আমার এই ধরাবাহিক রচনা বা কলামের মূল উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের এবং সুশীল সমাজের একজন সুনাগরিক হিসেবে (যদিও মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে আমার জন্ম) বাংলাদেশে আমার পরবর্তী প্রজন্মের ও বহিরবিশ্বের সাধারণ পাঠকের কাছে এই উপমহাদেশের ইতিহাসসহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটি পরিস্কারভাবে তুলে ধরা । পশ্চিম পাকিস্হানের চরম দুঃশাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত পেশা এবং শ্রেনীর মানুষ আমাদের জাতির জনক ও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে এদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পরে।পূর্ব -পাকিস্হানের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, চাকুরীজীবী, পুলিশ, আনসার, সেনাবাহিনীর সদস্য, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সরকারী আমলা, সাহিত্যিক, কন্ঠ শিল্পী, নাট্যকর্মী, সিনেমা সংশ্লিষ্ট শিল্পী, খেলোয়ার, সংবাদ কর্মী, রেডিও কর্মী, সংবাদ পাঠক ইত্যাদি সকল পেশার আপামর জণগন যার যার ক্ষেত্র থেকে পশ্চিম পাকিস্হানীদের সঙ্গে দীর্ঘ নয় মাস প্রাণপণে যুদ্ধ করে অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে তারা তাদের সেই অনেক আকাঙ্খিত স্বাধীনতাকে অর্জন করে ৷ আমি মনে করি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পুরাপুরি জানার পূর্বে আমাদের এই উপমহাদেশের পূর্ব ইতিহাসটা এবং সঙ্গে ভারত বিভাজন ও পশ্চিম – পূর্ব পাকিস্হান বিভাজনের ঘটনাগুলো ও একটু জানা দরকার৷ইতিহাস থেকে আমরা জেনেছি, একসময় বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্হান), পাকিস্হান (পশ্চিম পাকিস্হান) এবং ভারত (ভারতবর্ষ) এই তিন জাতি অর্থাৎ এই তিন রাষ্ট্র মিলে একটি দেশ ছিল যার নাম ছিল ‘উপমহাদেশ’ ৷ মূলত: উপমহাদেশে বিরাজমান সংস্কৃতির মতই এর ইতিহাসও অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়।
‘নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – পর্ব- ২’–এ আমরা এই উপমহাদেশের ইতিহাসকে নিমোক্ত দুটো খণ্ডে বিভক্ত করে দেখিয়েছিলাম :
ক. খ্রীষ্টপূর্ব ৭০,০০০ থেকে ৬০ খ্রীষ্টাব্দ: ১.প্রস্তর যুগ (৭০,০০০-৩৩০০খ্রীষ্টপূর্ব) , ২.হরপ্পা ও মহেঞ্জদর সভ্যতা (৩৩০০-১৭০০খ্রীষ্টপূর্ব) , ৩. হরপ্পা সংস্কৃতি (১৭০০-১৩০০খ্রীষ্টপূর্ব) , ৪.বৈদিক যুগ (১৫০০-৫০০খ্রীষ্টপূর্ব) ,৫.লৌহ যুগ (১২০০-৩০০খ্রীষ্টপূর্ব) , ৬.ষোড়শ মহাজনপদ (৭০০- ৩০০খ্রীষ্টপূর্ব) , ৭.মগধ সাম্রাজ্য (৫৪৫খ্রীষ্টপূর্ব- ৩২০ খ্রীষ্টপূর্ব) , ৮.মৌর্য সাম্রাজ্য (৩২১-১৮৪খ্রীষ্টপূর্ব), ৯.মধ্যকালীন রাজ্যসমূহ ( ২৫০খ্রীষ্টপূর্ব) , ১০.চোল সাম্রাজ্য : (২৫০খ্রীষ্টপূর্ব) , ১১.সাতবাহন সাম্রাজ্য ( ২৩০খ্রীষ্টপূর্ব- ৬০ খ্রীষ্টাব্দ)
খ. খ্রীষ্টাব্দ ৬০ থেকে বর্তমান : ১২.কুষাণ সাম্রাজ্য(৬০-২৪০ খ্রীষ্টাব্দ) , ১৩.গুপ্ত সাম্রাজ্য (২৮০-৫৫০ খ্রীষ্টাব্দ) , ১৪.পাল সাম্রাজ্য (৭৫০-১১৭৪ খ্রীষ্টাব্দ) , ১৫. সুলতানী আমল (১২০৬-১৫৯৬ খ্রীষ্টাব্দ), ১৬.দিল্লি সুলতানি (১২০৬-১৫২৬ খ্রীষ্টাব্দ) , ১৭.দাক্ষিনাত্যের সুলতান (১৪৯০-১৫৯৬ খ্রীষ্টাব্দ) , ১৮.হোয়সলা সাম্রাজ্য (১০৪০-১৩৪৬ খ্রীষ্টাব্দ) ,১৯.কাকাতিয়া সাম্রাজ্য (১০৮৩-১৩২৩ খ্রীষ্টাব্দ) ,২০.আহমন সাম্রাজ্য ( ১২২৮-১৮২৬ খ্রীষ্টাব্দ) ,২১.বিজয়নগর সাম্রাজ্য (১৩৩৬-১৬৪৬ খ্রীষ্টাব্দ) , ২২.মুঘল সাম্রাজ্য (১৫২৬-১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দ) ,২৩.মারাঠা সাম্রাজ্য (১৬৭৪-১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দ) ,২৪.শিখ রাষ্ট্র ( ১৭১৬-১৮৪৯ খ্রীষ্টাব্দ) ,২৫.শিখ সাম্রাজ্য ( ১৭৯৯-১৮৪৯ খ্রীষ্টাব্দ) , ২৬.ব্রিটিশ ভারত (১৮৫৮–১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দ) ,২৭.ভারত ভাগ (উপমহাদেশের বিভাজন) -১৯৪৭–বর্তমান ৷
