মিজানুর রহমান শাকিল;প্রতিনিধি;বঙ্গনিউজঃআলুর বাজারে দুষ্টচক্র তৈরি হয়েছে। কেজিপ্রতি ২০ টাকা বিক্রি করলেই যেখানে লাভ হয়, সেখানে দ্বিগুণেরও বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। হিমাগার পর্যায়ে আলু বিক্রি হচ্ছে ৪৩ টাকা কেজি। খুচরা বাজারে এসে দাম ৫৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। অথচ সরকারি-বেসরকারি সব হিসাবেই এই মুহূর্তে আলুর কোনো ঘাটতি নেই দেশে। সরবরাহে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অতিমুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছেন হিমাগারে আলু সংরক্ষণকারী ব্যবসায়ীরা। এই কৃত্রিম সংকট ও অতিমুনাফার বিষয়টি উঠে এসেছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনেও। অথচ চাল ও পেঁয়াজের মতো আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণেও ব্যর্থ হয়েছে সরকার।
এ অবস্থায় গতকাল সরকার আলুর বাজারের নৈরাজ্য ঠেকাতে খুচরা, পাইকারি ও হিমাগার—তিন পর্যায়ে দাম বেঁধে দিয়েছে। খুচরা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৩০ টাকা দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।
আলুর উৎপাদন, খরচ, বাজারে দাম এবং হিমাগারে সংরক্ষণ বিষয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। এতে আলুর বাজারে কৃত্রিম সরবরাহ সংকট ও অতিমুনাফার বিষয়টি উঠে আসে। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অধিদপ্তর আলুর খুচরা, পাইকারি ও হিমাগার পর্যায়ে দাম বেঁধে দেয়। হিমাগার পর্যায়ে ২ থেকে ৫ শতাংশ মুনাফা যোগ করে ২৩ টাকা, পাইকারি পর্যায়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশ মুনাফা যোগ করে ২৫ টাকা এবং খুচরা পর্যায়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মুনাফা যোগ করে সর্বোচ্চ ৩০ টাকা বেঁধে দেয়। এদিকে সংকট দূর করতে ব্যবসায়ীদের প্রতি হিমাগার থেকে আলু সরবরাহ বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএসএ)।
করোনা পরিস্থিতিতে লকডাইন শুরু হলে অন্যান্য সবজির দাম যখন একেবারেই তলানিতে তখন ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে আলুর দাম। মাসখানেক আগে খুচরা পর্যায়ে ৩৮ থেকে ৪০ টাকায় দাম ওঠে। তার পর ৪৫ টাকা, গত সপ্তাহের শেষ দিকে হঠাৎ দাম আরো বাড়িয়ে ৫০ টাকায় বিক্রি করেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। এখন কোথাও পণ্যটি ৫৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে দেখা যায়। শ্যামবাজার, যাত্রাবাড়ী, কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন পাইকারি বাজারে গতকাল আলু বিক্রি হয়েছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা কেজি। অনেক হিমাগারে আলু বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৩ টাকা দরে। কোথাও কোথাও ৩৫ থেকে ৩৭ টাকা কেজি।
অথচ কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলছে, হিমাগারে রাখা আলুর মৌসুমের কেনা দাম, হিমাগার ভাড়া ও অন্যান্য খরচ মিলে প্রতি কেজি আলুর হিমাগার গেটে দাম পড়ে ১৮ টাকা ৯৯ পয়সা। অর্থাৎ হিমাগার থেকে ২০ টাকা বিক্রিতেই লাভবান ব্যবসায়ীরা।
কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এখন যে আলু বাজারে পাওয়া যাচ্ছে তার উৎপাদন খরচ আট টাকা ৩২ পয়সা। গত ফেব্রুয়ারি মাসে হিমাগারে আলু সংরক্ষণের সময় প্রতি কেজি আলুর দাম ছিল ১৪ টাকা। এর সঙ্গে হিমাগার ভাড়া কেজিতে তিন টাকা ৬৬ পয়সা, গ্রেডিং চার্জ ৪৫ পয়সা, ওজন হ্রাস ৮৮ পয়সা ধরে প্রতি কেজি আলুর হিমাগার গেটে দাম পড়ে ১৮ টাকা ৯৯ পয়সা।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলছে, গত মার্চে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয় বাংলাদেশে, তখনও সবজিটি হিমাগার পর্যায়ে বিক্রি হয়েছে ২২ টাকা ৫০ পয়সা কেজি দরে। সে সময়ও সংরক্ষণকারী আলু ব্যবসায়ীর লাভ ছিল কেজিতে তিন টাকা ৫১ পয়সা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জুলাই-আগস্টে অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে হিমাগার ব্যবসায়ীরা আলু খালাস বন্ধ করে দিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ও অবৈধ মজুদ গড়ে তোলেন। তাঁরা চাহিদার তুলনায় কম আলু খালাস করে হিমাগার পর্যায়ে সবজিটির দাম কেজিতে ২৮ টাকায় নিয়ে যান। ফলে গত আগস্টে সেই আলু খুচরা বাজারে এসে ৩৫ টাকায় বিক্রি হয়।
কোল্ট স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আলুর এমন দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীদের অতিমুনাফার লোভকে দায়ী করা হয়েছে। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোশারফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশে আলু এ মৌসুমে কিছুটা কম হয়েছে ঠিক। কিন্তু এখনো দেশে আলুর কোনো ঘাটতি নেই। তবে ভবিষ্যতে হতে পারে এই ধারণা থেকেই আলুর সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। কোনো কোনো স্টোরেজ থেকে আলু উত্তোলনই করছেন না আলুর মালিকরা।’
অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে প্রায় সাড়ে চার লাখ হেক্টর জমিতে এক কোটি ৯ লাখ টন আলু হয়েছে। দেশে আলুর চাহিদা ৭০ লাখ টন। সে হিসাবে উদ্বৃত্ত আলুর পরিমাণ প্রায় ৩৯ লাখ টন। আগস্ট পর্যন্ত হিসাবে দেখা যায়, দেশে ৩৬৯টি হিমাগারে ৩০ লাখ টন আলু মজুদ আছে। উৎপাদনের ২৭ শতাংশ আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয়েছে। অবশিষ্ট আলু কৃষক পর্যায়ে সংরক্ষণ হয়। তবে এ তথ্যের সঙ্গে কিছুটা ভিন্নমত রয়েছে কোল্ট স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের। তারা বলছে, ২০১৯-২০ মৌসুমে প্রায় ৮৫ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে, এর মধ্যে হিমাগারগুলোতে ৪০ লাখ টন সংরক্ষণ করা হয়েছে। গত সপ্তাহ পর্যন্ত ৫৫ শতাংশ (২২ লাখ টন) আলু হিমাগারগুলো থেকে উত্তোলন করা হয়েছে। বাকি আলু থেকে ১০ লাখ টন বীজআলু হিসেবে রাখতে হবে। অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, এবার তারা আগের বছরের চেয়ে ২০ শতাংশ কম আলু সংরক্ষণ করেছে, যার পরিমাণ প্রায় ৪৫ লাখ টন। গত বছর তারা ৫৫ লাখ টন আলু সংরক্ষণ করেছিল।
মুন্সীগঞ্জ : আলুর কিছুটা টানাটানি আছে ঠিকই, তবে মজুদও পর্যাপ্ত রয়েছে। জেলায় ৬৮টি কোল্ড স্টোরেজ রয়েছে। এগুলোতে মুজদ করা হয়েছিল প্রায় পাঁচ লাখ টন আলু। জেলায় খুচরা বাজারে আলুর দাম ৪৫-৫০ টাকা কেজি। মঙ্গলবার মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুরের রিভার ভিউ কোল্ড স্টোরেজের মালিক গোলাম মোস্তফা জানান, প্রায় এক লাখ ৮১ হাজার বস্তা আলু ধারণক্ষমতা থাকলেও মজুদ রয়েছে ৭০ হাজার থেকে ৭২ হাজার বস্তা। এর অর্ধেকটা বাজারজাত করা হবে। বাকি অর্ধেক বীজ হিসেবে ব্যবহার করা হবে। ৩৫ থেকে ৩৭ টাকা দরে এখানে আলু বিক্রি হচ্ছে।
বগুড়া : বগুড়ার বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজিতে। গত দুই যুগের মধ্যে আলুর এমন আকাশছোঁয়া দাম কেউ দেখেননি বলে জানিয়েছেন ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই। এবার বগুড়ায় ৫৫ হাজার ৪৫৪ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা গত মৌসুমের চেয়ে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর কম। প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১২:৩৫:৩৫ ৪৬২ বার পঠিত #আলু #পাইকারি #বিক্রি