ফারহানা আকতার এর কলাম : ‘নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – পর্ব-২

Home Page » সাহিত্য » ফারহানা আকতার এর কলাম : ‘নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – পর্ব-২
সোমবার, ৫ অক্টোবর ২০২০



 ফাইল ছবি

মূলতঃ ‘নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ – আমার এই রচনার মূল উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের এবং সুশীল সমাজের একজন সুনাগরিক হিসেবে (যদিও মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে আমার জন্ম) বাংলাদেশে আমার পরবর্তী প্রজন্মের ও বহিরবিশ্বের সাধারণ পাঠকের কাছে এই উপমহাদেশের ইতিহাসসহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটি পরিস্কারভাবে তুলে ধরা ।
পূর্ব-পাকিস্হানের জণগনের ওপর পশ্চিম-পাকিস্তানের   শাসন-শোষন-অত্যাচার যখন চরম পর্যায়ে উপনীত হয় তখন পশ্চিম পাকিস্তানের  এই চরম অসহনীয় দুঃশাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত পেশা এবং শ্রেনীর মানুষ আমাদের জাতির জনক ও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে এদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পরে। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, চাকুরীজীবী, পুলিশ, আনসার, সেনাবাহিনীর সদস্য, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সরকারী আমলা, সাহিত্যিক, কন্ঠ শিল্পী, নাট্যকর্মী, শিল্পীসমাজ, খেলোয়াড়,  সংবাদ কর্মী, রেডিও কর্মী, সংবাদ পাঠক ইত্যাদি সকল পেশার আপামর জণগন যার যার ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়।পূর্ব – পাকিস্হানের শিল্পীদের একটি বড় অংশ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এর মাধ্যমে গান পরিবেশন করে মুক্তিযোদ্ধাদের এবং আশ্রয়হীন বাঙ্গালীদের মনোবল বৃদ্ধিতে ভুমিকা রাখেন। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র হয়ে ওঠে মুক্তিপাগল বাঙ্গালীদের মনের জোর প্রতিষ্ঠার প্রিয় এবং প্রধান মাধ্যম। প্রায় সমস্ত বাঙ্গালীরা চুপি চুপি এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনতেন। তখন এম আর আখতার মুকুল উপস্থাপিত চরমপত্র অনুষ্ঠানটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের সেই গানগুলো ছিল : ১। জয় বাংলা বাংলার জয়, হবে হবে হবে নিশ্চয় ,২। বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে এই জনতা ,৩। তীর হারা সেই ঢেউ এর সাগর পাড়ি দেব রে ,৪। মা গো ভাবনা কেনো, আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলে, ৫। ছালাম ছালাম হাজার ছালাম, লাখো শহীদের স্মরণে ,৬। মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি, ৭। শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি ,৮। আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে ,৯। কারার ঐ লৌহ কপাট ,১০। এই শিকল পরা ছল মোদের এই, ১১। বিজয় নিশান উড়ছে ঐ বাংলার ঘরে ঘরে, ১২। চাষাদের মুটেদের মজুরের, গরীবের, নিঃস্বের, ফকিরের ,১৩। পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল ,১৪। নোঙ্গর তোলো তোলো সময় যে হোলো হোলো ,১৫। গেরিলা আমরা আমরা গেরিলা ,১৬। জনতার সংগ্রাম চলবে, আমাদের সংগ্রাম চলবেই চলবে ৷ এই সমস্ত গানগুলো ১৯৭১ সনে মুক্তিযোদ্ধা সহ সকল মুক্তিকামী জনতার মাঝে অসীম প্রেরণা জুগিয়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগীত শিল্পীগন ট্রাকে করে প্রতিদিন শরনার্থী শিবির গুলোতে গান পরিবেশন করে শরনার্থীদের প্রেরণা যোগাতেন। আজ যদি আমরা একটি স্বাধীন জাতি না হতাম, পরাধীনতার শেকলে আবদ্ধ থেকে আমরা কি পারতাম হাসিমুখে নিজের সন্তানকে কোলে নিতে? পারতাম নিজের বাংলা ভাষায় কথা বলতে? পারতাম নিজেদের স্বাধীনচেতা মতামত প্রকাশ করতে?

