২৬. ব্রিটিশ ভারত :১৮৫৮ খ্রী:–১৯৪৭খ্রী :
১৪৯৮ সালে ভাস্কো দা গামার সমুদ্রাভিযানের সাফল্য ইউরোপীয়দের সম্মুখে ভারতের এক নতুন পথ উন্মুক্ত করে দেয়। এর ফলে ভারতের সঙ্গে ইউরোপের বাণিজ্যের পথও মসৃণ হয়।এই ঘটনার অব্যবহিত পরেই পর্তুগিজরা গোয়া, দমন, দিউ ও বোম্বাইতে বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে। এরপর বাণিজ্যকুঠি স্থাপন ‘ডাচ ও ব্রিটিশরা’ । ১৬১৯ সালে তারা পশ্চিম উপকূলীয় বন্দর সুরাটে একটি বন্দর স্থাপন করে।সবশেষে আসে ফরাসিরা । ভারতীয় রাজন্যবর্গের অভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণে ইউরোপীয় বণিকদের পক্ষে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ও অঞ্চল দখল সহজ হয়। পরবর্তী শতাব্দীতে দক্ষিণ ও পূর্বভারতের বিভিন্ন এই সকল ইউরোপীয় মহাদেশীয় শক্তিগুলি নিজ আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হলেও, পরবর্তীকালে ব্রিটিশরা তাদের সকল উপনিবেশ দখল করে নিতে সক্ষম হয়। কেবলমাত্র পন্ডিচেরি ও চন্দননগরে ফরাসি কুঠি, ত্রিভাঙ্কুরে ডাচ বন্দর এবং গোয়া, দমন ও দিউয়ে পর্তুগিজ উপনিবেশগুলি রয়ে যায়।
১৬১৭ সালে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গির ‘ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী অর্থাৎ ইংরেজদের’ কে ভারতে বাণিজ্যের অনুমতি দান করেন। ধীরে ধীরে নিজেদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে ১৭১৭ সালে এই কোম্পানি তৎকালীন আইনসম্মত মুঘল সম্রাট ফারুক শিয়রকে দিয়ে বাংলায় রাজস্বমুক্ত বাণিজ্যের দস্তক বা পারমিট আদায় করে নেয়। কিন্তু মুঘল বাংলা প্রদেশের তৎকালীন শাসনকর্তা নবাব সিরাজদ্দৌলা সেসময় তাদের এই পারমিট ব্যবহারে বাধা দেন এবং তিনি কখনই চাইতেন না, ‘ভিনদেশী ইংরেজরা এ উপমহাদেশে বানিজ্যের নামে শাসন করুক’ ৷ ১৭৫৭ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে পলাশীর যুদ্ধে নবাব- সিরাজদ্দৌলার বিজয় সুনিশ্চিত থাকা সত্ত্বেও তাঁর ঘনিষ্ট কিছু আত্মীয়-স্বজন ও তাঁর প্রধান সেনাপতি মীরজাফর- এর সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রের কারনে রবার্ট ক্লাইভ নেতৃত্বাধীন ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাহিনী’ নবাব- সিরাজদ্দৌলার সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে। এই ঘটনা ছিল ব্রিটিশদের ভারত অধিকারের ক্ষেত্রে কোনো অঞ্চল জয়ের মাধ্যমে প্রথম রাজনৈতিক প্রাধান্য স্থাপনের ঘটনা। ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্লাইভকে ‘বাংলার গভর্নর’ নিযুক্ত করে। ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধের পর কোম্পানি মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা শাসনের রাষ্ট্রীয় অধিকার অর্জন করে। এর ফলে কোম্পানির নিয়মতান্ত্রিক শাসনের সূত্রপাত ঘটে। এক শতাব্দীকালের মধ্যেই তারা ভারত থেকে মুঘল সাম্রাজ্য, শিখ সাম্রাজ্য সম্পূর্ণ অবলুপ্ত করে দেশে নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপন করে। ১৭৯৯ সালে ‘নবাব টিপু সুলতান’ নিহত হন ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধে। এ ঘটনার পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার লাভ করেছিল। এর মাধ্যমে তারা ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ নামে এক ভূমিরাজস্ব প্রথা চালু করে। ফলে বাংলায় জমিদারি এক নতুন সামন্ত্রতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। ১৮৫০-এর দশকের মধ্যেই বর্তমান ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সহ ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলেই ব্রিটিশরা নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। তাদের নীতি ছিল ‘বিভাজন ও শাসন-শোষন’ অর্থাৎ বিশ্বের বিভিন্ন দেশীয় রাজ্য, সামাজিক ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পারস্পরিক কলহের সুযোগ নিয়ে তারা বানিজ্য করার নামে সেইসব দেশে প্রবেশ করতো এবং তাদের অধিকার রক্ষার নামে সেইসব দেশের ধন-সম্পত্তিসমূহ জোড়-জবরদস্তি করে নিজেদের নামে নিয়ে আসতো এবং এভাবেই তারা ধীরে ধীরে নিজেদেরকে বিশ্বের ধনী জাতিতে রুপান্তরিত করতে সক্ষম হয় ।
ইংরেজদের পূর্ব-ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, সেইসময় তারা তাদের দল-বল নিয়ে জাহাজে-জাহাজে বিভিন্ন বন্দরে বন্দরে ঘুরে বেড়াতো এবং বিভিন্ন দেশে দেশে বানিজ্যের নামে আস্তানা গেরে সেসব দেশের অভ্যন্তরীন সম্পদসমূহ লুট-তরাজ করে দেশে ফিরে আসতো আর এভাবেই তারা হয়ে উঠেছিল বিশ্বের অন্যতম ধনী জাতি৷ ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনকালে ভ্রান্ত সরকারি নীতির কারণে একাধিক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় । তার মধ্যে কয়েকটি ছিল ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা ভয়ংকর দুটি দুর্ভিক্ষ : ক. ১৮৭৬-৭৮ সালে মহামন্বন্তর (মৃতের সংখ্যা ৬১,০০০,০০ থেকে ১০৩,০০০,০০ জন) ও খ. ১৮৯৯-১৯০০ সালের ভারতীয় মন্বন্তর (মৃতের সংখ্যা ১২৫,০০০,০০ থেকে ১০০,০০০,০০ জন)। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে চিনে তৃতীয় প্লেগ প্যান্ডেমিক রোগের সূত্রপাত ঘটে। এই মহামারী সকল জনবহুল মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং ভারতে প্রায় ১০০,০০০,০০ লোকের প্রাণহানির কারণ হয়। এই সকল মহামারী ও দুর্ভিক্ষ সত্ত্বেও ভারতীয় উপমহাদেশের জনসংখ্যা ১৭৫০ সালে ১,২৫০,০০০,০০ থেকে বেড়ে ১৯৪১ সালে দাঁড়ায় ৩,৮৯০,০০০,০০তে।
ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিষ্ঠুর শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম যে আন্দোলনটি সংগঠিত হয় সেটি ছিল ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ নামে পরিচিত ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ। নানা সাহেব, তাঁতিয়া টোপি, লক্ষ্মীবাই, ২য় বাহাদুর শাহ জাফর এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন৷ এক বছর নৈরাজ্যের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাহিনীর বদলে ব্রিটিশ সৈন্য নিয়োগ করে ব্রিটিশরা বিদ্রোহীদের দমন করতে সক্ষম হন এবং সর্বশেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে ব্রহ্মদেশে নির্বাসিত করা হয় ৷এছাড়াও এসময় ইংরেজরা সর্বশেষ মুঘল সম্রাটের সন্তানদের শিরোচ্ছেদের মাধ্যমে মুঘল বংশকে নির্মূল করেন৷ এরপর ব্রিটিশ রাজশক্তি সকল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে স্বহস্তে তুলে নেয়। ব্রিটিশ সরকার কোম্পানি অধিকৃত ভারতের সকল অঞ্চল নিজের উপনিবেশ হিসেবে শাসন করতে থাকে। অবশিষ্ট অঞ্চলগুলি শাসিত হতে থাকে দেশীয় রাজ্যগুলির শাসনকর্তাদের মাধ্যমে।
