ঙ. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতবর্ষ হতে ইংরেজদের হঠাও নীতি : ১৯০৫ সালের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অর্থাৎ ১৯৪৫ সালে ভারতবর্ষ জুড়ে “ইংরেজ ভারত ছাড়” আন্দোলন তীব্রতর হয়। কিন্তু ভারতবর্ষের তৎকালীন নেতা ‘মহাত্বা গান্ধী’ সহ সব বড় বড় নেতা তখন সরাসরি ইংরেজদের হটাও আন্দোলনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন ৷
মহাত্বা গান্ধীর দিক থেকে তাঁর “অহিংসা মনোভাব” এর কারণে হয়ত আন্দোলন বেগবান হচ্ছিল না। গান্ধীজীর মতে “যখন আমি হতাশ হই , আমি স্মরণ করি সমগ্র ইতিহাসেই সত্য ও ভালবাসার জয় হয়েছে । দুঃশাসক ও হত্যাকারীদের কখনো অপরাজেয় মনে হলেও শেষ সবসময়ই তাদের পতন ঘটে মনে রাখবেন ।” অপরদিকে নেতাজী ‘সুভাষ চন্দ্র বসু’ -এর বক্তব্য ছিল,”তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব”।
‘নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু’ ও ‘মহাত্বা গান্ধী’ –উভয়ের চাওয়া ও স্বপ্ন এক ও অভিন্ন ( অর্থাৎ ভারতের স্বাধীনতা লাভ) হলেও নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু- মহাত্বা গান্ধী-এর এই অহিংসা মনোভাব পছন্দ করতেন না। উনি চাইতেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এবং সেটা হবে সমর যুদ্ধ। তাই তিনি খুঁজছিলেন ঠিক সেই মুহুর্তে ইংরেজদের বিরুদ্ধে কোন পরাশক্তি আছে কীনা। সেই হিসেবে সে খুঁজে পান জামার্নীকে আর ইংল্যান্ড তো তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র বাহিনী। আর তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতবর্ষের অংশগ্রহনটা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ভালো ভাবে নেননি। তিনি হিটলারের কাছেগেলেন।
কিন্তু সেই মুহুর্তে হিটলার প্রচন্ড ব্যাস্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে। তাই নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু অক্ষশক্তির আরেক শক্তিশালী রাষ্ট্র জাপানের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। এসময় জার্মান তাকে একটি সাবমেরিনে করে জাপানে পৌছে দেয়। জাপান-সরকার নেতাজীর পরিকল্পনা শুনে, এতে মত দেয় এবং প্রয়োজনীয় অর্থ ও সমরাস্ত্র দিয়ে তাকে ও তার বাহিনীকে সাহায্য করে।
রাসবিহারী বসুর কাছ থেকে আজাদ হিন্দু ফৌজের দায়িত্ব নিয়ে ভারত আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেন। ‘আজাদ হিন্দু ফৌজ’ মূলতঃ ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা গঠিত একটি সশস্ত্র সেনাবাহিনী। ১৯৪২ সালে এই বাহিনী গঠিত হয় । এর বাহিনী ভিতরে ভারতের স্বাধীনতাকামী মানুষ, ইংরেজ নির্যাতিত ভারতীয়, মুটে ও মজুর ছিল এবং এই বাহিনী পরিচালনা করতেন ‘নেতাজী সুভাষ চণ্দ্র বসু’। আধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও অর্থের অভাব থাকলেও নেতাজী সুভাসের অসাধারণ নেতৃত্বের ফলে প্রায় ৬০ হাজার সৈন্যের সমন্বয়ে একটি সুশৃঙ্খল দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী গড়ে ওঠে।
জাপানী সহায়তায় বলীয়ান হয়ে এই বাহিনী ভারতের উত্তর-পূর্ব দিক থেকে ভারতকে আক্রমন করে। (এখানে একটা বির্তক আছে যে, কেন সে সময় নেতাজী একজন ভারতীয় হয়ে ভারতকে আক্রমন করলো? আসলে তখন তার এই বিশাল আক্রমন ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে কিন্তু ইংরেজরা এ ঘটনায় তখন নেতাজীকে দেশদ্রোহী বলে আখ্যা দেয় ৷এই কারনে, তখন ‘মহাত্মা গান্ধী’ এর সঙ্গে ‘নেতাজী’ সামান্য মন-মালিন্য হয় )৷
জাপানের সহায়তায় ‘আজাদ হিন্দু ফৌজ’ অতর্কিত আক্রমনে ভারতে ইংরেজরা কিছুটা হলেও নড়বড়ে হয়ে যায়। এক যুদ্ধের ভিতরে আরেক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ভারতের আরাকান, ইম্ফল, ময়রাং, বিষেণপুর প্রভৃতি স্থান ‘নেতাজী সুভাষ চন্দ্র’ দখল করে নেন। এসব দখলকৃত জায়গা পুনরুদ্ধারের জন্য ব্রিটেনের নেতৃত্বে মিত্র বাহিনী মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা যুদ্ধবিমান ও কামান নিয়ে আক্রমণ শুরু করে। ঠিক এই মুহুর্তে নেতাজীর দল একটু পিছপা হয়ে পড়ে। তখন তারা রেঙ্গুনে গিয়ে আবারো পুর্নগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে। কয়েক মাস ব্যাপী এ যুদ্ধে মারা যায় উভয় পক্ষের অনেক সৈন্য। কিন্তু ঠিক এই মূহুর্তে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় পরাজিত হয় অক্ষ বাহিনী। তাই জাপানের আত্মসমাপর্নের ফলে বন্ধ হয়ে যায় ‘আজাদ হিন্দু ফৌজ’ এর রসদ সরবরাহ। তারপর থেকে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু নিখোঁজ হন। কথিত আছে ১৯৪৫ সালের ১৮ অগস্ট তাইওয়ানে একটি বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। (তবে তাঁর এই দুর্ঘটনায় মৃত্যু নিয়েও বির্তক আছে অর্থাৎ অনেকেই মনে করেন, এ ঘটনা সত্য নয় কারন, তখন তার মৃতদেহ কোথাও পাওয়া যায়নি কিংবা ভারতবর্ষে আনা হয়নি )৷
