মমতাজ বেগম প্রিয়াংকাঃ চট্টগ্রাম
লোকে বলে—ভূতের বাড়ি, আত্মাদেরও নাকি অনেকেই দেখতে পেয়েছেন বাড়ির ভিতরে, মাঝে মধ্যে অনেকেই কান্নার শব্দ শুনতে পান।
এ বাড়িতে আমি একাই থাকি।আমার প্রিয়জনেরা যারা এ বাড়িতে থাকতেন সবাই একের পর এক মারা যায়। তা হয়ে গেল বেশ কয়েক বছর। আমিই একমাত্র রয়ে গেছি এ বাড়িতে। আমি একা, একাই ভাল আছি। একা একা বেঁচে থাকা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে অনেক কাল।
বৃষ্টি পড়ছে। আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। অল্প অল্প বৃষ্টি। বিকেল গড়িয়ে গেলো কিন্তু বেয়াদব বৃষ্টি থামেনি। বাড়িতেই পুরো দিন, পুরো সন্ধ্যা।
আমি বসে আছি। আমার সামনে কেও একজন বসে আছে। আমি আর লোভ সামলাতে পারছি না। সরাসরি প্রশ্ন
—আপনি কে?
—আমি কে সেটা যেনে কি করবে বন্ধু?
—আচ্ছা বন্ধু, আপনি এলেন কোথা থেকে?
সে হেসে উঠে বলে,
—কেন, এই বাড়িতেই তো থাকি আমি।
—এ বাড়িতে! তার মানে লোকে যে বলে এইটা ভূতের বাড়ি , সেটা সত্যি তাহলে!
—আজ্ঞে, সেটা তো সত্যিই
—তার মানে আপনি পাসিং স্পিরিট
—তা বলতে পারেন, পাসিং স্পিরিট।
—কিন্তু আপনি এইখানে কেনো এলেন?
—আজ্ঞে, আমি আপনার সাথে একটু গল্প করতে আসলাম। আমি আপনার ব্যাপারে সবই জানি।
—কিন্তু আপনি জানেন কীভাবে?
—সব কিছুই জানি মশাই, ভূতেদের সব কিছু জানতে হই।
—বলেন কি!
—ঠিকই বলছি মশাই, রহমানের বাগানে আমচুরি, মিঠুনদের ঘাটে কলেজ লাইফে বন্ধুদের সঙ্গে প্রথম বিড়ি খাওয়া, নিজের ঘরে বসে সাইলার কথা মনে করে নিজেকে আদর করা, তার পর এর ওর মন কাঁদিয়ে ব্যাচেলার জীবন কাটিয়ে দেওয়া,সবই আমি জানি।
ওর কথাগুলোয় আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানি বের করে আনলে যেমন বিন্দু বিন্দু করে বোতলের গায়ে পানি জমে, তেমনই আমারও কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছে।
সে বলে ওঠে
—পানি খাবেন?
—না, থাক।
—চা কিংবা কফি…কিংবা আপনার প্রিয় স্কচ…
—এইটাও জানেন!
—এসব কথা বাদ দিন এখন। আগে আপনি একটু সুস্থ হয়ে নিন…আমি বুঝতে পারছি আপনার মাথার মধ্যে অনেক খানি চাপ দিয়ে ফেলেছি আমি।
—তা দিয়েছেন ঠিকই।
—পানি খাবেন? দাড়ান আমি নিয়ে আসছি।
মিঠুনদের ঘাটে দুপুর গড়ালেই আমাদের ভিড়। পুকুর ঘাটে উমাভাবি দুপুর গড়ালেই গোসল করতে আসেন। আহা কতোটাই না সুন্দর ছিলো।
শ্যামা আর রমা যমজ বোন, আমাদের বাড়িতে ভাড়া থাকত…শ্যামার সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়েছিলো। সাইলার সঙ্গে ওর মুখের কি অদ্ভুত মিল। একদিন বুঝলাম, ওর মতো রমাও আমাকে পছন্দ করে।
—এনাও পানি।
একটা কাচের চুরি পরা কালো হাত আমাকে পানি এগিয়ে দিচ্ছে, আমি অবাক হয়ে বললাম
—একি তুমি!
খিলখিলিয়ে হেসে উঠল রমা
—তুমি তো আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো করছো।
—তুমি এতো কালো হয়ে গেছো রমা!
—আমি তো মরে ভূত, এখন আমি ফরসা না কালো তাতে কী এসে যায়!
—তুমি আসলে কোথা থেকে! এতক্ষণ তো ওই ছেলেটা ছিল!
আবার খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে রমা
—ভাল করে দেখো আমাকে, আমি সেই।
আমি দুহাত দিয়ে চোখটা কচলাতেই রমা উধাও। সামনে সেই ছেলেটা দাড়িয়ে আছে। অন্ধকার বেশ বুঝতে পারছি, ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে সাদা সাদা দাঁত বের করে হাসছে
—রমার কথা ভাবছিলেন?
