জীবন কৃষ্ণ সরকার
বিবাহের অল্পদিনের মাথায় স্বামীর করুণ মৃত্যু,একমাত্র মেয়েকে নিয়ে সংসার সামলে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্র সৈনিকের দায়িত্ব পালন তথা সমাজ সেবায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনের এক মহিয়সী নারীর নাম সুহাসিনী দাস।বন্ধুরা, হাওরের ইতিহাসে সাড়া জাগানো এক নারী নেতৃত্বের অবদানের কথা আজ আপনাদের মাঝে শেয়ার করতে বসছি।তাহলে আসুন পুরো লেখাটি পড়ে আসি।
জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাক’র আর্কাইভ থেকে যত দূর জানা যায়, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেত্রী ও আজীবন দেশব্রতী সুহাসিনী দাস (১৯১৫-২০০৯)-এর জন্ম সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামে। তাঁর বাবা প্যারীমোহন রায়, মা শোভা রায়। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। বয়স যখন ১৬ বছর, তখন সিলেট শহরের জামতলা এলাকার কুমুদচন্দ্র দাসের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর স্বামী ছিলেন সিলেটের প্রাচীনতম ছাপাখানা কোটিচাঁদ প্রেসের স্বত্বাধিকারী। বিয়ের চার বছরের মাথায় ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর স্বামী কলকাতায় যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর দেড় বছর বয়সী কন্যা নীলিমাকে নিয়ে শুরু হয় তাঁর সংগ্রামমুখর জীবনযাপন। দেবর ফণীন্দ্রচন্দ্র দাসের সহযোগিতায় বইপড়া থেকে শুরু করে সামাজিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হন। সুহাসিনী দাস ১৯৩৯ সালে সারদা হলে ‘শ্রীহট্ট মহিলা সংঘ’র সম্মেলনে যোগ দেন মাধুরী দাসের সাথে। সেখানে আশালতা সেন ও লীলা নাগের দেশপ্রেম সংক্রান্ত বক্তৃতা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে তোলে। রাজপথে থেকে দেশমাতৃকার সেবায় মনোনিবেশের সিদ্ধান্ত নেন সেখান থেকেই। চরকা দিয়ে সুতো কাটার কাজটাকেও বেছে নেন। একসময় এ কাজে খুব দক্ষও হয়ে ওঠেন। ১৯৪০ সালের ২৬ জানুয়ারি স্বাধীনতা দিবস উদযাপন উপলক্ষে মহিলাদের বিশাল সমাবেশে সংকল্প নেন আজীবন খদ্দর (দেশের তৈরী সাধারণ কাপড়) পরিধান আর সাধ্যমতো সমাজসেবা করার। আজীবন তিনি সেই সংকল্প রক্ষা করে গেছেন। নারী নেত্রী নরেশনন্দিনী দত্ত-কে তিনি কর্মজীবনের গুরু হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। প্রায় প্রতিটি শিল্প সর্ম্পকে কিছু ধারণা থাকায় ১৯৪১ সালে সিলেট শহরে মহিলা সংঘ পরিচালিত শিল্প উৎপাদন কেন্দ্রের প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কোন রকম সম্মানী গ্রহণ ছাড়াই।১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার কারণে রাজবন্দী হিসেবে ৯ মাস জেলে কাটাতে হয়। ১৯৪৩ সালে বিশ্বযুদ্ধের ঘন্টা বাজলে আর্তের সাহায্যে কাজে নেমে পড়েন। ধান-চালের দাম কমানোর আন্দোলনেও তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস সভাপতি পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর সিলেট সফরকে উপলক্ষ করে চাঁদা সংগ্রহের ভার যাঁদের ওপর পড়েছিল, এর মধ্যে সুহাসিনী দাস ছিলেন অন্যতম। ১৯৪৬ সালে জওহরলাল নেহরু সিলেট আসলে মহিলাদের পক্ষ থেকে যে সংবর্ধনা দেয়া হয় সেখানেও তিনি উল্যেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে নোয়াখালীতে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর মহাত্মা গান্ধী শান্তিমিশন নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন। সে মিশনে সিলেট থেকে একটি দল গিয়ে অভয় আশ্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে সেবা ও ত্রাণকাজে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে সুহাসিনী দাস গান্ধীজির সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। সেবাকাজ চালাতে গিয়ে সুহাসিনী তখন বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন এবং সে খবর পেয়ে গান্ধীজি তাঁকে দেখতে ছুটে যান। মহাত্মা গান্ধী তখন সুহাসিনীকে হিন্দিতে কিছু কথা বলেছিলেন, যার বাংলা তরজমা এ-রূপ : ‘শিগগির সুস্থ হয়ে উঠবে এবং সেবার কাজ করবে। মন খারাপ করো না।’