ভারতবর্ষে ২০০ বছরের ইংরেজ শোষনের ইতিহাস :
মুলতঃ ইংরেজরা (১৬০৮-১৬১৭) এসময়ে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনকালে সুরাটে প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের অনুমতি পায়। আস্তে আস্তে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে তাদের বিচরণ শুরু হয়। ১৬৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন প্রতিনিধি হিসেবে জেমস হার্ট ঢাকা প্রবেশ করার মধ্য দিয়ে বাংলায় ইংরেজ আগমন শুরু হয়। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাথে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশী যুদ্ধ হয় তাতে বাংলার নবাবের করুন মৃত্যু দিয়ে এই ভুখন্ডে অর্থাৎ ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সূচিত হয়।
এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয় ইংরেজদের পক্ষ থেকে লর্ড ক্লাইভ। এবং তাকে সহায়তা করে নবাব সিরাজের পরিবারের কয়েকজন ও মীরজাফর, উমিচাঁদ, জগত শেঠ সহ অন্যান্য বিশ্বাসঘাতক। বিশ্বাসঘাতকতার পুরষ্কার স্বরূপ মীরজাফর বাংলার নবাব হয় এবং লর্ড ক্লাইভ তত্কালীন ত্রিশ লক্ষ টাকা ও চব্বিশ পরগনার জায়গিরদারি লাভ করে। এর পরে লর্ড ক্লাইভ ইংল্যান্ড চলে যায় আবারো ফিরে আসে ১৭৬৫ সালের মে মাসে এবং ইংরেজ সরকারের গভর্নর নিযুক্ত হন। একজন কেরানী থেকে সে গর্ভনর হয়।
ক. ১০০ বছর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক শোষন :
১৭৬৫ সালের ১লা অগাষ্ট লর্ড ক্লাইভ দিল্লির বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি লাভ করেন। বিহার-ওড়িশার প্রকৃত শাসন ক্ষমতা লাভ করে, নবাবের নামে মাত্র অস্তিত্ব থাকে। ফলে পূর্ব ভারতের এই অঞ্চলে যে শাসন-ব্যবস্থা চালু হয় তা দ্বৈত শাসন নামে পরিচিত। নবাবের হাতে থাকে প্রশাসনিক দায়িত্ব, আর রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের পূর্ণ কর্তৃত্ব পায় কোম্পানি। এতে বাংলার নবাব আসলে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে আর এই সুযোগে কোম্পানির লোকেরা খাজনা আদায়ের নামে অবাধ লুণ্ঠন ও অত্যাচার শুরু করে দেয়। মূলতঃ ১৭৫৭ সাল থেকে ১৮৫৭ সাল এই প্রায় ১০০ বছর ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে ভারতবর্ষের শাসনভার থাকে।
খ. ৯০ বছরের ব্রিটিশ ভারত ঔপনিবেশিক শোষন :
এরপর ১৮৫৮ সালে ভারতের শাসনভার ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ব্রিটিশ রাজশক্তির হাতে স্থানান্তরিত হন। রানি ভিক্টোরিয়া নিজ হাতে ভারতের শাসনভার তুলে নেন। এর সঙ্গে সঙ্গে ভারতে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ ভারতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।(চলবে) ৷
তথ্যসূত্র : বুকস্ , ইন্টারনেট ৷
লেখক: ফারহানা আকতার, ডিরেক্টর এন্ড এ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, ইন্টারন্যাশনাল রবীন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কলামিস্ট, কথাসাহিত্যিক এবং সহ-সভাপতি, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ ৷
বাংলাদেশ সময়: ১৪:২৯:৫৬ ৬৮৩ বার পঠিত