পন্ডিত রামাই বেঁচে থাকলে নির্ঘাৎ দ্বিতীয়-মৃত্যু বরণ করতেন হাসপাতালের ইউথেনিশিয়ার-এক্সপার্টএর সাহায্যে। কারণটা এ নয় যে তাঁর “দ্বিজত্ব-ডিগ্রি-ছিলনা” বা তিনি “কেবলই-ডোমেদের-পুরোহিত-ছিলেন” এই খবরটা ভদ্রব্রাহ্মন জনগন জেনে গেছে! রামাই পন্ডিত ইঊথেনিশিয়া করে “না-ফেরার-দেশে” চলে যেতেন, এই জন্যে যে কতগুলো নাঁকউঁচু “শুদ্ধাচারী সাহিত্য-বিশারদ, ইতিহাস-বিশেষজ্ঞ” “শূন্যপরাণ” অখাদ্য-সাহিত্য ও ইতরজনের নকল মন্ত্রের ব্রাত্যাচার বলেছে!
শুদ্ধাচারী শাস্ত্রে আছে প্রমিত ভাষায় “শুদ্ধ-সাহিত্য” “শুদ্ধ-ইতিহাস” লিখন পদ্ধতির নির্দেশিকা, যা ব্রাত্যপন্ডিত রামাই শেখেইনি, এবং তাই “শূন্যপুরাণ” পুরাণই নয়। এ এক ঐতরেয় পূঁথি-সাহিত্য! ব্রাত্যাচার। অথচ পূঁথিসাহিত্য, লোকগীতি তাবৎ Folk Lore অভিজ্ঞান সদায়ই বৃক্ষমুলের আত্মকাহিনী রচে। বাংলার লোক-কথা সাহিত্য (FOLKLORE) দূর্বল অত্যাচারীতের কথা “দূর্বল ভাষা”য় বলে। এবং শূন্য পুরাণের রামাই পন্ডিত ব্রাত্য ছিলেন। পিতা তার, বিশ্বনাথ, খাস ব্রাহ্মন কিন্তু এই খাস ব্রাহ্মন এক “ডোম্বিনী”র প্রেমাপ্লূত (!) হয়ে বিয়ে করে ফেল্লে রামাইএর জন্ম। (ডোম কন্যার খবর এরপর কেউ জানেনা। ঐতরিয় আরণ্যকের লেখক বিষ্ণু দাসের কথা মনে আছে তো, জন্ম ও কর্মচক্রে কেমন অদ্ভূত মিল! আর চর্যাপদ-কবি কাহ্নুপাদের কবিতায় যৈবতী ডোম-কন্যা-বিলাপটা?
একটা “শুদ্ধাচার পুরাণ” রচনা করা যায় কী? আসুন কিছু নমুনা সংগ্রহ করি একটা উপক্রম দিয়ে:
“শকুনতলীর রূপকথা”
“. . . এই সময়কালেই বঙ্গদেশে সরাসরি আর্যায়ন (ভাষা ও ধর্মের বিস্তার) প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং বঙ্গজনপদের আদিভাষা মুন্ডারি এবং অন্যান্য অস্ট্রো-এশিয়াটিক ও তিব্বতি-বর্মি ভাষা ইন্দো-আর্য মাগধি প্রাকৃত ভাষার দ্বারা স্থাননামে এবং দৈনন্দিন ব্যবহারে প্রতিস্থাপিত হতে শুরু করে।” -অধ্যাপক দারা শামসুদ্দীন (২০১৫), পৃ ৩০, “বাংলাদেশের স্থাননাম - ইতিহাসের পদচিহ্ন, ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ।
১. ইতিকথা :
শকুনতলী। সুনীল জনপদ। সাপ, ব্যাং, জলা, ডোবা। খাল, বিল, চাতাল, ঘাস ফড়িং, প্রজাপতি। বানরসমৃদ্ধ বনারণ্য। ঝোপ ঝাড় ইঁদুর।
উত্তরে পাহাড়। দক্ষিনে সাগর। উথাল পাথাল নদী। জোয়ার আসে চাঁদনী রাতের মাঠ বেয়ে। নদের কুল বেয়ে।
মনে।