আমি মনে করি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পুরাপুরি জানার পূর্বে আমাদের এই উপমহাদেশের পূর্ব ইতিহাসটা এবং সঙ্গে ভারত বিভাজন ও পশ্চিম – পূর্ব পাকিস্হান বিভাজনের ঘটনাগুলো ও একটু জানা দরকার৷ ইতিহাস থেকে আমরা জেনেছি, একসময় বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্হান), পাকিস্হান (পশ্চিম পাকিস্হান) এবং ভারত (ভারতবর্ষ) এই তিন জাতি অর্থাৎ এই তিন রাষ্ট্র মিলে একটি দেশ ছিল যার নাম ছিল ‘উপমহাদেশ’৷ মূলত: উপমহাদেশে বিরাজমান সংস্কৃতির মতই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটিও অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। সময়ের পথ ধরে, ইতিহাসের নানা চড়াই উৎরাই পার হয়ে অখণ্ড ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে তৈরি হয়েছে আধুনিক কালের দক্ষিণ এশিয়ার দেশ সমূহ। উপমহাদেশের মধ্যযুগের ইতিহাস জুড়ে রয়েছে বিদেশী শক্তির আগ্রাসন, পরাধীনতা ও সাম্রাজ্যবাদ। মূলত: ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের পরে থেকেই এই উপমহাদেশ বিদেশী শাসকদের অধীনে চলে যায়। প্রথমে মুঘলরা এবং পরে ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশে রাজত্ব করে। একথা বলার উপায় নেই যে, ১২০০ শতকের পূর্বে এই উপমহাদেশ পরাশক্তির দ্বারা আক্রান্ত হয়নি। কিন্তু তখন পর্যন্তও এই উপমহাদেশের শাসকেরা বিভিন্ন সময়ে আসা পারস্য ও গ্রীক আক্রমণ ঠেকিয়ে নিজেদের দেশ নিজেরাই শাসন করেছেন। এখানে মূলত : ১২০০ শতকের পূর্ববর্তী সময়ের (যা এখানে উপমহাদেশের প্রাচীনকাল হিসেবে ধরা হয়েছে) ইতিহাস রচিত হয়েছে মূলত প্রত্নতাত্ত্বিক গন ও জীবাশ্ম-বিদগনের হাতে। অনেক বিষয় নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের উপর ভিত্তি করে এই উপমহাদেশে মানুষের আবির্ভাব এবং মানব সভ্যতার বিকাশ নিয়ে একটা মোটা দাগের ধারণা পাওয়া যায়। আধুনিক মানুষের ইতিহাস ৩০-৫০ হাজার বছরের পুরনো হলেও এই উপমহাদেশে প্রস্তর যুগের সূচনা হয় প্রায় ৫ লক্ষ বছর পূর্বে যখন পাথরের হাতিয়ার ব্যবহারকারী হোমো ইরেক্টাসরা এই অঞ্চলে সর্বপ্রথম বসবাস শুরু করে ।
এবারের পর্বে আমরা একনজরে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস নিম্নোক্তভাবে দেখতে পারি অর্থাৎ ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসকে আমরা দু’ভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করতে পারি, যথাক্রমে- ক. খ্রীষ্টপূর্ব ৭০,০০০ থেকে ৬০ খ্রীষ্টাব্দ এবং খ. খ্রীষ্টাব্দ ৬০ থেকে বর্তমান :
ক. খ্রীষ্টপূর্ব ৭০,০০০ থেকে ৬০ খ্রীষ্টাব্দ:
১.প্রস্তর যুগ : ৭০,০০০-৩৩০০খ্রীষ্টপূর্ব , ২.হরপ্পা ও মহেঞ্জদর সভ্যতা :৩৩০০-১৭০০খ্রীষ্টপূর্ব, ৩. হরপ্পা সংস্কৃতি :১৭০০-১৩০০খ্রীষ্টপূর্ব, ৪.বৈদিক যুগ : ১৫০০-৫০০খ্রীষ্টপূর্ব,৫.লৌহ যুগ : ১২০০-৩০০খ্রীষ্টপূর্ব, ৬.ষোড়শ মহাজনপদ : ৭০০-৩০০খ্রীষ্টপূর্ব, ৭.মগধ সাম্রাজ্য :৫৪৫খ্রীষ্টপূর্ব, ৮.মৌর্য সাম্রাজ্য : ৩২১-১৮৪খ্রীষ্টপূর্ব, ৯.মধ্যকালীন রাজ্যসমূহ : ২৫০খ্রীষ্টপূর্ব, ১০.চোল সাম্রাজ্য : ২৫০খ্রীষ্টপূর্ব, ১১.সাতবাহনসাম্রাজ্য : খ্রীষ্টপূর্ব ২৩০- ৬০ খ্রীষ্টাব্দ ৷
