সাইয়েদুল বাসার,বঙ্গনিউজঃ
যে দেশে শিশুদের বিদ্যাশিক্ষার হাতেখড়ির জন্য ব্যবহৃত আদর্শলিপি বইও ১২ টাকায় পাওয়া যায় না, সে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২ টাকায় পড়াশোনা করা যায়। ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল আলোচনাসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে মাননীয় উপাচার্য ১২ টাকায় পড়াশোনা করাকে ‘অ্যামেজিং’ মনে করে বক্তব্য দিয়েছেন। তবে এটা যে অ্যামেজিংলি ফ্রাসট্রেটিং বা বিস্ময়করভাবে হতাশাজনক, তা ওই একই বক্তব্যে তাঁর দেওয়া কিছু তথ্য থেকেই বোঝা যায়। ১২ টাকায় ২০২১ সালে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী কী পড়াশোনা করেন? তাঁর ভেতরে জ্ঞানপিপাসা জাগ্রত করার জন্য এবং তা পূরণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেসব সুবিধা দেয়, সেগুলো কতটুকু এবং কোন মানের হলে তা ১২ টাকায় লাভ করা সম্ভব?
১২ টাকায় শিক্ষালাভের দৃশ্যমান সব ফলাফল বছরের পর বছর জাহির হয়ে আসার পরও মাননীয় উপাচার্যের কাছে যখন একে ‘অ্যামেজিং’ মনে হয়, তখন বুঝতে হবে শিক্ষার মান ও শিক্ষার্থীর জ্ঞান মুখ্য নয়, বরং লক্ষ্য এখানে অন্য কিছু।
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করার পর থেকে বের হওয়া পর্যন্ত সময়ে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিকে শাণিত করার জন্য যে প্রেরণা তাঁকে দেওয়া হয়, তার মূল্য বুঝি মাত্র ১২ টাকা? অর্জিত ডিগ্রিটা কেবল বিসিএস ক্যাডার হওয়া ছাড়া অন্য কাজে ব্যবহার করেও যে জীবনকে সার্থক করা যায়, সে বিষয়ে তাঁকে ১২ টাকায় কতটুকু ধারণা দেওয়া হয়? একটা গবেষণা প্রস্তাব কীভাবে লিখতে হয়, সে কলাকৌশলের কতটুকু তাঁরা শিখতে পারেন চতুর্থ বর্ষে? কিংবা একটা মাস্টার্সের থিসিসে কীভাবে সাইটেশন করতে হয়ে, সে প্রশিক্ষণটাও কি তাঁর ১২ টাকার লেখাপড়া তাঁকে ঠিকঠাকমতো দেয়?
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে: যত গুড় তত মিঠা। তো গুড় ছাড়া যিনি পায়েস খেতে চান, বুঝতে হবে তিনি আসলে পায়েসের বদলে ভাতের জাউ খেতে চাইছেন। ১২ টাকায় শিক্ষালাভের দৃশ্যমান সব ফলাফল বছরের পর বছর জাহির হয়ে আসার পরও মাননীয় উপাচার্যের কাছে যখন একে ‘অ্যামেজিং’ মনে হয়, তখন বুঝতে হবে শিক্ষার মান ও শিক্ষার্থীর জ্ঞান মুখ্য নয়, বরং লক্ষ্য এখানে অন্য কিছু। হতে পারে ‘এখানে সুলভে পড়ানো হয়’ গোছের একটা পরিচিতি লাভের ইচ্ছা এ ক্ষেত্রে কাজ করে।
উপাচার্য সাহেব সংখ্যায় বিশ্বাসী, মানে নন। তাঁর দেওয়া ফর্দ অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮৪টি বিভাগ, ১১টি ইনস্টিটিউট, প্রায় ৬০টি গবেষণাকেন্দ্র, ১৪০টি অধিভুক্ত ও উপাদানকল্প প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু এই ফর্দে অতি সাধারণ যেসব তথ্য জানা গেল না, তার কয়েকটি হলো: কী কী বিষয়ে এখানে এর আগে উল্লেখযোগ্য গবেষণা হয়েছে, এখন চলমান আছে এবং ভবিষ্যতে হতে যাচ্ছে। এসব গবেষণার উদ্দেশ্য; বিভিন্ন সামাজিক, জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইতিবাচক পরিবর্তনে এসব গবেষণার অবদান কী।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য যদি থাকে কেবল ডিগ্রি দেওয়া এবং অবকাঠামোগত পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়কে আধুনিক করে তোলা, তবে সেখানে ১২ টাকায় শিক্ষা নেওয়া শিক্ষার্থীর গবেষণার সুযোগ কোথায়? তবে আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ে ঢাবির না থাকার বিষয়ে উপাচার্য মহোদয় যা বলেছেন, তা খাসা বটে। তাঁর কথার উদ্ধৃতি না দিলেই নয়, ‘অনেক সময় আমরা সেগুলোকে উপেক্ষা করতাম। এত দিন আমরা তথ্য দিইনি।’ এই সরল স্বীকারোক্তি অ্যামাজিং হলেও এই উপেক্ষায় বহু বছরের জন্য যে এই প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিযোগিতার দৌড়ে পিছিয়ে গেল, তার দায়ভার কে নেবে?
