খড়ম হলো পায়ে পরিধান করার একটি পরিধেয়। এটি সাধারণত কাঠের তৈরী হয়। অনেকে বাঁশ দ্বারাও তৈরী করে থাকেন। পায়ের মাপেই এটা তৈরী করা হয়। তার উপরিভাগে একটি খুঁটি বা বৌলা থাকে এবং উক্ত খুঁটির মাথাটিতে একটি গোলাকার শ্ক্ত গুটি থাকে যাকে একটি বড় মার্বেলের মত মনে হয়। উপরে সম্মুখভাগে একটি বর্তুলাকার কাঠের গুটি বসিয়ে দেওয়া হয় যাতে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি ও পায়ের তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে আঁকড়ে ধরা যায়। এ ছাড়াও আর এক ধরনের কাঠ দিয়ে তৈরী সেন্ডেল পরিধান করা হতো যার নাম অঞ্চল বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন হতো। যেমন-দোয়াল,কাঠের সেন্ডেল, পয়ডা ইত্যাদি। এই ধরণের কাঠের সেন্ডেলও পায়ের মাপে কাঠ কেটে তৈরী করা হয়। তবে বৌলার পরিবর্তে সাইকেলের টায়ার অথবা চামড়া দিয়ে একটি রিংয়ের মতো করা হতো। দীর্ঘ দিন পায়ে ব্যবহারের ফলে খড়মে পায়ের মাপে দাগ বসে যেতো।
খড়মপায়ে হাঁটা একটু কঠিন। অভ্যাস ছাড়া হাঁটা সম্ভব নয়। খড়ম পায়ে হাঁটার সময় একটি খট্ খট্ করে শব্দ বাজতে থাকে। এ বিষয়ে একটি আঞ্চলিক ছড়া আছে।
হরম বিবি খড়ম পায়
খটখটাইয়া হাঁইটা যায়
হাঁটতে গিয়া হরম বিবি
ধুম্মুর কইরা আছাড় খায়
আছাড় খাইয়া হরম বিবি
ফিইরা ফিইরা পিছন চায়।
খড়ম সম্পর্কে একটি সংঙ্গা রয়েছে। আর তা হলো- খড়ম এক প্রকার কাঠের পাদুকা। এখন পাদুকা কি? এমন একটি প্রশ্ন এসে যায়। হিন্দি ”খড়ৌঙ ” শব্দটি থেকে বাংলায় খড়ম শব্দের উৎপত্তি। সংস্কৃতেও ”খড়ম”ই ” বলা হয়ে থাকে। এই সবকে পাদুকা” নামেই অবিহিত করা হয়। অর্থাৎ পাদুকা বা খড়ম একটি সমার্থক শব্দ। অন্য কথায় বলা যায় যে পায়ে পরিধানকারী একটি পরিধেয়ই হলো জুতা, খড়ম বা চটি অথবা পাদুকা।
হিন্দু ধর্মে খড়মের ব্যবহার সুপ্রচলিত। হিন্দুরা খড়মকে দেবতা ও সাধুসন্তদের পদচিহ্নের প্রতীক মনে করেন। এদের পাশাপাশি জৈনধর্মেও ভিক্ষাজীবী সন্নাসী ও সাধুসন্তরা খড়ম ব্যবহার করেন। মহাকাব্য রামায়ণেও খড়মের উল্লেখ আছে। এই উপমহাদেশের বিশিষ্ট আউলিয়া হযরত শাহজালাল (রহ:) চতুর্দশ শতকে বাংলাদেশের সিলেট জেলায় বসতি স্থাপন করেন। তাঁর ব্যবহৃত খড়ম এখনো তাঁর সমাধিস্থলে রক্ষিত আছে।
কবে থেকে মানুষ খড়মের ব্যবহার শুরু করেছিল তা সঠিক ভাবে বলা মুষ্কিল। সত্য যুগের মানুষের মধ্যে এর ব্যবহার নিশ্চিত করে বলা না গেলেও এটা নিশ্চিত যে ত্রেতা যুগের মানুষ খড়ম ব্যবহার করতো। হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে যুগ চারটি। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি। সত্যযুগের পর স্বাভাবিক ভাবে দ্বাপর যুগের উৎপত্তি হবার কথা থাকলেও সেটার মধ্যে একটা সংশোধনী দিয়ে ত্রেতা বা তৃতীয় যুগকে দ্বিতীয় স্থানে নিয়ে আসা হলো। কেন করা হলো সে ইতিহাস এখন আর নাই বা বললাম। কারণ আজ খড়ম নিয়েই কথা বলি।
ত্রেতা যুগে রাম চন্দ্র যখন পিতৃআজ্ঞা পালনের জন্য বনে গমণ করবেন, তখন নন্দীগ্রামের মামা বাড়িতে অবস্থাকারী ভরত এসে যাত্রাপথে বাধ সাধলেন। ভরত রামকে বনে যেতে দিতে নারাজ। রাম বনে যাবার প্রতিজ্ঞায় অনড়। এমতাবস্থায় জ্যেষ্ঠ ভাই রামচন্দ্রের নিকট ভরত আব্দার করলেন, একান্তই যদি যেতে হয় তবে পাদুকা দুটো অন্তত যেন ভরতকে দিয়ে যাওয়া হয়। কারণ পাদুকা দুটোকে সিংহাসনে বসিয়ে দাদার প্রতিনিধি হয়ে ভরত রাজ্য পরিচালনা করবেন। রাম রাজি হয়ে পাদুকা দুটি দিয়েছিলেন।
রামচন্দ্রের খালি পায়ে বনে বনে ঘুরে পায়ের যে কি করুণ দশা হবে তা ভরত বা রাম চন্দ্র কেন অনুধাবন করলেন না বা আদৌ পায়ে কোন যন্ত্রণা অনুভব করেছিলেন কিনা তা আমার এখন আলোচ্য বিষয় নয়। এমনকি সীতার আব্দার রক্ষার জন্য সোনার হরিণের পিছে দৌড়াতে দৌড়াতে পায়ের কোন ক্ষতি হয়েছিল কিনা তাও আমার জানা নেই।
তবে বুঝা গেল ত্রেতা যুগেও খড়মের ব্যবহার ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বললেন অন্য কথা। তিনি জুতা আবিষ্কার কবিতার শেষাংশে সমাপ্তি টানলেন এই বলে যে,
” মন্ত্রী কহে, ’আমারো ছিল মনে
কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে।’
সেদিন হতে চলিল জুতা পরা-
বাঁঁচিল গোবু, রক্ষা পেল ধরা।”
কবিতাটা লিখা হয় ১৩০৪ সালে। ঘটনাটি না হয়তোবা আরো কিছুকাল পূর্বের হতে পারে। কিন্তু যুগোত্তীর্ণ ঘটনা নয়। এ বিষয়ে আমার কোন মন্তব্য করা ধৃষ্টতার সামিল। তবে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাংগালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে হয়তো দ্বিতীয় সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালীকে উদ্দেশ্য করে বলেই বসতেন, ”কবি গুরু মিথ্যা কথা বলেছেন,তাঁর মিথ্যা আজ প্রমাণিত হয়ে গেছে”।
সময়ের সাথে সাথে পোশাকের ফ্যাশনও পরিবর্তিত হয়। এক সময় ছিল টেডী পোষাক। তবে এই পোষাকের সাথে অপরিচিতদের জন্য একটু সংজ্ঞা দেওয়া প্রয়োজন। টেডী হলো শরীরের সাথে আঁটসাট ভাবে লেগে থাকা পোশাক। আর তার সাথে গৃধিনী চঞ্চু সদৃশ চর্ম নির্মিত পাদুকা পরিহিত মানুষকে টেডী নামে অবিহিত করা হয়। টেডীদের কোন লিঙ্গভেদ করা হয় নাই। অর্থাৎ টেডী এবং টেডা ইত্যাদি বলে কোথাও উল্লেখ নেই। প্রসঙ্গক্রমে পরবতীতে ব্যবহৃত আর একটি ফ্যাশনের নাম উল্লেখ করা আবশ্যক মনে করি। আর তা হলো বেলবটম। তার সংজ্ঞা বললে বলতে হয়,আগা মোটা গোড়া চিকন, এই হলো সংক্ষেপে বেলবটম। অর্থাৎ, পরিধানকৃত পেন্টের নীচে খুব চওড়া আর কোমর একদম চিকন টাইট করা। সোজা কথায় বলতে গেলে বলা যায়,তামাক খাওয়ার একটি কল্কির মতো । জুুতাও থাকতো একই রকমের প্রায়। পোশাকের আরও কিছু পরিবর্তন হয় জামার কাপড় ব্যবহারের মাধ্যমে। টেরিকট,টেট্রন,টপেডো, ইত্যাদি জাতীয়। সেই টেট্রন আবার দুই রকমের ছিল। যেমন- এইটি টুয়েন্টি,ও সিক্সটি ফাইভ থারটি ফাইভ। জুতার আরও ফ্যাশন ছিল যেমন- হিল ,হাই হিল,পেন্সিল হিল ইত্যাদি।