চ.বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনঃ
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন ছিল ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল সংঘটিত ‘মাষ্টারদা সূর্য সেন’ (যিনি ছিলেন এ অঞ্চলের ব্রিটিশ-বিরোধী নেতা)-এর নেতৃত্বে কয়েকজন স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীর ব্রিটিশ পুলিশ ও সহায়ক বাহিনীর চট্টগ্রামে অবস্থিত অস্ত্রাগার লুন্ঠনের প্রয়াস।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের সাথে জড়িত ছিলেন তত্কালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী অসীমসাহসী বিপ্লবীরাও। এই বিপ্লবীদের নেতৃত্বে ছিলেন মাষ্টারদা সূর্য্যসেন। সূর্য সেন ছাড়াও এই দলে ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নরেশ রায়, শশাঙ্ক দত্ত, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হরিগোপাল বল, তারকেশ্বর দস্তিদার, অনন্ত সিং, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্ত এবং নারী-নেত্রী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও কল্পনা দত্ত। এদের সাথে সুবোধ রায় নামক ১৪ বছরের এক বালকওছিলেন।
সূর্য সেনের পরিকল্পনা ছিল চট্টগ্রাম শহরের অস্ত্রাগার দুটো লুট করা, এরপর টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিস ধ্বংস করা এবং এরপর সরকারী ও সামরিক বাহিনীর অফিসারদের ক্লাব ইউরোপিয়ান ক্লাবে হামলা চালানো। এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিলো ব্রিটিশদের অস্ত্রশস্ত্র লুট করা এবং রেল ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্নরূপে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া।
অভিযান শুরু হয় ১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল, রাত দশটায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী গণেশ ঘোষের নেতৃত্বে একদল ব্রিটিশ-বিরোধী বিপ্লবী পুলিশ অস্ত্রাগারের এবং লোকনাথ বাউলের নেতৃত্বে দশজনের একটি দল সাহায্যকারী বাহিনীর অস্ত্রাগারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা গোলাবারুদের অবস্থান শনাক্ত করতে ব্যর্থ হন। বিপ্লবীরা সফলভাবে টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হন এবং রেল চলাচল বন্ধ করে দেন। ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’ , চট্টগ্রাম শাখা (যারা মূলতঃ এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ-বিরোধী বিপ্লবী ) - এই নামের অধীনে সর্বমোট ৬৫ জন বিপ্লবী এই বিপ্লবে অংশ নেন। সফল বিপ্লবের পর বিপ্লবী দলটি পুলিশ অস্ত্রাগারে সমবেত হন এবং সেখানে ‘মাস্টারদা সূর্য সেন’কে মিলিটারী স্যালুট প্রদান করা হয়। সূর্য সেন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার ঘোষণা করেন। রাত ভোর হবার পূর্বেই বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম শহর ত্যাগ করেন এবং নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে যাত্রা করেন।
মূলতঃ এভাবেই ‘ভারত’ একটি স্বাধীন রাস্ট্র হিসেবে আত্মমর্যাদা লাভ করার পূর্ব পর্যন্ত এ উপমহাদেশে জনগণের সঙ্গে ইংরেজদের বহু রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের ঘটনা ঘটে আসছিল । (চলবে) ৷
তথ্যসূত্র : বুকস্ , ইন্টারনেট ৷
লেখক: ফারহানা আকতার, ডিরেক্টর এন্ড এ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, ইন্টারন্যাশনাল রবীন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কলামিস্ট, কথাসাহিত্যিক এবং সহ-সভাপতি, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ ৷
বাংলাদেশ সময়: ১২:২৩:০৫ ৮৮৪ বার পঠিত #Content loading problem. Please reload/refresh this pag