খ. খ্রীষ্টাব্দ ৬০ থেকে বর্তমান :
১২.কুষাণ সাম্রাজ্য- ৬০-২৪০ খ্রীষ্টাব্দ, ১৩.গুপ্ত সাম্রাজ্য :২৮০-৫৫০ খ্রীষ্টাব্দ, ১৪.পাল সাম্রাজ্য :৭৫০-১১৭৪ খ্রীষ্টাব্দ, ১৫. সুলতানী আমল :১২০৬-১৫৯৬, ১৬.দিল্লি সুলতানি -১২০৬-১৫২৬, ১৭.দাক্ষিনাত্যের সুলতান :১৪৯০-১৫৯৬, ১৮.হোয়সলা সাম্রাজ্য : ১০৪০-১৩৪৬,১৯.কাকাতিয়া সাম্রাজ্য : ১০৮৩-১৩২৩,২০.আহমন সাম্রাজ্য : ১২২৮-১৮২৬,২১.বিজয়নগর সাম্রাজ্য : ১৩৩৬-১৬৪৬, ২২.মুঘল সাম্রাজ্য : ১৫২৬-১৮৫৮,২৩.মারাঠা সাম্রাজ্য : ১৬৭৪-১৮১৮,২৪.শিখ রাষ্ট্র : ১৭১৬-১৮৪৯,২৫.শিখ সাম্রাজ্য : ১৭৯৯-১৮৪৯, ২৬.ব্রিটিশ ভারত :১৮৫৮–১৯৪৭,২৭. । ভারত ভাগ : ১৯৪৭-বর্তমান ৷
এই আলোচনায় উপরে উল্লেখিত সর্বশেষ পয়েন্ট- “ভারতবর্ষ ভাগ : ১৯৪৭–বর্তমান”-এই পয়েন্টটি হতে শুরু করলেও আমরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটি অত্যন্ত পরিস্কারভাবেই জানতে পারতাম কিন্তু আমার মনে হলো এ পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের এই উপমহাদেশের তৎ পূর্ববর্তীকালের ইতিহাসটাও সংক্ষিপ্ত আকারে জানা থাকাটা জরুরী ৷
১. প্রস্তর যুগ : ৭০,০০০-৩৩০০খ্রীষ্টপূর্ব : উপমহাদেশে প্রস্তর যুগের এই দীর্ঘ ব্যাপ্তিকালকে আলোচনার সুবিধার্থে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা আদি-প্রস্তর যুগ, মধ্য-প্রস্তর যুগ ও নব্য-প্রস্তর যুগ এই তিনটি উপ-ভাগে বিভক্ত করেছেন।
* আদি-প্রস্তর যুগ: উপমহাদেশে আদি প্রস্তর যুগের ব্যাপ্তিকাল ছিল প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ২৬,০০০ বছর পর্যন্ত। এই যুগের প্রধান হাতিয়ার ছিল নুড়ি পাথরের ধারালো কাটালি আর পাথরের তৈরি একধরনের হাত কুঠার। পাকিস্তানের সন নদীর উপত্যকায় বিস্তর এলাকা জুড়ে নুড়ি পাথরের কাটালির স্তর পাওয়া গেছে। আর হাত কুঠারের সন্ধান পাওয়া গেছে মাদ্রাজের চেন্নাইয়ে। আদি প্রস্তর যুগের হাতিয়ার আর ফসিল গুলো থেকে এটা ধারনা করা যায় যে ঐ যুগের মানুষেরা ছিল মূলত শিকারি ও সংগ্রহকারী। তারা মূলত পশু শিকার, আর বুনো ফলমূল, শিকড়-বাকড়, ইত্যাদি সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করত। তারা মূলত যাযাবরের মত খোলা জায়গায় বসবাস করলেও কখনও কখনও নিরাপত্তার জন্য গুহায় আশ্রয় নিত। মধ্য ভারতের নর্মদা নদীতীরের গুহা চিত্রগুলো এমনটিই ইঙ্গিত করে। অল্প কিছু ফসিল, উপরোল্লিখিত হাতিয়ার আর এই গুহাচিত্রগুলো ছাড়া এই যুগের আর তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য নমুনা পাওয়া যায়না।