আমাদের ছোট বেলায় অভিন্ন পরিবারের কর্তা ছিলেন আমাদের বড় জ্যেঠা মহাশয়। সঙ্গত কারণেই তিনি শাসন ক্ষমতাও হাতে পেয়েছিলেন। তাই আমরা তার অপছন্দের কোন কাজ করে ফেললে এবং তার জন্য তিনি অধিক মাত্রায় রাগান্বিত হলে পায়ের খড়ম ছুঁড়ে মারতেন। যদিও কোন দিন সেই খড়ম আমাদের গা স্পর্শ করতো না। বাবার পায়েও থাকতো বিভিন্ন ফ্যাশন এবং বর্ণের খড়ম। হয়তো একটু বেশী মুল্যবান খড়ম বলেই সেই খড়মের তাড়া আমাদেরকে খেতে হতো না। খড়মের ভিতরেও বিভিন্ন বর্ণ এবং দামী অদামী কাঠ ব্যবহৃত হতো। খড়মের মাথার বোলাই বা টোপটি অনেক সময় রৌপ্য অথবা পিতল দিয়ে বাঁধানো হতো। বাঁধানো জুতায় ভয়েরও বিষয় ছিল। ,কারণ এই ধরনের খড়ম চুরি হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।
পাদুকা নিয়ে অনেক গল্পও প্রচলিত আছে। একসময় গ্রাম্য শালিসে গ্রাম্য বিচারকগণ সর্বসম্মত রায় দিলেন, জনৈক অপরাধীকে অবধারিত ভাবে ৫০টি জুতা মারতে হবে। সবাই মেনে নিয়ে রায় বাস্তবায়নে উদ্দ্যোগ গ্রহন করলেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল যে কারো পায়ে কোন জুতা নেই। ফলে রায় আংশিক সংশোধন করে খড়ম দ্বারা জুতা পেটা করার নির্দেশ দেওয়া হলো।
ভানুর একটি কৌতুকে আছে, ভানুকে তার গুরুদেব কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পর বগলে সেন্ডেল দেখে বললেন, ”বেশ সুন্দর পাদুকাতো!”। ভানু সানন্দে গুরুকে জুতাজোড়া দিতে চাইলেন। গুরুদেব নিতে অসম্মতি জানিয়ে বললেন, ”লোকে যদি জিজ্ঞাসা করে তাহলে কি বলবে” ? উত্তরে ভানু বলে ছিল, ”কেউ জিজ্ঞাসা করবো না। আর নিতান্তই যদি জিজ্ঞাসা করে ”তেইলে কমু কুত্তায় লইয়া গেছে”।
দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ নাটকে উডস্ সাহেবের ভ’মিকায় অভিনয় করেছিলেন অর্ধেন্দু শেখর মুস্তফী । মঞ্চে এদেশ বাসীর উপর মিস্টার উডসের অত্যাচার দেখে দর্শক সারিতে বসা বিদ্যাসাগর উডসের প্রতি তাঁর বিখ্যাত চটি ছুঁড়ে মেরে ছিলেন। অভিনেতা অর্ধেন্দু শেখর সেই চটি জুতা হাতে নিয়ে বলেছিলেন, আজ আমার অভিনয় জীবন সার্থক হলো।
অঞ্চল বিশেষে জুতার আবার নামেরও ভিন্নতা রয়েছে যেমন-চপ্পল ,হাওয়াই ,সেন্ডেল চটি, বিদ্যাসাগর চটি, স্পঞ্জ, নাগড়া,শাহী- নাগড়া ইত্যাদি।
পাদুকা নাকি স্বর্ণনির্মিত হলেও সে পায়েই থাকে, মাথায় কখনো উঠেনা। কিন্তু অনেকের মুখেও হর হামেশাই দেখা যায়। যেমন, জুতা মারবো,জুতিয়ে লম্বা করবো,জুতা পেটা করা উচিৎ,জুতা মেরে গরুদান ইত্যাদি।।
একদা জুতার গান মানুষের মুখে খুব গীত হতো-
”মেরা জুতা হ্যায় জাপানী
ইয়ে পাতলুন ইংলিস্তানী
সার পে লাল টোপী (টুপী) রূসী
ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানী।
বাংলাদেশ সময়: ২০:৫৬:২৩ ১৮৫৫ বার পঠিত