আবার একই বছর ১৯৪৬ সালে সিলেটে সুরমাভ্যালি চা শ্রমিক প্রতিনিধি নির্বাচন এবং কংগ্রেস কর্তৃক ‘শ্রীহট্ট জেলা চা বাগান শ্রমিক কংগ্রেস’ গঠনে তার অবদান অসামান্য।এছাড়াও ১৯৪৬ সালে ঝড়ে বিধ্বস্ত সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই অঞ্চলের জনপদ পূনর্গঠণে এবং নোয়াখালীর দাঙ্গায় বিপর্যস্ত মানুষের পাশে থেকেও কাজ করেন পরম বন্ধুর মতো।
সুহাসীনি দাসের কল্যাণময় স্পর্শ সিলেটের মাটি আঁকড়ে আছে। গোঁড়ামিতে ভরপুর সমাজে নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক-কারিগরী শিক্ষায় উদ্ধুদ্ধ করা, সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলা ছাড়াও স্বদেশপ্রেমের যে বিরল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা এসময়ের প্রগতিশীল নারীদের প্রেরণা হয়ে কাজ করে। সিলেটের ইতিহাসের অংশ হয়ে মিশে আছেন তিনি। একজন ত্যাগী ও পরোহিতকারী নারী হিসেবে তিনি আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। নির্যাতিত নারী ও অনাথ শিশুদের পাশে থেকেছেন মায়ের মতো, বোনের মতো। অকাতরে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন তাদের জীবন প্রতিষ্ঠা লাভে। অসামান্য সামাজিক অবদান আর নারীমুক্তির আদর্শ হিসেবে সুহাসিনী দাস সিলেটবাসী এবং এদেশের নারীশক্তির গর্ব।
দেশবিভাগের পর তাঁর আত্মীয়-স্বজনসহ অনেক হিন্দুরা দেশ ছাড়েন। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান গড়ে ওঠলেও নিজের প্রাণের শহর সিলেটেই থেকে যান তিনি। সেখান থেকেই এ অঞ্চলের মানুষের উত্থান-পতন অবলোকন করেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশভাগের পর হিন্দুদের বাংলাদেশ ত্যাগ রোধে মুখ্য সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশসহ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে তিনি সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। অনাথ ও দরিদ্র পরিবারের সন্তান এবং মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধর্ষিতা নারীদের পুনর্বাসন তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
১৯৪৮ সালে ছয় মাস পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বলরামপুরে গ্রাম সেবিকা হিসেবে প্রশিক্ষণ নেয়ার পর গ্রামের সাধারণ মানুষের সেবা করার স্পৃহা আরো বেড়ে যায়। ১৯২৫ সালে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া রেল স্টেশনের পূর্ব দিকের পাহাড়ের মধ্যে গড়ে ওঠা ‘রঙ্গিরকূল’ আশ্রমে সেবা করে গেছেন দীর্ঘ ৪৬ বছর। আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত ও পূর্ণেন্দুকিশোর সেনগুপ্ত।
প্রথমে রঙ্গিরকুল আশ্রম’(৪৬বছর) এবং পরে সিলেট শহরের চালিবন্দর এলাকায় অবস্থিত উমেশচন্দ্র-নির্মলাবালা ছাত্রাবাসের কর্মপরিচালনার দায়িত্বে তিনি আজীবন যুক্ত ছিলেন।১৯৫৩ সালে যুক্তফ্রন্টের সমর্থনে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন আবার। ১৯৫৪-৫৬ সালে দূর্ভিক্ষের সময় সিলেটের রামকৃষ্ণ মিশনে খোলা লঙ্গরখানায় কাজ করেছেন একজন কর্মী হিসেবে।
