অধ্যাপক নেহাল করিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পাশাপাশি ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ ও বিউপিতেও শিক্ষাকতার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ৷ উল্লেখিত বইটি ছাড়াও সমাজের নানা বিষয়ের ওপর তাঁর নিজের লেখা ও সম্পাদিত আরও বেশ কয়েকটি বই তাঁর রয়েছে ৷ ভাষা শিল্পী প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, “ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ থেকে মানুষের মুখে নয়” ৷তিনি বলেছেন, “জ্ঞানের প্রদ্বীপ যেখানেই জ্বালো না কেন, তাহার আলোক চারিদিক ছড়াইয়া পড়িবেই। মনোজগতে বাতি জ্বালানোর জন্যে সাহিত্যচর্চার বিশেষ প্রয়োজন”৷ স্বদেশপ্রীতি সম্পর্কে তাঁর অভিমত, “আমরা স্বদেশে যাতে বিদেশি না হই, সে বিষয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে”৷ প্রমথ চৌধুরীর মতে, “সাহিত্যের উপাদান হচ্ছে মানবজীবন ও প্রকৃতি। মানব জীবনের সঙ্গে যার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ নেই, তা সাহিত্য নয়”। তিনি মানসিক যৌবনকেই সমাজে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস করেছেন ৷ ভাষা নিয়ে সাহিত্য সাধনা তাঁর কাছে জীবন সাধনার নামান্তর ৷তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ৷ কর্মজীবনে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও সরকারের উচ্চপদে দায়িত্ব পালন করেন এবং কিছুকাল পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন । প্রমথ চৌধুরীকে বাংলা সাহিত্যে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক হিসেবে অভিহিত করা হয় ৷বর্তমানে আমাদের দেশে এ যুগের প্রখ্যাত অধ্যাপক,গল্পকার,উপন্যাসিক ও শিশু –সাহিত্যিক ডঃ মুহাম্মদ জাফর ইকবাল তাঁর ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ নামক বইটিতে বলেছেন, “অর্থনৈতিক নিপীড়ন থেকে অনেক বড় নিপীড়ন হছ্ছে একটি জাতির ভাষা,সংস্কৃতি আর সভ্যতার ওপর নিপীড়ন আর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ঠিক সেটিই শুরু করেছিল ৷পাকিস্তানের জণ্ম হয়েছিল ১৯৪৭ সালে আর ঠিক ১৯৪৮ সালেই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ঘোষনা করলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ৷সাথে সাথে পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালিরা তার প্রতিবাদ করে বিক্ষোভ শুরু করে দিল৷ আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি সারা পূর্বপাকিস্তানের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ল ৷পুলীশের গুলীতে প্রান দিয়েছিল রফিক,সালাম,বরকত, জববার এবং আরো অনেকে ৷ তারপরেও সেই আন্দোলনকে থামানো যায়নি ৷ পাকিস্তানের শাষকগোষ্ঠীকে শেষ পর্যন্ত ‘বাংলা ভাষা’ কে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে হয়েছিল৷ যেখানে ভাষাশহীদেরা প্রান দিয়েছিলেন, সেখানে এখন আমাদের প্রিয় শহীদ মিনার,আর ২১শে ফেব্রুয়ারী তারিখটি শুধু বাংলাদেশের জন্যে নয়, এখন সারা পৃথিবীর মানুষের জন্যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস”৷ তিনি আরও বলেছেন, “এই পৃথিবীতে যা কিছুকে ভালোবাসা সম্ভব তার মাঝে সবচেয়ে তীব্র ভালোবাসাটুকু হতে পারে শুধুমাত্র মাতৃভূমির জন্যে৷যারা কখনও নিজের মাতৃভূমির জন্যে ভালোবাসাটুকু অনুভব করেনি,তাদের মতো দুর্ভাগা আর কেউ নেই”৷ প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক ও উপন্যাসিক সেলিনা হোসেন তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ’ উপন্যাসের ‘সংস্কৃতি ও অমর একুশে’ অধ্যায়ে বলেছেন, “মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকে ভালো কে না বাসে এই ভালোবাসা মানুষের স্বভাবের মধ্যে এমনভাবে মিশে আছে যে,সঙ্কটে পতিত না হওয়া পর্যন্ত মানুষ এ ভালোবাসার কথা ভুলেই যায় ৷ যখন মানুষ তা ভুলে যায়,তখন মানুষ এমন কোনো কাজে লিপ্ত হয়ে পড়তে পারে ,যাতে সেই ভালোবাসা ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে ৷ মানুষ হয়তো এই আশঙ্কার কথা বুঝতেই পারে না ৷ মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার কথা মানুষকে তাই মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন ৷ মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার জন্য হৃদয়ের প্রফল্লুধারার মতো ভালোবাসা থাকাই যথেষ্ট নয়,সে ভালোবাসার প্রকাশ প্রয়োজন ৷ সে ভালোবাসাকে লালন করা প্রয়োজন এবং মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার মর্যাদাকে সমুন্নত রাখার জন্য সচেতন প্রচেষ্টা প্রয়োজন ৷অমর একুশে আমাদের সে প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়” ৷ মূলতঃ সেলিনা হোসেনের রচনায় প্রতিফলিত হয়েছে সমকালের সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সংকটের সামগ্রিকতা এবং বাঙালির অহংকার ভাষা আন্দোলন , মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ ও সর্বোপরি, গনতান্ত্রিক মূল্যবোধ তাঁর লেখায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। অতুল প্রসাদ সেন বলেছেন, “মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা ৷ মাগো তোমার কোলে,তোমার বোলে,কতই শান্তি ভালোবাসা” !নিজের মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধ প্রকাশ করতে গিয়ে মধ্যযুগের কবি আব্দুল হাকিম তাঁর ‘নূরনামা’ কাব্যগ্রণ্হে বলেছেন, “যেসব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী,সে সব কাহার জণ্ম নির্নয় ন জানি ৷ দেশীভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়ায়, নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়” ৷
মূলতঃ ‘নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক আমার এ কলামটিতে আমি ‘ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও উপমহাদেশের ইতিহাস ’ নিয়ে আমাদের বাঙালি বু্দ্ধিজীবিদের বক্তব্য ও রচনাগুলোকেও একসঙ্গে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি যাতে করে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা খুব সহজেই এই বইগুলো সংগ্রহ করে এ বিষয়ে সঠিকটাই জেনে নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করতে পারে ৷( চলবে)৷
তথ্যসূত্র: বুকস, ইন্টারনেট
লেখক: ফারহানা আকতার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, একাডেমিসিয়ান,গবেষক, কলামিস্ট এবং লেখক৷
বাংলাদেশ সময়: ১১:৫৪:০৫ ৯০৮ বার পঠিত #নতুন প্রজণ্ম #ফারহানা আকতার #বাংলাদেশ #ভাষা আন্দোলন #মুক্তিযুদ্ধ