এবং তারই ধারবাহিকতায় আমরা আজ জেনে নেবো :
৮.মৌর্য সাম্রাজ্য (৩২১-১৮৪খ্রীষ্টপূর্ব), ৯.মধ্যকালীন রাজ্যসমূহ ( ২৫০খ্রীষ্টপূর্ব) , ১০.চোল সাম্রাজ্য : (২৫০খ্রীষ্টপূর্ব) , ১১.সাতবাহন সাম্রাজ্য ( ২৩০- ৬০ খ্রীষ্টাব্দ)- এর ইতিহাস৷
৮.মৌর্য্য সাম্রাজ্য (সংস্কৃত: मौर्यसाम्राज्यम्- ৩২১-১৮৪খ্রীষ্টপূর্ব) : প্রাচীন ভারতে লৌহ যুগের একটি বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্য ছিল। মৌর্য্য রাজবংশ দ্বারা শাসিত এই সাম্রাজ্য ৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বদিকে সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমতলভূমিতে অবস্থিত মগধকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র। মৌর্য্য সাম্রাজ্য তৎকালীন যুগের অন্ততম বৃহত্তম সাম্রাজ্য হিসেবে পরিগণিত হত, শুধু তাই নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এর চেয়ে বড় সাম্রাজ্য কখনো তৈরী হয়নি।৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য নন্দ রাজবংশ উচ্ছেদ করে এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং তারপর মহান আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনীর পশ্চাৎ অপসারণের সুযোগে নিজ সামরিক শক্তিবলে মধ্য ও পশ্চিম ভারতের আঞ্চলিক রাজ্যগুলিকে জয় করে বিরাট সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। ৩১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যেই গ্রীক সত্রপগুলিকে পরাজিত করে মৌর্য্য সাম্রাজ্য সম্পূর্ণ উত্তর-পশ্চিম ভারত জুড়ে বিস্তৃত হয়। বর্তমান যুগের মানচিত্রের নিরিখে এই সাম্রাজ্য উত্তরে হিমালয়, পূর্বে অাসাম, পশ্চিমে বালুচিস্তান ও হিন্দুকুশ পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য ও বিন্দুসার এই সাম্রাজ্যকে দক্ষিণ ভারতে বিস্তৃত করেন এবং অশোক কলিঙ্গ রাজ্য জয় করে সমগ্র দক্ষিণ ভারতে মৌর্য্য সাম্রাজ্যের শাসন প্রতিষ্ঠিত করেন। অশোকের মৃত্যুর পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই সাম্রাজ্যের পতন ঘটে ।
৯.মধ্যকালীন রাজ্যসমূহ ( ২৫০খ্রীষ্টপূর্ব) : ভারতের আদি মধ্যযুগীয় রাজ্যসমূহ বলতে বোঝায় খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতে উদ্ভূত রাজনৈতিক শক্তিগুলিকে। ২৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সিমুক কর্তৃক সাতবাহন রাজবংশের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ভারতে আদি মধ্যযুগীয় রাজন্যবর্গের শাসনের সূত্রপাত ঘটে। এই যুগ ভারতের ধ্রুপদি যুগ নামে পরিচিত। এই যুগে বিশ্বের সামগ্রিক অর্থসম্পদের এক তৃতীয়াংশ থেকে এক চতুর্থাংশ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সমগ্র প্রাচীন ও
মধ্যযুগীয় বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে ভারত। এই “আদি মধ্যযুগ” মোটামুটি ১,৫০০ বছর স্থায়ী হয়েছিল। খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে উত্তর ভারতে মুসলিম সালতানাতগুলির উত্থান (১২০৬ সালে দিল্লি সুলতানির প্রতিষ্ঠা) এবং দক্ষিণ ভারতে চালুক্য চোল রাজ্যের পতনের (১২৭৯ সালে তৃতীয় রাজেন্দ্র চোলের মৃত্যু) সঙ্গে সঙ্গে ভারতে আদি মধ্যযুগীয় রাজন্যবর্গের শাসনের সমাপ্তি ঘটে।
