করোনাভাইরাসের টিকা নেয়া না নেয়া প্রশ্নে অনেকের মাঝেই এক ধরনের সংশয় দেখা যাচ্ছে। নেতিবাচকভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারের কারণে এক ধরনের আস্থাহীনতা রয়েছে টিকার প্রতি। সংশয় কাটানোর জন্য দায়িত্বশীলদের কিছু উৎসাহমূলক উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। ওদিকে করোনা টিকার জন্য গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত অনলাইনে নিবন্ধন করেছেন ৪ হাজার ৩৭৩ জন। গত দু’দিনে নিবন্ধন কম হওয়ায় চিকিৎসকরা বলছেন, ভ্যাকসিন না নিলে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। এজন্য তারা চিন্তিত।
করোনা থেকে মুক্তি পেতে আশার আলো ভ্যাকসিন। তাই বিশ্বে কয়েকটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও করোনার টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
গত বুধবার টিকার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। একদিন পর রাজধানীর ৫টি সরকারি হাসপাতালে পর্যবেক্ষণমূলক টিকা নিয়েছেন সাড়ে ৫শ’ জন। সবাই সুস্থ আছেন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। ৭ই ফেব্রুয়ারি সারা দেশে ব্যাপকহারে টিকাদানের কর্মসূচিও রয়েছে।
দেশের ৮ বিভাগে চালানো ‘কোভিড-১৯ টিকার প্রতি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের ২৬শে জানুয়ারি প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ লোকই টিকাদান কর্মসূচি চালুর শুরুতেই টিকা নিতে প্রস্তুত নয়। ৩২ শতাংশ মানুষ টিকা প্রদান কার্যক্রম চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টিকা নিতে চান, আর বাকি প্রায় ৫২ শতাংশ জনগণ কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস অপেক্ষা করে টিকা নিতে চান। কিছুদিন অপেক্ষা করে এই কার্যকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে তারপর নিতে চান। আর ১৬ শতাংশ কখনই টিকা নিতে চায় না।
কেন এত বিশাল একটা অংশ এই মুহূর্তে টিকা নিতে আগ্রহী নয় সে বিষয়ে ওই গবেষণার মাধ্যমে জানার চেষ্টা করা হয়। যারা এই মুহূর্তে নিতে চায় না তাদের ৫৪ শতাংশ টিকার কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে। তাছাড়া ৩৪ শতাংশ পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া নিয়ে শঙ্কিত এবং ১২ শতাংশ এর মাঝে আমদানি করা টিকার গুণগত মান নিয়ে সন্দেহ আছে বলে জানায়। যারা একেবারেই নিতে চায় না তারা টিকার মান ও কার্যকারিতা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া একটা উল্লেখসংখ্যক লোক টিকা নেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না।
টিকার বিষয়ে বিভিন্ন পেশার বা সাধারণ মানুষের অনেকেই এখন নানাভাবে তাদের আস্থার অভাব বা সংশয় প্রকাশ করছেন। বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে চলছে ব্যাপক আলোচনা। টিকার প্রতি মানুষের সংশয় এবং এটা দূর করার জন্য উপায় কী জানতে চাইলে জাতীয় পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, গুজবের কারণে মানুষের মধ্যে টিকা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। অহেতুক গুজব ছড়ায় কিছু মানুষ। এটা কেটে যাবে। প্রথমে সম্মুখসারির যারা তারা টিকা পাবেন। বিএসএমএমইউতে কিছু ভিআইপি টিকা নিয়েছেন। এতে মানুষ উৎসাহ পাবেন বলে তিনি মনে করেন। দেশে ইপিআই (সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির) শুরুতে চলচ্চিত্রের অনেক অভিনেতারা বিষয়টিতে এসে উৎসাহ দিয়েছেন। ফলে পরবর্তীতে মানুষ ভালোভাবে নিয়েছেন। দেশের এই ভাইরোলজিস্ট আরো বলেন, টিকা নেয়ার পর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়। যেমন- জ্বর, ব্যথা, ফুলে যাওয়া ইত্যাদি। এতে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোনো দেশে হার্ড ইমিউনিটি তৈরির জন্য নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ মানুষকে টিকা দিতে হবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের জনসংখ্যার ভিত্তিতে ১২ কোটি মানুষকে টিকা দিতে হবে। সরকার অক্সফোর্ডের ৩ কোটি ভ্যাকসিন পেতে চুক্তি করেছে সিরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে। অন্যদিকে কোভ্যাক্স সুবিধার মাধ্যমে ৬ কোটি ৮০ লাখ ডোজ করোনার ভ্যাকসিন পাওয়ার কথা বাংলাদেশের। এ টিকাগুলো ডাবল ডোজ হওয়ায় ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষকে দেয়া সম্ভব হবে। কোভ্যাক্সের কাছ থেকে বিশ্বের ৯২টি দেশের মতো বাংলাদেশও মোট জনসংখ্যার শতকরা ২০ ভাগ জনগোষ্ঠী অর্থাৎ ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষের জন্য টিকা পাবে। বিভিন্ন উৎস থেকে যে পরিমাণ টিকা পাওয়া যাবে তাতে ৫ কোটির কিছু বেশি মানুষকে এর আওতায় আনা সম্ভব হবে। বাকি টিকা সংগ্রহ করা হবে বলেও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
এদিকে ওষুধ কোম্পানিসহ বেসরকারি খাতের কর্মীদের মধ্যে বিতরণের জন্য ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে ৩০ লাখ ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা আনার কথা ভাবছে দেশের শীর্ষ ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। উল্লেখ্য, ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার যে টিকা কেনা হচ্ছে, তার প্রথম চালানে ৫০ লাখ ডোজ ঢাকায় এসেছে ২৫শে জানুয়ারি। এর আগে ২১শে জানুয়ারি ভারত সরকারের উপহার হিসেবে আরো ২০ লাখ ডোজ টিকা এসেছিল দেশে।
করোনা টিকার নিবন্ধন: দেশে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) টিকা দেয়া শুরু হয়েছে। টিকা নিতে চলছে ডিজিটাল নিবন্ধন। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত দু’দিনে নিবন্ধন করেছেন ৪ হাজার ৩৭৩ জন। এর আগে প্রথম ২৪ ঘণ্টায় নিবন্ধন করেছিলেন ১ হাজার ২৫৩ জন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সিস্টেম অ্যানালিস্ট ম্যানেজার মাসুম বিল্লাহ মানবজমিনকে এ তথ্য জানিয়েছেন। গত বুধবার বিকাল সাড়ে ৩টায় রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে আনুষ্ঠানিকভাবে টিকাদান ও অ্যাপের মাধ্যমে অনলাইন নিবন্ধন কার্যক্রম উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও বর্তমানে সুরক্ষা ওয়েবসাইটে গিয়ে নিবন্ধন করছেন টিকা নিতে আগ্রহীরা। মুঠোফোনে অ্যাপসটি পাওয়া যাচ্ছে না। আইসিটি বিভাগ সূত্র বলছে, অ্যাপসটির অনুমোদনের জন্য গুগলের কাছে আবেদন করা হয়েছে। এতে ১ থেকে ৭ দিন সময় লাগতে পারে। গুগল এখন এটি রিভিউ স্ট্যাটাসে রেখেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১২:৪৪:১৭ ৪৪৬ বার পঠিত # #করোনা #জনগন #টিকা #নিবন্ধন #বাংলাদেশ সরকার