*মধ্য-প্রস্তর যুগ: মাইক্রোলিথ নামক একধরনের ছোট আকারের হাতিয়ারের ব্যবহার মধ্য-প্রস্তর যুগকে আদি-প্রস্তর যুগ থেকে আলাদা করেছে। আকারে ছোট হলেও পূর্ববর্তী যুগের যেকোনো হাতিয়ারের চেয়ে মাইক্রোলিথ ছিল উৎকৃষ্ট-মানের ও অধিক কার্যকরী। এগুলো ছিল আকারে খুবই ছোট আর নানা আকৃতির (ব্লেডের মত চ্যাপ্টা, ত্রিকোণাকৃতির, ট্রাপিজিয়ামাকৃতির, অর্ধচন্দ্রাকৃতির, তিরের অগ্রভাগের মত সূচালো ইত্যাদি)। এই হাতিয়ার তৈরিতে প্রয়োজন হত কোয়ার্টজ, ফ্লিন্ট বা চেলসিডোনির মত শক্ত পাথরের। নদী অববাহিকায় প্রাপ্ত নুড়ি সমূহ ছিল এই সকল হাতিয়ারের জন্য একেবারেই অনুপযোগী। কাজেই পাথরের খোঁজে মধ্য-প্রস্তর যুগের মানবেরা নদী অববাহিকা ছেড়ে পার্বত্যাঞ্চলে বসবাস শুরু করে। আবার আবহাওয়ার বৈরিতার কারণে মধ্য-প্রস্তর যুগের মানুষের মধ্যে ঋতু ভিত্তিক আবাস্থল পরিবর্তনও লক্ষণীয়। সাধারণত শীতকালে এরা গঙ্গা অববাহিকা থেকে মধ্য ভারতের বিন্ধা পার্বত্যাঞ্চলের দিকে চলে যেত এবং গুহায় আশ্রয় নিত আর গ্রীষ্মকালে পুনরায় নদী অববাহিকায় ফেরত আসত। পাথরের তৈরি একধরনের যাঁতাকল ও গোলাকৃতির পাথরের ব্যবহার এই যুগে আদিম কৃষিকাজের সূচনার ইঙ্গিত করে। মানব আবাস্থলের সন্নিকটে প্রাপ্ত গরু, ভেড়া, ছাগল ইত্যাদি পশুর হাড়গোড়ের অবশিষ্টাংশ এই যুগে সর্বপ্রথম পশু-পালনের সূচনারও ইঙ্গিত করে। মধ্য-প্রস্তর যুগে প্রথম মৃতদেহকে কবর দেওয়ার নিদর্শনও পাওয়া যায়। এ থেকে ধারণা করা যায় যে এই যুগে মানুষের মধ্যে মৃত্যু পরবর্তী জীবনের প্রতি বিশ্বাস ছিল। উপমহাদেশের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে এই যুগের নিদর্শন সমূহ পাওয়া যায়। উল্লেখযোগ্য স্থান সমূহ হচ্ছে, শ্রীলঙ্কা, বর্তমান ভারতের রাজস্থানের বাগড়, গুজরাটের লানগঞ্জ, গঙ্গা সমভূমির সরাই নহর রাই, মহাদহ ও দমদম এবং মধ্যাঞ্চলের আদমগড়, ভিমবেক্তা ও ঘাগড়িয়া।
* নব্য-প্রস্তর যুগ ও কৃষির বিস্তার: প্রায় ১১,০০০ বছর (খ্রিষ্টপূর্ব) পূর্বে, শেষ বরফ যুগের সমাপ্তির সাথে সাথে মধ্য-প্রস্তর যুগের সমাপ্তি ঘটে এবং নব্য-প্রস্তর যুগের সূচনা হয়। অনুকূল জলবায়ু ও ভূমির উর্বরতা এই যুগে ব্যাপক ভাবে কৃষির বিকাশ ঘটাতে ভূমিকা রাখে। তথাপি বরফ যুগের পতনের সাথে সাথেই এই অঞ্চলে কৃষির বিকাশ ঘটেনি কিংবা সমগ্র উপমহাদেশ জুড়ে একই সময়ে কৃষির বিকাশ ঘটেনি। ছোট ছোট অঞ্চলে ধীরে ধীরে কৃষির বিস্তার ঘটতে থাকে এবং শিকার-সংগ্রাহক থেকে মানুষজন কৃষকে উন্নীত হতে থাকে। কাজেই প্রায় কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত এই দুই শ্রেণীর মানুষ সহাবস্থান করে। উপমহাদেশের অন্তত ৪-৫ টি অঞ্চলে শিকার-সংগ্রহ থেকে পুরোপুরি কৃষি নির্ভর জীবন ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটে প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ৮,০০০ বছরের দিকে। আবার কোনও কোনও অঞ্চলে এই পরিবর্তন ঘটে মাত্র হাজার বছর পূর্বে। নব্য-প্রস্তর যুগে সমস্ত উপমহাদেশ জুড়ে মানুষের বসবাস থাকলেও চারটি বিশেষ অঞ্চলে প্রাপ্ত নিদর্শন সমূহ ঐ যুগের আঞ্চলিক সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য গুলোকে ধারণ করে। প্রথম অঞ্চলটি পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে অবস্থিত। বেলুচিস্তানের মেহেরগড়ে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমূহ এই অঞ্চলে প্রায় ৭,০০০ বছর পূর্বে কৃষিকাজের সূচনার ইঙ্গিত করে। এই অঞ্চলে