শরীরে।
অমাবস্যার রাত নিঝুম। শরীর কাঁপে নদীর বানের ঢেউএর মতন। পূর্বে ঘন সবুজ বনের টিলা চালা। পশ্চিমে বারিত সবুজ সবুজ চারণভূমি। গাই গরু চড়ে বেড়ায়। ঘাস খায় ঘুমায়। শকুন উড়ে উড়ে আসে। গাই গরুর গন্ধ শুঁকে উড়ে এসে জুড়ে বসে জনপদে। নানা রংএর নানান বর্ণ ও আকারের রঙ্গিলা শকুনেরা উড়ে উড়ে আসে। টিকিওলা, কিস্তিওলা, ভিস্তিওলা, ইস্পাতের লাঠিওলা সব শকুন। সুনীল জনপদ দখল হয়।
জনপদবাসী আদিজন মিটি মিটি তাকায়। তাকিয়ে দেখে দেখে অবাক হয়্। শকুনগুলো কথায় কথায় কাইজ্যা করে নিজেরা নিজেরা। লাঠি লাঠি খেলে ইস্পাতের লাঠি নিয়ে। জনপদ ত্রস্ত হয়। এই রাজ্যেরই নাম শকুনতলী। আদিদের দেয়া নাম। নিজেদের জন্য আর একটা নাম রেখে দেয় গোপনে। জনপদ।
জনপদের ভিন ভিন গাঁয়ে থাকে এরা। শিমুলতলী, ভূষন্ডি, স্বপন গাঁ, গোশালা। এমনতরো সব নাম ওদের বসতিগুলোর। গাঁ গেরাম। জনপদবাসীগন শুধুই মিটি মিটি তাকিয়ে থাকে। দেখে শকুনের আনাগুনা, কান্ড কারখানা।
শকুনতলী তথা জনপদবাসী শুধুই এমন পরম্পরাবদ্ধ। আমার কর্মফল তোমার ভোগ।রাজ-মহারাজ-সুলতান-শাহানশাহ-লর্ড গভর্নর-মন্ত্রিদের কর্মের ফল ভোগন্তী শকুনতলীর পরম্পরা।
ওরা বোবা হয়ে হয়ে শুনে শকুনরা ওদের নাম রেখেছে মুন্ডা ভীল কোল সন্তল ওরাং ওটাং . . . . । বিচিত্র নামাবলী আঁকে জনপদেরও। বং । অব্দ ত্রব্দ পুন্দ্র গৌড় বরিন্দ্র লক্ষনাবতী রাঢ় সমতট বঙ্গ বঙ্গালা বোঙ্গালা সুবাহ বাঙ্গাল, বেঙ্গল ইস্ট বেঙ্গল। ঈষ্ট পাকিস্তান। নামায়ন নামান্তকরণ।
শকুনতলীইতো যুৎসই নাম, শকুনদের যা ব্যস্ততা জনপদজুড়ে! জনপদ শকুনতলী হয়ে যায় আদিদের কাছে। জনপদ শকুনদের কারখানা হয়। রাজা যায় সুলতান আসে। সুলতান গিয়ে শাহানশাহ আসে আসে লর্ড, রয় ভাইস রয়, গভর্ণর জেনারেল। শকুনরাজন্য। কাজ কাম বৃদ্ধি পায়। উদ্বাহু নেত্য করে তারা। নাট্য করে প্রাসাদে প্রাসাদে। শকুনতলীতে স্বর্ণযুগ যাপন হয়। খাজনা উঠে। ধান চাল ডাল। নীলকর ধানকর কার্পাসকর জলকর। সুবা-ই-বঙ্গালা হয় Bengal। গঙ্গা Ganges, ঠাকুর Tagore।
* * *
- হজৌর
- ক্য বাৎ?
- বং লোগতো ই পরগানাকো জনপদ বলতা হায়!
- জানাপাদা! জন কা পাদা? ছো হ।
- কিঁ উ, হোজৌর?
- ঈ পদমে জানাগানা নেহি হ্যায়। গো হ্যায় সব। গোপদ বলো ইছিকো।
- ও ক্য সে, হোজৌর!
- ইখানে বহুত গো বস্তি করতা হায়।
- লেকিন, বাখতিয়ারজি . . .