সিলেটের চালিবন্দরে উমেশচন্দ্র-নির্মলাবালা ছাত্রাবাস ১৯৬২ সালে কংগ্রেস কর্মী নিকুঞ্জবিহারী গোস্বামীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠালগ্নেও পাশে ছিলেন সুহাসিনী দাস। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অসহায় ও নির্যাতিত নারীদের আশ্রয় দান করে এখানেই একটি নারী আশ্রম গড়ে তুলেন সুহাসিনী দাস। নির্যাতিত মহিলা ও শিশুদের সংখ্যা বেড়ে গেলে তাদেরকে পুনর্বাসনেরদ লক্ষে শুভাকাঙ্খীদের সাথে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘শ্রীকৃষ্ণ সেবা সদন’।
১৯৭৩ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মহাসম্মেলন নিকুঞ্জ গোস্বামীর সাথে যোগ দেন। সেখানে তাদের অভ্যর্থনা জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাষ্ট্রপতি ভিভিগিরি। দুজন মিলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথা তুলে ধরেন ঐ সম্মেলনে।জানা যায়, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আমন্ত্রণে সুহাসিনী দাস অংশ নিয়েছিলেন ঐ সম্মেলনে।ইন্দিরাগান্ধীর সাথে একান্ত সাক্ষাত ও করেছিলেন তিনি।পরে রাজনৈতিক অঙ্গনে সম্পৃক্ততা থেকে নিজেকে ধীরে ধীরে সরিয়ে এনে সামাজিক ও ধর্মীয় কাজে মনোযোগ দিতে লাগলেন। প্রবাসে মেয়ের সাথে মাঝে কিছুটা সময় কাটিয়ে ফিরে আসেন মাতৃভূমিতে। ১৯৯৩ সালে নিকুঞ্জবিহারী গোস্বামী মারা গেলে রঙ্গিরকূল আশ্রম ছেড়ে চলে আসেন উমেশচন্দ্র-নির্মলাবালা ছাত্রাবাস পরিচালনার দায়িত্বে। ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিক্রি করে ছাত্রাবাসে মেয়েদের থাকার জন্য তৈরী করেন ‘কোঁটিচাঁদ ভবন’।
সুহাসিনী দাসের ধর্মীয় কর্মকান্ডের বিস্তৃতি অনেক। নেপালে বিশ্ব হিন্দু ধর্মীয় মহাসম্মেলনে যোগ দেন ১৯৮৮ সালের ২২ মার্চ। ১৯৯০ সালে ভারতের বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা এদেশেও হিন্দুদের জানমাল ও ধর্মীয়স্থানের উপর প্রভাব ফেলেছিল। এসব দেবস্থলির পুননির্মাণ, হিন্দুদের পাশে থেকে সাহস যুগিয়েছিলেন, তাদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে সুহাসিনী দাস পরিক্রমা ও হরিসভায় সক্রিয় অংশ নেন।
এদেশের নারী সংগঠকদের দিকপাল বৃটিশবিরোধী এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পূর্ব বাংলার বিপ্লবী সুহাসিনী দাসকে ১৯৭৩ সালে ভারতের রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে সংবর্ধিত এবং সমাজসেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রীয় ‘সমাজসেবা’ পুরস্কার দেওয়া হয়। পেয়েছেন রোকেয়া পদক।
সমাজ সেবায় অসামান্য কর্মকান্ডে দ্রুতই তিনি পরিচিতি পান সকলের প্রিয়“ মাসীমা” হিসেবে।‘আমাদের মাদার তেরেসা’ ও বলতেন অনেকে। সমাজ সেবায় বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কর্তৃৃক পুরস্কৃত হন। সুহাসিনী দাস যার নাম সুনামগঞ্জ তথা বৃহত্তর সিলেটের সমগ্র হাওরাঞ্চলে উচ্চারিত হতো সগৌরবে আজ তাঁর নাম জানেনা হাওরের তরুণ প্রজন্ম, জানেনা সিলেটের নারীসমাজ।তাই আজকের এইদিনে হাওর ভিত্তিক সাহিত্য সংগঠণ “হাওর সাহিত্য উন্নয়ন সংস্থা(হাসুস) বাংলাদেশ ” এর পক্ষ থেকে আমাদের জোর দাবি সুহাসিনী দাস’র সকল কর্ম সরকারিভাবে প্রচার ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হোক,যাতে করে তাঁকে অনুস্মরণ করে হাওরের বুকে জেগে উঠতে পারে এমনই আরো সেবামূখী,সাহসী নারীনেতৃত্ব তথা আরো সুহাসিনীদাসেরা।
(তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া,ইত্তেফাক আর্কাইভ ও বিভিন্ন নিউজপোর্টালের লেখা।)
লেখক-
কবিওপ্রাবন্ধিক
প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি,
হাওর সাহিত্য উন্নয়ন সংস্থা(হাসুুুস)বাংলাদেশ
বাংলাদেশ সময়: ১৭:৪০:৩৪ ৭০২ বার পঠিত