প্রাপ্ত নব্য-প্রস্তর যুগের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মাটির তৈরি কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ, বার্লি ও গমের বীজ, ভেড়া ও ছাগলের হাড়, চার্ট এর তৈরি ব্লেড ইত্যাদি। এই সকল নিদর্শন সমূহ পরিষ্কারভাবে কৃষির ইঙ্গিত বহন করে। দ্বিতীয় অঞ্চলটি পাকিস্তানের কাশ্মীর ও সোয়াত উপত্যকায় অবস্থিত। এইখানে কৃষিকাজের ইঙ্গিত বাহি সাধারণ নিদর্শন সমূহ সহ আরও বিশেষ এক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়। এখানে প্রাপ্ত ঘণ্টা-আকৃতির গর্ত সমূহ এই অঞ্চলকে অন্য অঞ্চল সমূহ থেকে আলাদা করেছে। এই গর্তসমূহের ব্যবহারিক দিক নিয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদদের মধ্যে দ্বিমত আছে। অনেকেই মনে করেন ১৫ ফুট চওড়া ও ১৩ ফুট গভীর এই গর্তগুলোতে সে যুগের মানুষেরা বসবাস করত। তারা এটাও মনে করেন যে এই অঞ্চলের নব্য-প্রস্তর যুগের মানুষেরা মধ্য এশিয়ার গর্ত-বাসী নব্য-প্রস্তর যুগের মানুষের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। অন্যদিকে, ভিন্ন মতাবলম্বীরা মনে করেন যে এই গর্ত সমূহ শস্য ভাণ্ডার কিংবা আবর্জনা ফেলার জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হত। তৃতীয় অঞ্চলটি পূর্ব ভারতের গঙ্গা অববাহিকায় বিরাট এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এই অঞ্চলে কৃষির আবির্ভাব ঘটে তুলনামূলক ভাবে অনেক দেরিতে। এখানে প্রাপ্ত নব্য-প্রস্তর যুগের অনেক নিদর্শনই দেখতে মধ্য-প্রস্তর যুগের নিদর্শন সমূহের মত। তথাপি এখানকার কোনও কোনও এলাকা যেমন চোপানি মন্দ, মহাগরা, কলদিহাওয়া ও চিন্দ্রাতে প্রাপ্ত নব্য-প্রস্তর যুগের নিদর্শনসমূহ এইসব এলাকায় প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ৪,০০০ বছর আগে কৃষির আবির্ভাব হওয়ার সাক্ষ্য বহন করে। এখানে প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য শস্যাবশেষ হল ধান, যদিও সেই যুগে ধান চাষ নিয়ে দ্বিমত আছে। অনেকেই মনে করেন এই উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ধান চাষের আবির্ভাব ঘটে খ্রিষ্টপূর্ব ২,০০০ বছর এর পরে। নব্য-প্রস্তর যুগের চতুর্থ অঞ্চলটি দক্ষিণ ভারতে অবস্থিত। এই অঞ্চলে প্রাপ্ত নব্য-প্রস্তর যুগের নিদর্শন সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ছাইয়ের স্তূপ। ধারনা করা হয় যে এগুলো এক ধরনের খোয়ারের ধ্বংসাবশেষ, যেখানে ঐ যুগে নির্দিষ্ট ঋতুতে গবাদি পশু পোষ মানানো হত আর ঋতু শেষে সেগুলো আগুনে পোড়ানো হত। অনবরত বছরের পর বছর ধরে একই স্থানে পোড়ানো ছাই গুলো স্তূপাকৃতি ধারণ করে। অঞ্চলভেদে নানা বৈসাদৃশ্য থাকলেও উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে নব্য-প্রস্তর যুগে সমগ্র উপমহাদেশ জুড়ে জীবন-ব্যবস্থা ছিল মূলত কৃষি ও পশুপালন ভিত্তিক। এতদস্বত্বেও একদল নব্য-প্রস্তর যুগীয় মানুষ কৃষি কাজে না গিয়ে কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত শিকারি ও সংগ্রাহক হিসেবে বসবাস করে। কৃষিকাজের