- ঠিক, তু শচ কাহা। লেঃ জেনারেল বাখতিয়ার সাহাব ঈ পরগানাকো কুছু জানাপাদাকি চেহরে দি হায়। ইনকে পেহলে ই গোপদ থা।
- ই বাৎ শচ হায় তো জেনারেলজী কিঁউ আয়া ইঁহাঁ?
- গাই কা লিয়ে। সুবা-ই-বঙ্গালাকি গাই বহুত দুধ দেতা। আসলি বাৎ ইহি হ্যায় কি, বহুৎ উমদা চিজের জন্যই খলজি পালজি লছমনজি পুরানা আরিয়া আওড় নয়া আরিয়ালোগ আয়া আউর আতে রাহেগী ইয়ে সুবা-ই-বাঙ্গালাহ মুলুকমে।
২. ইতিকথার পরের কথা :
জনপদের জনগণ ভয়ঙ্কর রোমান্টিক। বুকে ঘুণপোকা আর পেটে খান্ডব ক্ষুধা নিয়ে কোলকাতার ফুটপাতে দাড়িয়ে পূর্ণিমার চাঁদকে তান্দরী রুটি ভেবে কবিতা লিখতে পারে। “কী কথা ঐ যুবকের সাথে, সুরঞ্জনা?” বলে অভিমানে গাল ফুলিয়ে বসে থাকতে পারে বরিশালের ইশটিমার ঘাটে। চালচুলোহীন দূরন্ত সাহসে বলতে পারে, “হে দারিদ্র তুমি মোরে দানিয়াছো ক্রিস্টের সম্মান।”
কার জন্য, না জেনেও সরোষ কন্ঠে বলতে পাড়ে, “তুমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা”। পরম নৈরাজ্যে বাস করেও বলতে পাড়ে “ভয় নেই প্রিয়তমা, এমন দিন এনে দেবো দেখো সেনাবাহিনী বন্দুক নয়, শুধু গোলাপের তোড়া হাতে কুচকাওয়াজ করবে তোমার সামনে সারাদিন।” কাব্য অস্ত্র গণতন্ত্র নষ্টদের হাতে চলে যেতে দেখেও মহুয়ানন্দে হুকুম জারি করতে পারে, “এই পল্টনের মাঠে আমার প্রেমিক ছাড়া আর যেন কাউকে দেখিনা কোন দিন।”
এই সব পারে বলেই জনপদের জনগণ সব রোমান্টিক হয়। ভীষন, ভয়ঙ্কর, রোমান্টিক।
রোমান্টিক চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে ওরা শকুনরাজন্য যজ্ঞ। ধূপ ধুনা আতর খুশবু ছড়ায়। মৌ মৌ দিগন্ত জুড়া হৃদয়-খাতায় জ্ঞানগম্মি ছড়ায়, ছড়ায় আইন কানুন, কালাকানুন, কলাকানুন। কলাবিদ্যা শেখায় বংদের। ‘ভাত দে হারামজাদা’ বল্লে বাহবা দেয়। বহুত খুব। আসলি বাৎ বোলা বলে আদমজী পুরষ্কার দেয়। ফিলিপস সাহিত্য এওয়ার্ড। হামার মতি মিয়া বঙ্গালা জানে বলে সার্টিফিকেট দেয়।
দুই স্রোতে বাংলা :
“ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গভাষাকে পণ্ডিতমণ্ডলী ‘দূর দূৱ’ করিয়া তাড়াইয়া দিতেন, হাড়ি-ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাহ্মণেরা যেরূপ দূরে থাকেন বঙ্গভাষা তেমনই সুধী সমাজের অপাংক্তেয় ছিল-তেমনি ঘৃণা, অনাদর ও উপেক্ষার পাত্র ছিল৷”— শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন
এহেন বিচারীক দৃষ্টিতে দেখা একটি ভাষা তার এই প্রলেপিত ‘ঐতরিয়ত্ব’ ঝেড়ে মুছে ফেলে দিয়ে কেমন করে “হঠাৎ আর্যত্য” লাভ করলো? যেখানে ভাষা বিজ্ঞানীগন বলতে পারেণ, “বাংলার কোন শব্দই সংস্কৃত থেকে আসেনি” (ড: শহিদুল্লাহ, পৃ: ১৬৪, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ১৯৯০), সেখানে কি তাহলে মধ্য এশিয়া থেকে আগত আর্যরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলো আর কোন “আর্য ভাষা”?
