলো ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন। এ শাসনব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রয় পদ্ধতি, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও দায়ত্বিশীল সরকার ব্যবস্থা কার্যকরের ব্যবস্থা রাখা হয়। মূলতঃ এ আইনই পরবর্তীকালে ১৯৪৭ সালের ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের মূলভিত্তি রচনা কারে।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের মূলধারাসমূহ :

১। সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠন - ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে ভারতে সর্বপ্রথম একটি সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র (All
Indian Federation) গঠনের প্রস্তাব করা হয়। বিট্রিশ ভারতীয় প্রদেশ এবং মিত্র রাজ্যসমূহের সমন্বয়ে এ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব ছিল।

২। প্রাদেশিক স্বায়ওশাসন - ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন প্রদেশগুলোকে স্বায়ওশাসন (Autonomy to the provinces) প্রদান করে। এর মাধ্যমে প্রদেশগুলো সুনির্ধারিত ক্ষমতা প্রাপ্ত হয় এবং প্রদেশসমূহে দায়িত্বশীল সরকার প্রবর্তিত হয়। প্রাদেশিক সরকার ও পরিষদের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ সীমিত করা হয়। প্রাদেশিক গভর্নর ও মন্ত্রিপরিষদকে প্রাদেশিক আইনসভার নিকট দায়ী করা হয়। এতদিন পর্যন্ত প্রাদেশিক গভর্নরগণ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিরূপে কাজ করতেন। কিন্তু এ আইনের মাধ্যমে তাঁরা ব্রিটিশ রাজের (Brithish Crown) প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি হন।

৩। কেন্দ্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভা গঠন - এ আইনের মাধ্যমে কেন্দ্রে একটি যুক্তরাষ্ট্রয় আইনসভা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ আইনসভা দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট হবে বলে স্থির করা হয়। উচ্চকক্ষকটি রাষ্ট্রসভা (Council of State) এবং নিমড়বকক্ষটি ব্যবস্থাপক পরিষদ (House of Assembly) বলে অভিহিত হবে। এ ছাড়া এ আইন অনুসারে সর্বমোট এগারটি গভর্নর শাসিত প্রদেশের মধ্যে ছয়টিতে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা এবং বাকী পাঁচটিতে এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তিত হয়।

৪। দীর্ঘ ও জটিল সংবিধান - ১৯৩৫ সালের সংবিধানে ৪১টি বিভাগ (Part), ১০টি তালিকা (ঝপযবফঁষব) এবং ৩০০টি বিধি (Schedule) ছিল। অত্যন্ত জটিল ধরনের একটি যুক্তরাষ্রীয শাসনব্যবস্থার বিস্তারিত বর্ণনা এবং ভারতীয় মন্ত্রীপরিষদ ও আইনসভাসমূহের ক্ষমতা সীমিতকরণের উদ্দেশ্য বিভিনড়ব প্রকারের আইনগত রক্ষাকবচ সংযোজনের ফলে এই সংবিধান দীর্ঘ এবং জটিল হয়ে পড়ে।

৫। দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান -
এই আইনে শাসনসংμান্ত বিষয়গুলিকে একমাত্র ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এর সংশোধন করার অধিকার ছিল। ফলতঃ সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয় রূপ পায়।

৬। ক্ষমতাবণ্টন -এই আইনে শাসন সংμান্ত বিষয়গুলিকে তিনভাগে বিভক্ত করা হয়। এগুলো হচ্ছে-(১) কেন্দ্রীয় বিষয়, (২) প্রাদেশিক বিষয় এবং (৩) যুগ্ম বিষয়। কেন্দ্রে মোট ৫৯টি বিষয় ছিল, যেমন- বৈদেশিক বিষয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, ডাক তার ও রেল বিভাগ, ব্যাংক, মুদ্রা, তথ্যদপ্তর, আয়কর, দেশরক্ষা, ফেডারেল পাবলিক সার্ভিস কমিশন, অস্ত্রাগার ইত্যাদি। প্রদেশে ৫৪টি বিষয় ছিল। যেমন-আইন-শৃঙখলা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুলিশ, কারাগার, কৃষি, ভূমিরাজস্ব, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন, বন, প্রাদেশিক পাবলিক সার্ভিস কমিশন, কৃষি, আয়কর, বাণিজ্য, ঔষধ ও মাদক দ্রব্যের উপর কার ধার্য্য ইত্যাদি। যুগ্ম তালিকায় ৩৬টি বিষয় বিষয় ছিল।

