বঙ্গ-নিউজ ডটকম :টেবিলের ওপর পেয়ালা নামিয়ে রাখতে রাখতে শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করেন, ‘পড়াশোনা কেমন হচ্ছে তোমাদের?’ ছেলেমেয়েদেরও সমস্বরে উত্তর, ‘ভালো হচ্ছে দাদু।’ মুহূর্তেই ঠোঁটে ঝুলে থাকা হাসি ছড়িয়ে পড়ে সারামুখে। এরপর হৃষ্টচিত্তে শ্রেণীকক্ষ থেকে বেরিয়ে যান তিনি।
তিনি আবদুল খালেক। বয়স ৮২। পেশায় চা দোকানদার, দিন চলে চা বেচে। কিন্তু স্বপ্ন দেখেন, যে স্বপ্ন নিজের জন্য নয়, দেশের জন্য দশের জন্য। এছাড়া আরো একটি পরিচয় আছে তার। তিনি এ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। কুমিল্লা বরুড়ার নলুয়া চাঁদপুর গ্রামে তার বাড়ি। সে গ্রামেই বছর ১৬ আগে প্রতিষ্ঠা করেন বিদ্যালয়টি। নাম দেন নলুয়া চাঁদপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এরপর থেকে শিক্ষার্থীরা তাকে দাদু বলে ডাকে। অনেকের কাছে এটি ‘দাদুর স্কুল’ নামে পরিচিত।
বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন! তাই লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটেন। যতই কষ্ট হোক দিনে দুইবার আসেন বিদ্যালয়ে। খোঁজ-খবর না নিলে ঠিক ঘুম আসে না। প্রতিদিনের মতো খালেক বিদ্যালয়ের বারান্দা ধরে এগোচ্ছেন। বাঁ হাতে চায়ের পেয়ালা। ঢুকে পড়েন এক শ্রেণীকক্ষে। তাকে দেখে শিক্ষক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আপনি আবার কষ্ট করে …।’ জবাবে মানুষটি স্মিত হাসেন।
কুমিল্লা-চাঁদপুর আঞ্চলিক মহাসড়ক লাগোয়া নলুয়া চাঁদপুর গ্রাম। ১৯৩০ সালে এ গ্রামে আবদুল খালেকের জন্ম। ১৯৪২ সালে চাঁদপুর শাহরাস্তির বিজয়পুর উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। পারিবারিক টানাপড়েনের কারণে পড়াটা এগোয়নি। মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে নানা জিনিস বেচতেন। এক সময় চা বিক্রি শুরু করেন। পাকিস্তান আমলের কথা। মহাসড়কের পাশে একটি দোকান দেন। সে দোকানে চা খেতে ভিড় জমাত অনেকে। পড়াশোনা বেশি না করলেও আবদুল খালেক কথা বলেন শুদ্ধ উচ্চারণে। এ নিয়ে গ্রামের অনেকে ব্যঙ্গ করত। বিষয়টি তাকে কষ্ট দিত। তিনি ভাবতেন, শিক্ষিত না হলে গ্রামের মানুষ শোধরাবে না। কিন্তু এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। ছেলেমেয়ে পড়বে কোথায়! সে থেকে বিদ্যালয় গড়ার স্বপ্ন। স্বপ্ন পূরণে তিনি হারিয়েছেন প্রিয়তম স্ত্রীকেও। সকিনা আক্তার ও আবদুল খালেক দম্পতির ঘরে ছেলেমেয়ে ছিল না। ১৯৯৯ সালের ৫ অক্টোবর বিদ্যালয় দেখতে যান সকিনা। বাড়ি ফেরার পথে বিদ্যালয়ের সামনে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তিনি। জিপ গাড়ি চাঁদপুরের দিকে যাচ্ছিল। সকিনার শাড়ির আঁচল গাড়ির পেছনে আটকে যায়। এরপর ঘটে দুর্ঘটনা। পরে স্থানীয় লোকজন তার মরদেহ উদ্ধার করে। তারপর থেকে খালেক একা। বিদ্যালয়ের পাশেই তার চায়ের দোকান। দোকানে থাকেন সারাদিন, রাতে সেখানেই ঘুমান। সারাদিনের বেচাকেনায় শ’ তিনেক টাকা পান। তা দিয়েই চলে তার এক সদস্যের সংসার।
