২৭. ভারত ভাগ (উপমহাদেশের বিভাজন ) -১৯৪৭–বর্তমান :
ভারতে ব্রিটিশ শাসন দীর্ঘায়িত হওয়া ও ধর্মভিত্তিক জাতিয়তাবাদী আন্দোলন বিকাশের পেছনে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের অসম বিকাশ নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টির পেছনে শুধু যে ঔপনিবেশিক শক্তি দায়ী ছিল তা’ নয়, ধর্মীয় চেতনাও রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত উভয় সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক নেতাদেরও ভূমিকা ছিল। প্রাক-ব্রিটিশ শাসনামলে হিন্দু ও মুসলিম শাসকদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিভিনন সময়ে যুদ্ধ সংঘটিত হলেও এই সকল যুদ্ধ কখনো সাম্প্রদায়িক সংঘাত তৈরী করেনি। মুসলমান শাসকেরা গুরত্বপূর্ণ রাজকীয় আসনে অনেক হিন্দু ব্যক্তিদেরকে নিযুক্ত করেছিলেন। বাংলা ও সংস্কৃত ভাষা-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। একইভাবে হিন্দু শাসকেরা মুসলমানদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এমনকি ব্রিটিশ শাসনের শুরুতে ভারতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় ছিল। মনে রাখতে হবে যে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করে এমন সব উপাদানকে ব্যবহার করে বিভেদ সম্প্রসারণে ইন্ধন জুগিয়েছে।
মূল কথা হলো যে, জাতীয় জীবনে ভারতরে স্বার্থের পরিবর্তে হিন্দু বা মুসলিম স্বার্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন ৷এই ধরণের সংকীর্ণতাবাদী চিন্তা ভাবনার বিকাশ সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির পেছনে কাজ করলেও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের ‘ভাগ কর শাসন কর নীতি’ মূল ভ‚মিকা পালন করেছিল। মূলত: এই অংশটকিে আমরা নম্নিোক্ত ভাগে ভাগ করে আলোচনা করে নবেো : ১. ভারতে ব্রিটিশ সরকারের “ভাগ কর শাসন কর নীতি” ও সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার
, ২. ১৯৪৭-ভারত ভাগ (উপমহাদেশের বিভাজন ), ৩.বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে (১৯৪৭-১৯৭১) রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, ৪.ভাষা আন্দোলন, ৫.১৯৫৪ সালের নির্বাচন ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ ,৬.সামরিক শাষন ও স্বাধিকার আন্দোলন (১৯৫৮-১৯৬৯), ৭.ছয়দফা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ৮.সত্তরের নির্বাচন, ৯. মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১০.বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অবদান, ১১.স্বাধীন বাংলাদেশের অভূ্্যদয় (যদিও এই পয়েণ্টগুলো বিছিন্ন ভাবে পূর্বের পর্বগুলোতে আলোচনা করা হয়েছে এবং সেকারনে এই অংশটিতে শুধু যে বিষয়গুলো পূর্বের পর্বগুলোতে আলোচিত হয়নি, শুধুমাত্র সে বিষয়গুলো আলোচিত হবে )৷
১.ভারতে ব্রিটিশ সরকারের “ভাগ কর শাসন কর নীতি” ও সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার :
ভারতে ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ বজায় রাখার জন্য ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার করার জন্য “ভাগ কর শাসন কর নীতি”-কে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। ধর্মীয় ভিত্তিতে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্য ব্রিটিশ সরকার যে সকল পদক্ষেপ নিয়েছিল তার মধ্যে ১৯০৫ সালের ‘বঙ্গ ভঙ্গ’ ও ১৯০৯ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা ও প্রাদেশিক আইন পরিষদে আসন সংরক্ষণ এবং ১৯৩২ সালের ’সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ’ হিন্দু-মুসলমান সর্ম্পকের ব্যাপক অবনতি ঘটায়।