আবিষ্কারের সাথে সাথে সেই যুগে মানুষের জীবন ব্যবস্থায় তুমুল বৈচিত্র্যের অত্যন্ত পরিস্কারভাবেই সৃষ্টি হয়। সেই যুগের মানুষেরা প্রথমে তিনভাগে বিভক্ত হয়ে হয়ে, একদল কৃষক, একদল পশুপালক আর একদল শিকারি। হাজার বছর ব্যাপী এই তিন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে এক ধরনের তৈরি হয় এক ধরনের পরস্পর নির্ভরশীলতা। এক দল আরেক দলের উপর বিভিন্ন উপকরণের জন্য নির্ভর করতে থাকে। যেমন কৃষক চামড়া ও দুগ্ধজাত দ্রব্যাদির জন্য পশুপালকের উপর নির্ভর করে তেমনি পশুপালক শস্য ও গোখাদ্যের জন্য কৃষকের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কৃষকের ফসল কাটা হয়ে গেলে, পশু পালকেরা সেগুলো গোচারণ ভূমি হিসেবে ব্যবহার করত, অন্যদিকে সেই জমিতে গোচারণের ফলে জমা হওয়া গোবর জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে কৃষকের উপকার করত। আবার কৃষক বনজাত দ্রব্যাদি ও মধুর জন্য নির্ভর করত যাযাবর শিকারিদের উপর। এভাবেই ধীরে ধীরে বিভিন্ন পেশার মানুষের উদ্ভব হতে থাকে। আবির্ভাব ঘটে কারিগর ও বনিক শ্রেণীর। সেই যুগের মানুষ জন যে একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট শান্তি পূর্ণ জীবন যাপন করত এমনটি ভাবার কোনও কারণ নেই। প্রায়শই দলে-দলে বা গোত্রে গোত্রে মারামারি হানা-হানি হত। এর মূল কারণ অবশ্য ছিল চাষ যোগ্য ভূমি। চাষাবাদের জমি ও ফসল রক্ষার জন্য প্রায়শই কৃষকের সাথে পশুপালক শ্রেণীর যুদ্ধ-বিগ্রহ হত। ভূমির দখল বা মালিকানা রক্ষার নিমিত্তে তৈরি হয় গোত্র ব্যবস্থা। আর স্বাভাবিক ভাবেই গোত্রের সবচেয়ে ব্যক্তিত্বপূর্ন মানুষের হাতে যায় গোত্রের নেতৃত্ব। গোত্র ব্যবস্থা পরবর্তীতে পরিবার ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়। চালু হয় বিবাহ প্রথার। খ্রিষ্টপূর্ব ৩,০০০ সালের দিকে হরপ্পান সভ্যতার বিকাশ এর মাধ্যমে নব্য-প্রস্তর যুগের সমাপ্তি ঘটে। (চলবে) ৷
তথ্যসূত্র : বুকস্ , ইন্টারনেট ৷

ফারহানা আকতার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, লেখক এবং গবেষক ৷

লেখকের অন্যান্য বই

বাংলাদেশ সময়: ২:১৫:৩০   ১১৯৫ বার পঠিত   #  #  #  #




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

সাহিত্য’র আরও খবর


সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন: স্বপন চক্রবর্তী
ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা “আমি তো গাঁয়ের মেয়ে ”
৫০ বছরের গৌরব নিয়ে জাবির বাংলা বিভাগ বিশাল ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ উৎসব আয়োজন করেছে
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা- ‘তোমার খোঁজে ‘
অতুলপ্রসাদ সেন: ৩য় (শেষ ) পর্ব-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন;পর্ব ২-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন-স্বপন চক্রবর্তী
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা ” যাবে দাদু ভাই ?”
বাদল দিনে- হাসান মিয়া
ইমাম শিকদারের কবিতা ‘ছোট্ট শিশু’

আর্কাইভ