ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও দলটির প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলই একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও ভালো নির্বাচনের কথা বলে। চিন্তক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও সাধারণ্যের বক্তব্য-মন্তব্য-বিবৃতিও ভালো নির্বাচনের পক্ষেই। গণমাধ্যমেও প্রচারিত-প্রকাশিত প্রতিবেদন বা কলামে একটি সুন্দর নির্বাচনের ছবি আঁকা থাকে। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন থেকে একেবারে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত সর্বত্রই ভালো নির্বাচনের প্রত্যাশার কথাই শোনা যায় ক্ষমতার ভেতরে-বাইরে সব মহলে। ছোট-বড়, ডান-বাম, ডানে-বামে মিশ্রিত কোনো রাজনৈতিক সংগঠনই কখনো লোকসম্মুখে মন্দ নির্বাচনের কথা বলে না। কিন্তু সবাই যেমন নির্বাচন চান বা প্রত্যাশা করেন, সেই ধরনের নির্বাচনের জন্য জনগণসহ সবাই কতটা প্রস্তুত?
অভিজ্ঞতার ভান্ডারে সমৃদ্ধ, ত্রিকালদর্শী ও প্রাজ্ঞজনদের মতে, গণতন্ত্রের প্রধান দুটি স্তম্ভ হলো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও সংস্কৃতি। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর দিকটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত নির্বাচনি কাঠামোটি গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চলছে। এই কাঠামোর ভিত্তি কতটা মজবুত, প্রক্রিয়া কতটা স্বচ্ছ, তা নিয়ে প্রশ্ন বা মতান্তর থাকতে পারে বা আছেও। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চলমান তিন মেয়াদে উপজেলা ও জেলা পরিষদ পুনরুজ্জীবিত হয়েছে, বেড়েছে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের সংখ্যাও। দল-মতভেদে শত প্রশ্ন থাকলেও তৃণমূল থেকে আইনসভা পর্যন্ত নির্বাচনি কাঠামোটা একটা রূপ পেয়েছে। সব স্তরে নির্বাচন প্রক্রিয়াটা জারি আছে। ভূরাজনীতির নতুন ভুবনে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল কোনো দেশের জন্য অন্তত এটাকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।
গণতন্ত্রের দ্বিতীয় প্রধান স্তম্ভ ‘সংস্কৃতি’। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, একেবারে তলানিতে বা খাদের কিনারে না হলেও রাজনৈতিক, সামাজিক ও নির্বাচনি সংস্কৃতির দিক থেকে দেশ এক পা এগোয় তো কখনো আবার দুই পা পিছিয়ে যাচ্ছে। চিন্তক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা ভালো নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসেবে এই সংস্কৃতির ওপরই বেশি গুরুত্বারোপ করছেন। তাদের মতে, দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও নির্বাচনি সংস্কৃতির উন্নয়ন না ঘটলে বিদ্যমান পরিবেশে ভালো নির্বাচনের প্রত্যাশা সুখস্বপ্নই মাত্র।
সবাই যেমন নির্বাচন দেখতে চান, সামগ্রিক সংস্কৃতিতে সেটি কতটা সম্ভব? কোটি টাকার এই প্রশ্নটি রাখা হলো সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের কাছে। রাখঢাক না করেই তিনি বললেন, ‘আমরা সবাই যেরকম একটা ভালো নির্বাচনের কথা বলছি, সেটির সম্ভাবনা এই মুহূর্তে দেখছি না। আমি কোনো লক্ষণ দেখি না। পরিস্থিতি দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে। একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যে ধরনের প্রেক্ষাপট থাকার কথা, তা নষ্ট হয়ে গেছে। সত্যি কথা বলতে, নির্বাচন প্রক্রিয়ার গুণমানের যে নিম্নগতির ধারা চলমান, তাতে আপাতত ভালো নির্বাচন সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না। ভালো নির্বাচনের জন্য সদিচ্ছাই যথেষ্ট। কোনো সরকার বা দলের কথা বলছি না; রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন (ইসি), প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রার্থী ও ভোটারদের সবার সদিচ্ছা দরকার। তা না হলে সবাই যে ধরনের নির্বাচনের কথা বলেন, সেটি অসম্ভব।’
বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক-সামাজিক-প্রশাসনিক যে সংস্কৃতি দেশে গড়ে উঠেছে, সেটি এক দিনে হয়নি। কোনো একটি নির্দিষ্ট দলের শাসনামলেও হয়নি। এই সংস্কৃতির দায় কম-বেশি সবারই। এমনকি আমজনতা কিংবা ভোটাররাও দায় এড়াতে পারেন না। ধারাবাহিকভাবেই আলোচ্য সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। সেই বিচার-বিশ্লেষণে অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত কোনো স্তরেই, কোনো নির্বাচনই সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত ছিল না। তাছাড়া অন্যান্য দেশেও একেবারে বিশুদ্ধ নির্বাচনের নজির মেলে না। বিশ্ব জুড়েই, বিশেষ করে এই উপমহাদেশেও রকমফেরভেদে প্রায় অভিন্ন সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে বা উঠছে। ভূরাজনীতির যুগে বাংলাদেশও সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। বিচ্ছিন্ন থাকার সুযোগও নেই।
সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনি প্রক্রিয়া নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজন। সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, দেশে রাজনীতি ও প্রশাসনিক কাঠামোর সামগ্রিক যে সংস্কৃতি, তাতে সবাই যে ধরনের একটা নির্বাচনের স্বপ্ন দেখেন, সেটি প্রায় অসম্ভব। সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত হলো, এটার স্টেক হোল্ডার বা অংশীজন বলতে যাদের বোঝায়, সেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের সদিচ্ছা থাকতে হবে। অতীতের বিভিন্ন সরকারের আমল থেকে শুরু করে ক্রমাগতভাবে আমাদের এখানে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয়করণের বিষ ঢোকানো হয়েছে। একইভাবে নাগরিক সমাজও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত।
সংবিধানে নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার মূল দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের (ইসি)। তবে বিভিন্ন গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে প্রতীয়মান যে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে প্রয়োজন শরিকদের পূর্ণ সহযোগিতা। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ শরিকদের মধ্যে সরকার, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও মিডিয়ার সহযোগী ভূমিকা স্বীকৃত। এ ধরনের সহযোগিতা যেমন সহজে পাওয়া যায় না, তেমনি সহযোগিতা আদায় করার প্রয়াসও সচরাচর দৃষ্টিগোচর হয় না।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ইসিকে অগাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও স্বচ্ছ নির্বাচন পরিচালনার জন্য। ইসিকে যতটা ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা সাংবিধানিক অথবা আইন দ্বারা গঠিত অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া হয়নি। নির্বাচনি আইন ও বিধির প্রতি সম্মান দেখানোর দায়িত্বও রাজনৈতিক দলের এবং দলের প্রার্থীদের। কিন্তু নির্বাচন ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কমিশন রাজনৈতিক দলের কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা পায় না। একটা ভালো নির্বাচন পেতে হলে ইসির সহযোগী হয়ে নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে গ্রহণযোগ্য করার শুরু থেকেই রাজনৈতিক দলের সক্রিয়তা প্রয়োজন।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেনের মতে, নির্বাচন কমিশনের যে ক্ষমতা, তারাও সেটির সঠিক চর্চা করছে না, যার কারণে পরিবেশ দিনে দিনে আরো খারাপ হচ্ছে। ইসি পদক্ষেপ নিলে সেটি কার্যকর হতো কি হতো না, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু ইসির পদক্ষেপই প্রতীয়মান নয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৬:২২:০৭ ৫৬৩ বার পঠিত #আওয়ামী লীগ #নির্বাচন #বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক...