মিজানুর রহমান শাকিল; বঙ্গনিউজঃ‘আমার সব জায়গা জমি নদী নিয়ে গেছে। গ্রামের সরকারি জায়গায় কয়েক বছর ছিলাম। নেতারাও সেখান থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। পরে ঢাকায় চইলা আইছি। এখন বউডা লইয়া রাস্তার পাশে ফুটপাথে থাকি। দিনের বেলায় কাগজ টোকাই, রাত হলে পলিথিন দিয়ে খুপরি ঘর করে থাকি। সকাল হলেই রাতের তৈরি খুপরি ঘরটি নিজেই ভেঙে ফেলি।’- এ গল্প পটুয়াখালী থেকে আসা রফিজল হকের। বর্তমানে ওসমানী উদ্যানে তার বসবাস।
নির্দিষ্ট কোনো স্থান নেই পঞ্চাশোর্ধ্ব এই বৃদ্ধের। তিনি জানান, আগে গ্রামে নিজের জায়গা জমিতেই চাষবাস করতেন। সংসার জীবনে কোনো সন্তানাদি নেই। ৯ বছর আগে ফসলি জমিসহ বসতভিটা নদীতে চলে গেছে। পরে সরকারি জায়গায় ঘর তুলে কিছুদিন থাকার পর প্রভাবশালীদের চাপে এলাকা ছেড়ে বউ নিয়ে ঢাকায় আসেন। প্রথমে মিরপুরের এক বস্তিতে উঠলেও, সেখানে ভাড়া পরিশোধ করতে না পারায় বস্তি থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। পরে ঠাঁই হয় ফুটপাথে। এখন গুলিস্তান এলাকায় ওসমানী উদ্যানের ভিতর খুপরিঘর তুলে থাকেন। আর বউ গুলিস্তানে রাস্তার পাশে বসে ভিক্ষা করেন। বৃষ্টির দিনে কষ্টের সীমা থাকে না তাদের। কমলাপুর স্টেশনের পাশেই থাকেন জুলেখা। রাজধানী ঢাকায় তার একমাত্র আপনজন ৫ বছরের কন্যাশিশু। এই স্টেশনের বাইরে তার তেমন জানাশোনা নেই। ৪ বছর ধরে স্টেশন এলাকায় তার বসবাস। জুলেখা জানান, ময়মনসিংহ তার গ্রামের বাড়ি। এক সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা-মা মারা যাওয়ার পর তার গ্রামের এক চাচার সঙ্গে ঢাকায় আসেন। বিভিন্ন বাসাবাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। পরে এক রিকশাচালকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তারা কমলাপুরের একটি বস্তিতে থাকতেন। বিয়ের ১ বছরের মাথায় কন্যাসন্তান জন্ম হলে স্বামী তার ওপর নানা নির্যাতন শুরু করেন। পরে তাকে ছেড়ে চলে যান। এরপর থেকেই রেল স্টেশনে কুলির কাজ আর ভিক্ষা করে শিশুকন্যাকে নিয়ে স্টেশনেই থাকতেন। করোনার কারণে স্টেশনে থাকতে না দেয়ায় তার পাশেই ফুটপাথে আশ্রয় নেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকায় ভাসমান মানুষের সংখ্যা প্রায় লক্ষাধিক। ক্রমেই বাড়ছে এর সংখ্যা। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ঢাকায় ভাসমান মানুষের সংখ্যা ৭ হাজারের একটু বেশি। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভাসমান মানুষ নিয়ে পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য সঠিক নয়। বাস্তবে এর সংখ্যা কয়েক লাখ ছাড়িয়ে যাবে। এছাড়া গত ছয় বছরে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এ নিয়ে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। গত শনিবার সরজমিনে দেখা যায়, রাত ৮টা নামতেই বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের চারপাশে ভাসমান মানুষের ভিড়। কেউ বিছানা করছেন, কেউবা ঘুমিয়ে পড়ছেন। অনেকেই নেশায় মেতেছেন। একই চিত্র গুলিস্তান মাজার ও ওভারব্রিজ এলাকায়। ওসমানী উদ্যানে রাতে ঘুমান কয়েকশ’ নারী-পুরুষ। ভাসমান এসব মানুষের নির্দিষ্ট কোনো স্থান না থাকায় যে যেখানে পারছেন, সেভাবেই রাত যাপন করছেন। