সোহান খুব উচ্ছ্বসিত আগামিকাল ভোরে শহীদ মিনারে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে ভাষা শহীদের শ্রদ্ধা জানাবে।
শহীদ মিনার সংলগ্ন রাস্তাটায় চওড়া ফুটপাত। দিনের ব্যস্ত ফুটপাত রাতে সোহানের মতো পথশিশুদের আশ্রয়স্থল। আজ রাতে সোহান ঘুমাতে পারে নি। সিটি কর্পোরেশানের পরিচ্ছন্নকর্মীরা রাতভর খুব বিরক্ত করেছে সোহানদের। সকাল হলেই হাজারো লোকের ভীড় জমবে শহীদ মিনার এলাকায় তাই তো সারারাত ধরে চলছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভিযান। ফুটপাতে ঘুমাতে থাকা সোহানদের তুলে দেয়া হয় লাথিউষ্টা দিয়ে। সতর্ক করা হয় ভোর থেকে যেনো ভুলেও এদিকে না আসে। মন খারাপ করে পাশের গলির চিপায় ঘুমিয়ে পড়ে আনমনে। তবে খুব ভোরে উঠার তীব্র বাসনা লালন করে বুকের ভিতর।
খুব ভোরে ঘুম ভাঙে সোহানের।
তাকিয়ে দেখে পিচঢালা রাজপথে খালি পায়ে শহীদের মিনারের দিকে দলে দলে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা পদযাত্রা করছেন। সবার হাতে ফুলের তোড়া,ব্যানার,ফেস্টুন, মাথায় বাঁধা জাতীয় পতাকা।
ব্যানার ফেস্টুনে কি যেন আঁকা! মনে হয় লেখাপড়া। কোন কিছু লেখা হবে হয়তো। সোহান পড়তে পারে না।
শহীদ মিনারের ঠিক সামনে বিশাল একটা কৃষ্ণচূড়ার গাছ ছিলো। প্রতিবছর ভাষার মাসে কৃষ্ণচূড়ার গাছটা টুকটুকে লাল ফুলে শহীদ মিনার প্রাঙণ ভরিয়ে রাখতো রক্তিম আভায়। শহীদ মিনার সংস্কার কাজের সুবিধার্থে গাছটি কেটে ফেলেন কর্তৃপক্ষ। এবারের শহীদ মিনার প্রাঙণ বেশ জাঁকজমকপূর্ণ অবকাঠামো তবে কৃষ্ণচূড়ার গাছটি ছাড়া বেশ প্রাণহীন মনে হচ্ছে।
একজন ভাষা সৈনিক শহীদ মিনার প্রাঙণে যত্ন করে লাগিয়েছিলেন কৃষ্ণচূড়া গাছটি যেনো ভাষার মাসে গাছটি তার ফুলেল শুভেচ্ছায় ভাষা শহীদের সম্মান জানাতে পারে।
সোহান কৃষ্ণচূড়া না পেয়ে গভীর কষ্ট নিয়ে চৌহাট্টা পয়েন্টে ফিরে যায়। সোহানের খুব ইচ্ছে ছিলো এমন দিনে ভাষা শহীদের স্মরণে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিবে। মনোব্যথা নিয়ে ফুলের দোকানে যায় সোহান। একটি গোলাপের দাম ত্রিশ টাকা, একটি ছোট তোড়া চারশো পঞ্চাশ বড়োটা সাতশোর উপরে। কোন টাকা না থাকায় কোন ফুল দেয় নি দোকানদার।
সোহান খুব আকুতি করে একটি ফুলের জন্য। ফুলের দোকানে আজ ব্যবসার দিন। দলে দলে ফুলের তোড়া নিচ্ছেন লোকজন। কতো বাহারি রঙের ফুল দিয়ে সাজানো পুষ্পাঞ্জলি। তার মাঝে রঙিন কালিতে লেখা ” আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস অমর হোক”।
কৃষ্ণচূড়া গাছে সোহানের ফুল জুটলো না এমনকি হাজারো ফুলের সমৃদ্ধ পুষ্পালয়েও না। সোহানের হঠাৎ মনে পড়লো শহরতলীর মালিকান্দি গ্রামে ফুলের বাগান আছে। সোহান দৌড়ে গিয়ে বাগান থেকে লুকিয়ে দুটি গোলাপ নিয়ে আসে। আরেকটুর জন্য বাগানের মালিকের হাতে ধরা পড়তো ভাগ্যগুণে বেঁচে গেলো সোহান।
দৌড়ঝাঁপ করে শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়ায় সোহান। ভিতরে ঢুকার ব্যর্থচেষ্টা করছে বারবার। এই শহরের মন্ত্রী মহোদয় আনুষ্ঠানিক পুষ্পাঞ্জলি দিবেন নিজ দলীয় উদ্যোগে তাই সাধারণ মানুষই ঢুকতে পারছেন না সোহান তো একজন পথশিশু। নিরাপত্তা কর্মীরা ব্যাপক সতর্কতা অবলম্বন করছে। কোন পথশিশু, টোকাই কিংবা রিকশাচালককে শহীদ মিনার এলাকায় ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।
সোহান হাতে দুটি গোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শহীদ মিনার গেটের কিছুটা দূরে।
একে একে রাজনৈতিক নেতৃকর্মী,সামাজিক ও সংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ,ব্যবসায়ী সমিতি,শিক্ষার্থী ও প্রেসক্লাবের নেতাবৃন্দরা ফুল দিচ্ছেন।
সোহান ভাবে এই শহরে কেউ সাধারণ জনতা নাই। সবাই কোন না কোন দল বা সংগঠনের সাথে জড়িত। দুপুর ঘনিয়ে যায় শহীদের মিনারে শুরু হয় বক্তৃতার মহড়া।
মঞ্চ কাঁপিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে মহানগর নেতা।
“শহীদেরা এই ভাষা এনেছে সাধারণ মানুষের জন্য…!”
সোহান চারদিকে তাকায় কোন সাধারণ মানুষ দেখতে পায় না।
হাতের গোলাপ দুটো রোদে শুকিয়ে যায়। তপ্ত রোদে হেলে পড়ে ফুটন্ত গোলাপের পাঁপড়ি। সোহানের দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠে বাংলার আকাশ।
জেনারুল ইসলাম
পূর্ব দরগা গেইট
আম্বরখানা, সিলেট।
বাংলাদেশ সময়: ৯:৩০:৫১ ৭৭৩ বার পঠিত #গল্প # প্রাবন্ধিক # জেনারুল ইসলাম