৮৪টি বিভাগের কথা শুনে তাজ্জব বনে যাওয়া বিদেশি প্রতিনিধিরা বলেছেন, ‘এগুলো তো তোমাদের ওয়েবসাইটে দেখি না।’ তাই উপাচার্য মহোদয় মনে করছেন, তথ্যগুলো এখন আপলোড-শেয়ারিং অত্যন্ত জরুরি৷ ডিজিটাল বাংলাদেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দাবিদার ঢাবির ওয়েবসাইট ব্যবস্থাপনাকারী কর্তৃপক্ষের এত বছরের প্রচারবিমুখতার দায়ই বা কে নেবে?
উপাচার্য মহোদয়ের বক্তব্যে অনেক অ্যামেজিং তথ্য থাকলেও তাঁর নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠানের অনেক ফ্রাসটেটিং তথ্য থেকে মাত্র দুটি তাঁর সদয় অবগতির জন্য এখানে তুলে ধরা প্রয়োজন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো ট্রান্সক্রিপ্ট গ্রহণের জন্য রেজিস্ট্রার ভবনের তৃতীয় তলায় গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হয়, ফর্ম নিয়ে টিএসসির জনতা ব্যাংকে এসে আবার লাইনে দাঁড়িয়ে ফি জমা দিতে হয়। তারপর বেশ কয়েকটি কর্মদিবস অপেক্ষান্তে আবার রেজিস্ট্রার ভবনের তৃতীয় তলায় গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে মানি রিসিট জমা দিয়ে গ্রহণ করার পর ট্রান্সক্রিপ্টের মধ্যে বানান ও তথ্যগত ভুল আবিষ্কার করে ফ্রাসট্রেটেড হতে হয়।
দ্বিতীয়ত, যখন শিক্ষার্থীরা দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার জন্য আবেদন করেন, তখন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে হাই ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর জার্নালে প্রকাশনার কৃতিত্বধারী কিছু সম্মানিত শিক্ষকের কাছে এখনো রেফারেন্স লেটারের ড্রাফট পৌঁছে দিতে হয়। অথচ রেফারেন্স লেটার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পত্র, যার গোপনীয়তা বজায় থাকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর আবেদন করা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। আসলে ১২ টাকায় পড়ালেখা করে যাওয়া শিক্ষার্থীর সঙ্গে কতটুকু মমতার এবং প্রকৃত গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক তৈরি হয় যে, শিক্ষক গোপনীয়তা বজায় রেখেও উদারচিত্তে তাঁর শিক্ষার্থী সম্বন্ধে দু-চারটি ভালো কথা সেই রেফারেন্স লেটারে নিজের মন থেকে লিখবেন? এ বিষয়গুলো বদলে ফেলার জন্য কিন্তু সংস্কার বা দরপত্র আহ্বানের প্রয়োজন হয় না, স্যার।
সেই সঙ্গে বিদেশি শিক্ষার্থী ও বিদেশি শিক্ষকের অনুপাত বাড়াতে হলে দেশি শিক্ষক ও দেশি শিক্ষার্থী—উভয়কেই যেমন আরও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন শিক্ষা ও গবেষণার মান বাড়ানো। পড়ার খরচ ১২ টাকা থেকে বাড়িয়ে যদি ঢাবি প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয়সুলভ আচরণ করে, শিক্ষার্থী বা শিক্ষার্থীর অভিভাবকেরা তাতে বরং স্বস্তি পাবেন।
ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা: নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ৷
বাংলাদেশ সময়: ১৯:১৫:২৮ ৬৬৮ বার পঠিত # #ঢাকা ইউনিভার্সিটি #নট ‘অ্যামেজিং #মাননীয় উপাচার্য