১৯০৩ সালে লর্ড কার্জন বাংলাকে বিভক্ত করে পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করার প্রস্তাব করেন। ঢাকাকে নতুন প্রদেশের রাজধানী করে ১৯০৫ সালে ‘বঙ্গ ভঙ্গ’ প্রস্তাব কার্যকর করা হয়। বাংলা বিভক্তিকে তারা ‘মাতৃভ‚মির অঙ্গচ্ছেদ’ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রগতিশীল বাঙ্গালী ও হিন্দু সম্প্রদায় এর বিরোধীতা করে বাংলার শহরে ও গ্রামে আন্দোলন শুরু করে। ‘বঙ্গ ভঙ্গ’ বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এক নতুন রাজনৈতিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। অবশেষে আন্দোলনের মুখে ঔপনিবেশিক সরকার ১৯১১ সালে ‘বঙ্গ ভঙ্গ’ বাতিল করে। ‘বঙ্গ ভঙ্গ’ ও বঙ্গ ভঙ্গ রদ-কে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমান সর্ম্পকের ব্যাপক অবনতি ঘটে। ইতোমধ্যে স্বদেশী বয়কট আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের গঠনা ঘটে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’ প্রবন্ধ থেকে জানা যায় যে, পূর্ববঙ্গেও গ্রামাঞ্চলে স্বদেশীরা অনিচ্ছুক দরিদ্র মুসলমানদের উপর জোর করে বয়কট আন্দোলন চাপিয়ে দিলে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করে। এই সাম্প্রদায়িক বিভেদ শেষ পর্যন্ত হিংসাতড়বক রুপ লাভ করেছিল।
১৯১৯-২১ সালের খেলাফত আন্দোলনের পরিণতিতে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছিল। পরবর্তীতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র দ্বি-জাতি তত্বের উপর ভিত্তি করে সাম্প্রদায়িক সংঘাত আরো বৃদ্ধি পায়। অবশেষে ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতি তত্বের উপর ভিত্তি করে ভারত বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান-দুটি নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়।
১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন অনুযায়ী পাকিস্তানে একটি কেন্দ্রীয় আইন সভা ও প্রত্যেকটি প্রদেশে একটি করে আইন সভা ছিল। প্রাদেশিক সরকাগুলি গঠিত হয়েছিল ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ শাসন আমলে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্ট্রির পর বাঙ্গালী জনগণের উপর বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপর যে শাসন ও শোষণ চলতে থাকে তারেই অংশ হিসেবে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হয়।
প্রকৃতপক্ষে, ১৯০৫ ও ১৯৪৭ বঙ্গভঙ্গ (Partition of Bengal):
বাংলার রাজনৈতিক ভূগোলে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন । ১৯০৫ ও ১৯৪৭ সালের বঙ্গভঙ্গ ভারত বিভক্তির ফলশ্রুতিতে সম্পন্ন হয়। এর ফলে বঙ্গ প্রদেশ দুই অংশে বিভক্ত হয়ে পরে যার পূর্বাঞ্চল পাকিস্তানে যার নাম পূর্ব-বঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান রাখা হয় এবং যা পরবর্তীতে যুদ্ধের মাধ্যমে একটি ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করে এবং পশ্চিমাঞ্চল ভারতের সাথে যুক্ত হয় যার নাম পরবর্তীতে পশ্চিম-বঙ্গ (অর্থাৎ বর্তমান কলকাতা) রাখা হয় । (চলবে)৷
তথ্যসূত্র : বুকস্ , ইন্টারনেট ৷
লেখক: ফারহানা আকতার, ডিরেক্টর এন্ড এ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, ইন্টারন্যাশনাল রবীন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কলামিস্ট, কথাসাহিত্যিক এবং সহ-সভাপতি, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ ৷
বাংলাদেশ সময়: ১৩:৪৩:৪৮ ৮৫৭ বার পঠিত