১০.চোল সাম্রাজ্য : (২৫০খ্রীষ্টপূর্ব) : চোল রাজবংশ ছিল একটি তামিল রাজবংশ। দক্ষিণ ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে এই সাম্রাজ্যই ছিল সর্বাপেক্ষা দীর্ঘকালীন সাম্রাজ্য। চোল রাজবংশের প্রথম নথিভুক্ত উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে লিখিত সম্রাট অশোকের শিলালিপিতে। বিভিন্ন অঞ্চলে এই রাজবংশের শাসন খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। চোল রাজ্যের মূল কেন্দ্র ছিল কাবেরী নদীর উর্বর উপত্যকা। কিন্তু খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত স্থায়ী চোল সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে এই সাম্রাজ্য আরও বড়ো অঞ্চলে প্রসারিত হয়েছিল।দুই শতাব্দীরও অধিক সময় তুঙ্গভদ্রা নদীর দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত দাক্ষিণাত্যের সকল অঞ্চল এই সাম্রাজ্যের অধীনে এসে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।সম্রাট প্রথম রাজেন্দ্র চোল গঙ্গাতীরবর্তী অঞ্চলগুলি অধিকার করার উদ্দেশ্যে সৈন্য অভিযান প্রেরণ করলে, পূর্বভারতের কিয়দংশ চোল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এছাড়াও রাজেন্দ্র চোল এক প্রবল নৌযুদ্ধের পর শ্রীবিজয়ের মুদ্রিক সাম্রাজ্য উৎখাত সাধন করেন এবং একাধিকবার চীনা আক্রমণ প্রতিহত করেন। ১০১০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে দক্ষিণে মালদ্বীপ থেকে উত্তরে বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের গোদাবরী নদী অববাহিকা পর্যন্ত চোল সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল।রাজরাজ চোল উপদ্বীপীয় দক্ষিণ ভারত জয় করেন, বর্তমান শ্রীলঙ্কা ভূখণ্ডের কিছু অংশ অধিকার করেন এবং মালদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জ নিজ অধিকারে আনেন।
এছাড়া মালয় দ্বীপপুঞ্জের রাজ্যগুলির বিরুদ্ধেও তিনি সফলভাবে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে পাণ্ড্য রাজ্যের উত্থান ঘটলে চোল সাম্রাজ্য পতনের পথে অগ্রসর হতে থাকে। পাণ্ড্য রাজ্যই চোলদের পতনের প্রধান কারণ হয়। চোল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার ছিল সুদূরপ্রসারী। তাঁরা তামিল সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তামিল সাহিত্য ও স্থাপত্যের কিছু মহান নিদর্শন তাঁদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় সৃজিত হয়েছে। চোল রাজারা একাধিক মন্দির ও স্থাপনা নির্মাণ করেন। এই মন্দিরগুলি কেবলমাত্র ধর্মোপাসনার স্থানই ছিল না, বরং এক একটি প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে উঠেছিল।তাঁরা ছিলেন একটি কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থার পথপ্রদর্শক এবং একটি নিয়মতান্ত্রিক আমলাতন্ত্রের উদ্ভাবক।
১১. সাতবাহন সাম্রাজ্য ( ২৩০খ্রীষ্টপূর্ব – ৬০ খ্রীষ্টাব্দ) : সাতবাহন সাম্রাজ্য একটি প্রাচীন ভারতীয় সাম্রাজ্য যা খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে পরবর্তী সাড়ে চারশত বছর ধরে দক্ষিণ ভারতে বিস্তৃত ছিল ( ২৩০- ৬০ খ্রীষ্টাব্দ) । সাতবাহন সাম্রাজ্যের রাজধানী- Koti Lingala. মৌর্য্য সাম্রাজ্যের সামন্ত রাজ্য হিসেবে সাতবাহনরা গণ্য হলেও মৌর্য্য সাম্রাজ্যের পতনের পর শুঙ্গ ও কাণ্ব রাজবংশের সঙ্গে যুদ্ধ করে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। পরবর্তীকালে তারা পশ্চিমী ক্ষত্রপ রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
উল্লেখ্য, আমরা পরবর্তী বেশ কয়েকটি পর্বে শুধু উপমহাদেশের ইতিহাসটি বিশদভাবে জেনে নেবো এবং এর পর পরই ১৯৪৭ সাল থেকে আমরা আবার ফিরে আসবো –আমদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আলোচনায়। (চলবে )
তথ্যসূত্র: বুকস, ইন্টারনেট
লেখক : ফারহানা আকতার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, লেখক এবং গবেষক ৷
বাংলাদেশ সময়: ১১:৪২:৪৯ ১০০৫ বার পঠিত #নতুন প্রজন্ম #প্রবন্ধ #বাংলা #মুক্তিযুদ্ধ