আমি কোনও কথা বলতে পারি না। শুধুই তাকিয়ে থাকি ছেলেটার দিকে। ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে বলছে
—আমিও ভাবতাম জানেন।
—আপনি!
—ভাবতাম একটা সময়, যখন শ্যামাকে ভালবাসতাম।
—শ্যামাকে ভালবাসতেন!
—আজ্ঞে। আর শ্যামাকে ভালবাসার মাঝে রমার দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে মাঝে মধ্যেই তার শরীরটাকে উপভোগ করতাম।
—ছি
—ছি বলছেন! আপনি রমার গায়ে কোনও দিন হাত দেননি? অবিবাহিতা রমার গর্ভে যে বাচ্চাটিছিল, তার বাবা কে?’
আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। আমি চুপ করে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছি…
—জানেন, শ্যামা আপনাকে প্রচণ্ড ভালবাসতো…রমার বাচ্চার বাবার নাম জানার পর ভুলে গিয়েছিল আপনাকে।
—না, একদম না, রমার সুইসাইড নোট আমি পড়েছি…সেখানে অন্য এক ছেলের নাম লেখাছিলো।
ছেলেটা হেসে উঠে বলে,
—সে তো আপনার নিজের সান্ত্বনা দেওয়ার কথা। আপনি কি এক সময় মনে মনে ভাবতেন না, রমার আত্মহত্যার পিছনে সব চেয়ে বড় আপনার হাত?’
কোনো জবাব নেই আমার কাছে। কিভাবেই বা থাকবে।
—অপরাধ নেবেন না স্যার, আমি আপনার থেকে অনেকটাই ছোট…এসব কথা বলার আমার কোনো ইচ্ছে ছিল না,
শ্যামা-রমা-রিনা-ছোটনের মা সবই আমার জানা, আমি এসেছিলাম আপনার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতে, গল্প করতে।
আমি এবার অধৈর্য হয়ে উঠি
—রিনা আর ছোটনের মা সম্পর্কে কী জানেন? ওদের সঙ্গেও আমার সম্পর্ক ছিল বলবেন? নাকি বলবেন, আমি ওদের খুন করেছি বা আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছি!
—আহা আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন! জানেন না, ভূতের সামনে কোনও রাগ চলে না।
—আপনি কেনো এসেছেন। আপনি বের হয়ে যান,জাস্ট গেট লস্ট।
—একটু পরে, শুধু রিনা আর ছোটনের মায়ের কথা বলেই চলে যাব।
—আচ্ছা বলুন আপনার যা মন চাই বলুন।
—আপনার মতো রিনার কাছেও আমি যেতাম।
—রিনার কাছে অনেকেই যেত, তো কি হয়েছে?
—একদমই…অনেকেই যেত। কিন্তু, আপনি বাবু মশাই ছিলেন বলে রিনা আপনাকে বিশ্বাস যতটা করত, অন্যদের ততটা করত না, আপনার প্রতি যতটা যত্নবান ছিল, অন্যদের প্রতি ছিল না।
ওর কথায় না হেসে আমি পারি না
—আপনি কি পাগল হয়ে গিয়েছেন, বেশ্যারা আবার বাবুকে বিশ্বাস করে…সত্যিই বুঝতে পারছি, আপনি এই জগতের বাসিন্দা না।
—ঠিকই বলেছেন, বাবুদের প্রতি বিশ্বাস রাখতে নেই…যেমনটা রিনা আপনার প্রতি রেখেছিল…রিনার কোনও কাজ ছিল না…আপনি যে গয়নাগুলি দিয়ে গিয়েছেন, ওগুলিকেই জড়িয়ে ধরে রিনা বাঁচতে চেয়েছিল।
রমার মৃত্যুর পর বাবা আর কোনও ঝুঁকি নিতে চাননি। সবটা বুঝতে পেরে সম্ভবত বাবা আমাকে দিল্লি পাঠিয়ে দিলেন। বাবার বন্ধু হরিপদের সুপারিশে একটি চাকরিও পেয়ে গেলাম। ভাল ছাত্র ছিলাম বলেই হয়ত সুপারিশের চাকরিতেও সুনাম হয়ে গেল। প্রমশোনও হলো। তবে বাইরে থাকতে ভাল লাগতো না। কোম্পানি বদলে চাকরি নিয়ে চলে এলাম ঢাকাই। নতুন অফিসেই আমার পরিচয় চঞ্চলের সঙ্গে। চঞ্চল আর আমি খুব দ্রুতই বন্ধু হয়ে গেলাম। অনেকেই বলেছিলো, ‘চঞ্চলের সঙ্গে মিশো না ভাই’। কিন্তু কূসঙ্গে পড়তে তো আর বেশি সময় লাগে না, আমিও তাই চঞ্চলকে আর ছাড়তে পারলাম না।
বাংলাদেশ সময়: ১:১৫:৫৯ ৯০১ বার পঠিত #বাংলাদেশ #বিনোদন #ভূত গল্প #সত্য ঘটনা