৭। কেন্দ্রে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা চালু - ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন, ১৯১৯ সালের প্রদেশসমূহে প্রবর্তন দ্বৈত-শাসন ব্যবস্থা রহিত করে। তবে এটি কেন্দ্রে পুনরায় দ্বৈত-শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয়সমূহকে সংরক্ষিত (Reserved) এবং হন্তান্তরিত (Transferred) এ দুই ভাগে ভাগ করা হয়। দেশ রক্ষা, বৈদেশিক সর্ম্পক, ধর্মীয় বিষয় এবং উপজাতি অধ্যুষিত এলাকার শাসনভার সংরক্ষিত বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। সংরক্ষিত বিষয়গুলো গভর্নর জেনারেল তাঁর ইচ্ছাধীন ক্ষমতার বলে পরিচালনা ও কার্যকর করবেন আর হন্তান্তরিত বিষয়গুলো গভর্নর জেনারেল আইন পরিষদের নিকট দায়ী মন্ত্রী সভার পরামর্শμমে পরিচালনা করবেন।

৮। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন -এই আইনে প্রদেশসমূহে দ্বৈত-শাসন রহিত করা হয় এবং স্বায়ত্তশাসন ও দায়িত্বশীল সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়। প্রাদেশিক বিষয়সূহের উপর প্রদেশের কর্তৃত্ব স্বীকার করা হয়। প্রাদেশিক মন্ত্রিসভাকে আইনসভার নিকট দায়ী বা জবাবদিহি করার বিধান রাখা হয়।

৯। যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত - এই আইনে একটি ফেডারেল কোর্ট বা যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত গঠন করা হয়। একজন প্রধান বিচারপতি ও অন্য দুজন বিচারক নিয়ে এই আদালত গঠিত হয়। এই আদালতের হাতে সংবিধান ব্যাখ্যার ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়। তবে ব্রিটিশ ‘প্রিভি কাউন্সিল’ সর্বোচ্চ আপীল আদালত হিসেবে থেকে যায়।

১০। নতুন প্রদেশ গঠন - এই আইনে দ্বারা সিন্ধু ও উড়িষ্যা নামে দুটি নতুন প্রদশে সৃষ্টি করা হয়।

১১। বার্মার পৃথকীকরণ - এই আইনে বার্মাকে (মায়ানমার) ভারতবর্ষ থেকে পৃথক করা হয়।

১২। এই পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা আইন দ্বারা পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু রাখা হয়। কেন্দ্রীয় আইনসভার এক-তৃতীয়াংশ আসন মুসলমানদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। এই আইনে সাধারণ আসনগুলোতে তফসিলভুক্ত নিমড়ববর্ণের হিন্দুদের জন্য কিছু সংখ্যক আসন সংরক্ষিত রাখা হয়।

১৩। শাসন বিভাগের প্রাধান্য - গভর্নর জেনারেল ও গভর্নদেরকে কতকগুলো বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করায় আইনসাভার উপর শাসনবিভাগের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। গভর্নর জেনারেল আইনসভা প্রণীত আইনে ‘ভেটো’ প্রয়োগ করতে পারতেন।

ট) ১৯১৯ ও ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের তুলনামূলক আলোচনা :