খালেকের স্বপ্ন বাস্তবে এসে ধরা দেয় বহু বছর পর। মুক্তিযুদ্ধের আগে সড়কের পাশে চা বেচার টাকাতে। ৫২ শতাংশ জমি ৭ হাজার টাকায় কিনেছিলেন। ১৯৯৬ সালের শেষ দিকে সে জমিটুকু বিদ্যালয়কে দান করে দেন। আবদুল খালেক বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেখলাম এলাকায় শিক্ষিতের হার বাড়ছে না। বহু লোক নিরক্ষর। যারা শিক্ষিত তাদের সম্মান নেই। ওই ভাবনা থেকেই মনে করলাম, এমন কাজ করতে হবে যাতে মরলেও মানুষ স্মরণ করে।’
গ্রামের অনেকেই তার স্বপ্নের কথা জানতেন। জমি দানের পর কেউ টিন দেন, কেউ বাঁশ-কাঠ, কেউ বা দেন টাকা। গ্রামের মানুষের সহায়তায় দাঁড়িয়ে যায় ৬০ ফুট টিনের ঘরটি। সাইনবোর্ডে প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে লেখা হয় আবদুল খালেকের নাম। বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক মো. সফিউল্লাহ বলেন, ‘এখন স্কুলে সাড়ে ৮৬ শতক জমি আছে। এর মধ্যে আবদুল খালেক ৫২ শতক দিয়েছেন। বাকি সাড়ে ৩৪ শতক এলাকার লোকজন চাঁদা তুলে কিনেছেন।’ এলাকাবাসী জানায়, তারা সহযোগিতা করেছেন ঠিকই। কিন্তু বাতি জ্বালিয়েছেন আবদুল খালেকই। টিনের লম্বা ঘরটিতে চারটি শ্রেণীকক্ষ। এ ঘরের পশ্চিমে আছে তিন কক্ষবিশিষ্ট একটি আধপাকা ভবন। এর একটিতে শিক্ষকরা বসেন, বাকি দুটি শ্রেণীকক্ষ। বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রথম সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘আমাকে জায়গাটি দেখিয়ে একদিন বলেছিলেন, এখানে হাইস্কুল হবে। আপনি হবেন এর প্রথম সভাপতি। এত বড় ত্যাগ আমাদের সমাজে এখনকার মানুষের মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না।’
১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি ৭০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে নলুয়া চাঁদপুর নিু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। এমপিওভুক্ত হয় ২০০৪ সালে। বর্তমানে এখানে পাঁচজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক আছেন। আছেন খণ্ডকালীন আরো পাঁচজন শিক্ষক। ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থী আছে ২০৫ জন। গত বছর থেকে নবম-দশম শ্রেণীর শিক্ষা কার্যক্রম চালুর মধ্য দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি উচ্চবিদ্যালয়ে উন্নীত হয়েছে।
সম্প্রতি বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষকদের চা খাওয়ানোর ওই দৃশ্য দেখা যায়। অবশ্য এখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। আগের মতো রোজ চা-বিস্কুট নিয়ে যেতে পারেন না। আবদুল খালেকের কথায়, ‘চা পানে ক্লান্তি দূর হয়, পাঠদানেও আগ্রহের সৃষ্টি হয়। শিক্ষকদের সতেজ রাখার জন্য চা খাওয়াই।’
আবদুল খালেক চা বানান, আর শিক্ষার্থীদের হই-হুল্লোড় দেখেন। এসব দেখে তার প্রাণ জুড়িয়ে যায়। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। সন্তান নেই বলে কোনো দিন বাবা ডাক শোনেননি। তাই শিক্ষার্থীরা যখন দাদু বলে তখন তিনি খুব খুশি হন। শিক্ষার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ উজ্জ্বীবিত করে।
বাংলাদেশ সময়: ০:১৪:২৮ ৫৩৬ বার পঠিত