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় গুলিস্তান, স্টেডিয়াম, রাজউক, ওসমানী উদ্যান এলাকায় প্রায় ৩/৪ হাজারের মতো ভাসমান রয়েছেন। ফার্মগেট ওভারব্রিজের নিচে অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় ঘুমিয়ে আছেন কয়েকজন যুবক। তাদের মধ্যে নারীও শিশু রয়েছেন। এদের অনেক হাত কিংবা পা নেই। এদের কেউ পলিথিনে গাম নিয়ে নেশা করছেন, কেউ গাঁজা, ড্যান্ডি সেবনে ব্যস্ত। তাদেরই একজন পথ শিশু সেলিম। বয়স ৯ কিংবা ১০। জানে না বাবা মায়ের পরিচয়। ফুটপাথেই কাটে তার দিনরাত। এক পোশাকেই চলে মাসের পর মাস। গোসল করেনি কত দিন, ঠিক মনে নেই তার। জানতে চাইলে সেলিম বলেন, ছোট থেকেই রেললাইন ও ফার্মগেট এলাকায় আছি। বাবা মা কে জানি না। আগে পাশের ওই র্পাকে থাকতাম। এখন সেখানে মেট্রোরেলের অফিস হওয়ায় ওভার ব্রিজের নিচে থাকি। রাতে বস্তা বা প্লাস্টিক বিছিয়ে শুয়ে থাকি। মাছি ও মশা কামড়ায়। দিনের বেলায় কাগজ টোকাই। কেউ খাবার দিলে খাই। অনেক সময় খাবার না পাইলে চুরি-ছিনতাই করি। ধরা পরলে অনেক মার খেতে হয়। পুলিশ এসে মারে। আবার ছেড়েও দেয়। ভাসমান এসব মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি বছরের বন্যা, নদী ভাঙ্গনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে ঢাকায় আসেন তারা। চাকরি ও থাকার স্থান না পেয়ে বেশির ভাগের ঠাই মিলছে রাস্তায়। কাওরান বাজার এলাকায় ভাসমান মানুষের জীবন চিত্র একটু ভিন্ন। এখানেই প্রায় ২ হাজারের কাছাকাছি ভাসমান মানুষের বাস। তারা দিনের কর্মব্যস্ততার পর বিভিন্ন আড়তে দলবদ্ধ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কোথাও ঘুমিয়ে পড়ে একটু খালি জায়গা পেলে। সন্ধ্যা নামলেই প্রধান সড়কের পাশের আইল্যান্ডের উপর নিজেদের সবজির টানার ঝুড়িতে ঘুমিয়ে পড়েন। কেউবা ভ্যানের উপর, রেল লাইনের পাশে, নয়তো বিভিন্ন অফিসের নিচে। এভাবেই চলে ভোর রাত পর্যন্ত। কয়েক হাজার ভাসমান মানুষ শুধু কাওরান বাজারেই ফুটপাথেই জীবনযাপন করেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ আরবান হেল্থ জরিপের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ঢাকায় যেসব ভাসমান মানুষ বাস করে তার মধ্যে একই বস্তি বা ফুটপাত থেকে আসে শতকরা ৪১.৯ ভাগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, সুনির্দিষ্ট এলাকায় ভাসমান মানুষের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়ে তাদেরে জন্য কাজ করতে হবে। কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিলে ভাসমান মানুষের সংখ্যা কমে যাবে। এদের থাকার বা আবাসনের সুযোগ করে দিতে সিটি করপোরেশনকে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন এনজিওগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ২৩:৪৩:৫৯ ৪৯৩ বার পঠিত # #টোকাই #ভাসমান