ভারতর্বষে ব্রিটিশ ঔপনিবোশিক শক্তি সুদীর্ঘ দু’শো বছরের শাসনামলের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের সংস্কারুমূলক আইন প্রণয়ন করেছে। এগুলোর মূল লক্ষ্য ছিলো ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকে সুদৃঢ় করা। ভারতবাসীর রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা কিংবা ভারতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এসব আইনের উদ্দেশ্য ছিলো না। তথাপি ভারতীয়দের আন্দোলন ও রাজনৈতিক সংগ্রামের কারণে ঔপনিবেশিক শক্তি পর্যায়μমে ভারতীয়দের কিছু রাজনৈতিক অধিকার প্রদান করে। সেই বিবেচনায় ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন অপেক্ষা ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন যথেষ্ট উন্নত ছিলো।
তবে ১৮৬১ সাল থেকে শুরু করে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত যে কটি আইন পাশ করা হয়েছে তন্মমধ্যে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ। নম্নিে দুই আইনের তুলনামূলক আলোচনা করা হলো-

(১) সরকারের প্রকৃতি - ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন ব্রিটিশ ভারতে এককেন্দ্রিক সরকার (টহরঃধৎু এড়াবৎহসবহঃ) প্রবর্তন করে। ফলে সরকারের সমুদয় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। পক্ষান্তরে, ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন যুক্তরাষ্ট্রীর ব্যবস্থার প্রবর্তন করে। এ আইন ব্রিটিশ ভারতের প্রদেশসমূহ এবং দেশীয় রাজ্যগুলোর (ঘধঃরাব ঝঃধঃবং) সমন্বয়ে একটা সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র (অষষ ওহফরধ ঋবফবৎধঃরড়হ) গঠনের প্রস্তাব করে।

(২) প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন - ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন কোন প্রকার প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেনি। প্রাদেশিক গভর্নরগণ শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিরূপপে কাজ করতেন। কিন্তু ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন প্রদেশগুলোকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে। ফলে প্রদেশগুলো সুনির্ধারিত ক্ষমতা লাভ করে। প্রদেশগুলোতে দায়িত্বশীল সরকার প্রবর্তিত হয়। প্রাদেশিক সরকার ও আইন পরিষদের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ সীমিত করা হয়। প্রাদেশিক গভর্নর ও মন্ত্রিপরিষদকে প্রাদেশিক আইনসভার নিকট দায়ী করা হয়।
(৩) সরকারী বিষয়াবলী বিভক্তি - ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন সরকারী বিষয়গুলোকে দু’ভাগে ভাগ করে দেয়, যথাঃ কেন্দ্রীয় তালিকাভূক্ত বিষয়সমূহ এবং প্রাদেশিক তালিকাভূক্ত বিষয়সমূহ। সরকারের কেন্দ্রীয় বিষয়গুলোকে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে এবং প্রাদেশিক বিষয়গুলোকে প্রাদেশিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করা হয়। এতে করে যুক্তরাষ্ট্রীয় ও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের আংশিক প্রবর্তন লক্ষ্য করা যায়। পক্ষান্তরে ১৯৩৫ সালের আইনে শাসন সংμান্ত বিষয় তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়।

(৪) দ্বৈতশাসন - ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন প্রদেশে দ্বৈতশাসন (উুধৎপযু) ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল, কিন্তু তা সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে সক্ষম হয়নি। বরং বলা চলে যে, তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। এ অবস্থা অবলোকন করে ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে প্রদেশে দ্বৈত-শাসন রহিত করে কেন্দ্র দ্বৈত-শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করে। প্রশাসনে গতি আনয়ন করাই ছিল এর লক্ষ্য।

(৪) দায়িত্বশীল সরকার- ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে প্রদেশগুলোতে দায়িত্বশীল সরকার প্রবর্তন করা হয়; তবে দায়িত্বশীল শাসনের ক্ষেত্র ছিল অত্যন্ত সংকীর্ণ। বস্তুর এ আইন কেন্দ্রে দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার কোন উদ্দোগ গ্রহণ করেনি। কিন্তু ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন দ্বারা কেন্দ্রে দায়িত্বশীল সরকারের ব্যবস্থা করা হয়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিগণ আইনসভার কাছে দায়ী ছিলেন; আইনসভার আস্থা হারালে মন্ত্রিগণ পদত্যাগ করতে বাধ্য থাকতেন। ১৯১৯ সালের আইনের অধীনে এরূপ দায়িত্বশীলতার কোন ব্যবস্থা ছিল না। পক্ষান্তরে ১৯৩৫ সালের আইনের মাধ্যমে শুধু কেন্দ্রেই নয় প্রদেশগুলোতেও দায়িত্বশীল সরকার প্রবর্তনের ব্যবস্থা গৃহীত হয় যদিও তা যথাযথভাবে কার্যকর হয়নি।

(৬) আইন সভার গঠন প্রকৃতি - ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে প্রদেশগুলোতে এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার (টহরপধসবৎধষ খবমরংষধঃঁৎব) ব্যবস্থা করা হয়। ফলে প্রাদেশিক আইনসভা এক স্বেচ্ছাচারে পরিণত হয়। এ স্বেচ্ছাচারিতা রোধকল্পে ১৯৩৫ সালের আইনের অধীনে অধিকাংশ প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলোকে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট করা হয়। এতে প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলো এককক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা থেকে মুক্ত হয়।

(৭) যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত - ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত (ঋবফবৎধষ ঈড়ঁৎঃ) প্রতিষ্ঠার কোন ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। কিন্তু ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে ভারতে একটা যুক্তরাষ্ট্রীয় বিচারলয় প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের বিভিনড়ব ধারা ও উপধারা বিশ্লেষণ এবং বিভিনড়ব সরকারের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসা করাই ছিল এ আদালতের প্রধান কাজ।

(৮) জনগণের ভোটধিকার - ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনে জনগণের ভোটাধিকার ছিল অত্যন্ত সীমিত। কিন্তু ১৯৩৫ সালের আইন দ্বারা ভোটাধিকার আরো প্রশস্ত ও বিস্তৃত করা হয়। ফলে ভোটারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় বহুগুণে। প্রাশাসন ব্যবস্থায় জনগণ পূর্বের চেয়ে অধিক পরিমাণে অংশ গ্রহণের সুযোগ লাভ করে।

(৯) ভারত সচিবের ক্ষমতা - ১৯১৯ সালের ভারত আইনের অধীনে ভারতে সেμেটারী অব স্টেট (ঝবপৎবঃধৎু ড়ভ ঝঃধঃব ভড়ৎ ওহফরধ) যথেষ্ট ক্ষমতা ভোগ করতেন। প্রয়োজনবোধে তিনি প্রাদেশিক শাসন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারতেন। কিন্তু ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ভারতের সেμেটারী অব্ স্টেটের ঐতিহাসিক কাউন্সিলের বিলপ্তি ঘটায় এবং এর স্থলে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমাতা সম্পনড়ব একটা উপদেষ্টা সংস্থা (অফারংড়ৎু ঈড়ঁহপরষ) গঠন করে।

উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ১৯১৯, সালের ভারত শাসন আইন অপেক্ষা যথেষ্ট উননত ছিল ৷ (চলব)ে ৷

ফারহানা আকতার

তথ্যসূত্র : বুকস্ , ইন্টারনেট ৷
লেখক: ফারহানা আকতার, ডিরেক্টর এন্ড এ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, ইন্টারন্যাশনাল রবীন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কলামিস্ট, কথাসাহিত্যিক এবং সহ-সভাপতি, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ ৷

লেখকের অন্যান্য বই

বাংলাদেশ সময়: ২৩:৩৮:৩৩   ৭৩৯ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

সাহিত্য’র আরও খবর


সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন: স্বপন চক্রবর্তী
ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা “আমি তো গাঁয়ের মেয়ে ”
৫০ বছরের গৌরব নিয়ে জাবির বাংলা বিভাগ বিশাল ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ উৎসব আয়োজন করেছে
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা- ‘তোমার খোঁজে ‘
অতুলপ্রসাদ সেন: ৩য় (শেষ ) পর্ব-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন;পর্ব ২-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন-স্বপন চক্রবর্তী
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা ” যাবে দাদু ভাই ?”
বাদল দিনে- হাসান মিয়া
ইমাম শিকদারের কবিতা ‘ছোট্ট শিশু’

আর্কাইভ