নাকি, সংস্কৃতই ভারতীয় আদিবাসীদের Lingua Franca থেকে “গ্রহন-বর্জন”এর অমোঘ নিয়তিতে পরিবর্তীত হয়ে হয়ে, “প্রাকৃত”- মাগধী “অপভ্রংশ” স্তর পার হয়ে হয়ে তার আর্যত্ব বজায় রেখেছে ! এবং ভারতী স্থানীয় (Vernacular) ভাষাগুলোকে আর্যত্ব দান করেছে ! “বীজ-প্রাধান্য”র যুক্তিটা বেশ যুৎসইভাবে ভাষাবিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেছেন ডোমনী গর্ভে জন্ম নেয়া vernacular কে আর্যত্ব দানে ! যে সমাজে আর্য-পুরুষ ও ইতর-রমনী মিলনের ফসলকে “ক্ষেত্রপ্রাধান্য”-দোষে ইতর আক্ষায়িত করাই আইন।
বাংলাকে আর্যামীভূক্তির (Aryanization) রাজনীতি।
বিশেষজ্ঞগন বলেন “ভাষা হয়ে হয়ে উঠে”! Medium of communication হিসেবে ভাষার সৃষ্টির প্রাথমিক পর্য্যায়ে এই hypothesis হয়ত টিকসই প্রস্তাব। পরের পর্য্যায়েই, যখন তা একটু পাকা হয়, ভাষা হয়ে দাড়ায় নির্ভেজাল ভাবে Political, (কোন শব্দটা গ্রহনীয় বা বর্জনীয়, কার ঠোটে ঐ শব্দ শোভা পায় বেশি); এমনকি সাম্প্রদায়ীক ! (“মুসলমান-বাংলা” ও “হিন্দু-বাংলা” যেমন)। ভাষা হয়ে উঠে tools of self identification, এবং tools of identification of Others”! এবং এই করে করেই একটা ভাষাকে হয়ে হয়ে “উঠানো” হয়। একালের আর্যরা বাংলাকে এভাবেই আর্যত্ব দান করেছে। এটা নব্য-আর্যদের সততই “জাত্যাভিমান” প্রকাশ বা প্রতিষ্ঠার এক চমকপ্রদ দিক।
বাংলা ভাষাকে হয়ে হয়ে “উঠানো”র আর এক ধাপ এগিয়ে ধরছে ঢাকার মিডিয়াগুলো। উদ্ভট খিচুড়ি ভাষায় Program Title (বিজনেস 24) গুলো “কোন আর্য-নৃগুষ্ঠির” Tribal Language?
“একাত্তর”, কিবা “ইকেট্টর” !
“Celebrity Lounge”এ Talk দিয়ে Show করে জিজ্ঞেস করা হয় বং-ভাষা জগাখিচুড়ি কেন হয় !? প্রস্তাব। বাংলা সংবাদ পাঠের অনুষ্ঠানের নামকরণ হয় ”News Hour/ Xtra”
Linguistic Anthropologistদের গবেষনার বিষয় হতে পারে ঢাকার টিভিগুলোর ইংরেজি অক্ষরে বাংলা নাম (Ekattor TV, GAAN BANGLA), খাস বাংলায় অনুষ্ঠানের ইংরেজি নাম ”নিউজ 24”!
আমার ছেলে TV Screenএ “৭১ TV”র নামটা ইংরেজি অক্ষরে “Ekattor” লেখাটা উচ্চারণ করে “ইকেট্টর”!
বাংলা অক্ষর “ব” (b) এবং “বৈশাখী”র English অক্ষর (baishakhi) কাদের জন্য লেখা হয়, ইংরেজ শ্রোতা ও বাঙ্গালী দর্শকের জন্য !!!
বাংলা “ব” এবং “বৈশাখী”র English ???
বাংলাদেশ সময়: ১৯:০১:৩৫ ৭৩৮ বার পঠিত #মতি মিয়া #শূণ্য পূরাণ #সাহিত্য #“শকুনতলীর রূপকথা