বঙ্গ-নিউজ ডটকম:২০১৪ সালে ভারতে অনুষ্ঠেয় লোকসভা নির্বাচন সামনে রেখে সেন্টার ফর দ্য স্টাডিজ অব ডেভেলপিং সোসাইটিজ একটি জরিপ করে। জরিপের অন্যতম বিষয় ছিল প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে দ্বিতীয় ইউপিএ (ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালেন্স) সরকারের ভূমিকা কেমন ছিল।
জরিপমতে, ৩৭ শতাংশ উত্তরদাতা ইউপিএ সরকারের আমলে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটেছে বলে মনে করেন। মাত্র ১৯ শতাংশ এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। আর কলেজ পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন, এমন ৪৮ শতাংশ উত্তরদাতা প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে ইউপিএ সরকারের ভূমিকায় সন্তুষ্ট বলে জানিয়েছেন। তবে ২৮ শতাংশ বলেছেন, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের তেমন উন্নতি হয়নি।
ভারতের ইউপিএ সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে তৈরি জরিপের বিশদ বিবরণ তুলে ধরছি এ কারণে যে, এর সঙ্গে বাংলাদেশের নামটি এসেছে প্রশংসনীয়ভাবে। এই জরিপের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল, ভারত কোন কোন দেশকে বিশ্বস্ত বন্ধু ভাবতে পারে?
এর উত্তরে সর্বাধিক ৪৮ শতাংশ জানিয়েছেন, বাংলাদেশ। এর পরে ৪৬ শতাংশ পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে রাশিয়া। মনে রাখতে হবে, জরিপটি হয়েছে সারা ভারতের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে; কেবল বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে নয়।
একটি দেশের মানুষ অপর একটি দেশকে কখন বিশ্বস্ত বন্ধু ভাবে? যখন তারা ভাবে, দেশটি তাদেরও ভালো চায়। যখন তারা মনে করে যে ওই দেশটি দ্বারা ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই।
বাংলাদেশকে ভারতের জনগণের অতি বিশ্বস্ত বন্ধু ভাবার কারণ ব্যাখ্যা করেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত দেব মুখার্জি (যিনি নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করেছিলেন)। তিনি বলেছেন, গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ সরকার ভারতের নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ নিরসনে জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছে, যেখানে বিগত সরকার সমস্যা সৃষ্টিকারীদের সমর্থন জুগিয়েছিল।
দেব মুখার্জি আরও বলেছেন, জনমতের ভিত্তিতে সাধারণত ইতিহাস রচিত হয় না; কিন্তু তাৎক্ষণিক ও সাম্প্রতিক ধারণা পাওয়া যায়।
ভারতের হিন্দু পত্রিকায় যখন এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, তখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি নয়াদিল্লিতে অবস্থান করছিলেন। একটি সেমিনার উপলক্ষে তিনি সেখানে গেলেও দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়, বিশেষ করে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা তিস্তার পানি বণ্টন ও সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে দেশটির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন। কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ ও বিরোধী দলের নেতা অরুণ জেটলির সঙ্গে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি হয় ১৯৭৪ সালে, যা মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি নামে পরিচিত। চুক্তি সইয়ের পরই বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সেটি অনুসমর্থন করলেও ভারতীয় সংসদ এখন পর্যন্ত তা করেনি। এ কারণে চুক্তিটি কার্যকর হতে পারেনি। এরপর ২০১১ সালে মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় ওই চুক্তির আলোকে দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত প্রটোকল সই হয়। কিন্তু এই প্রটোকল অনুমোদনের জন্য সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা প্রয়োজন হলেও ইউপিএ সরকারের তা নেই। এ কারণে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিল্লিতে গিয়ে ভারতের প্রধান বিরোধী দল বিজিপিরও সমর্থন চেয়েছেন।
পত্রিকার খবর অনুযায়ী, বিজেপির নেতা তাঁকে তেমন আশ্বাস দিতে পারেননি। বলেছেন, দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানাবেন। আগামী আগস্টে রাজ্যসভার অধিবেশনে চুক্তিটি অনুমোদনের জন্য পেশ করার কথা রয়েছে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছেন, ‘ভারত তিস্তার পানি বণ্টন ও সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ ২০১১ সালে ঢাকা সফরকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে আয়োজিত সেমিনারেও তিনি একই কথা বলেছিলেন। গত দুই বছরে চুক্তি বাস্তবায়নে তাঁর সরকারের নানামুখী চেষ্টা সত্ত্বেও সফল হয়নি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির টানাপোড়েনের কারণে।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সরকারের মতো ভারতে ইউপিএ সরকারের হাতেও সময় আছে মাত্র কয়েক মাস। এ সময়ে তাদের পক্ষে এমন কিছু করা সম্ভব নয়, যাতে বিরোধীরা ক্ষুব্ধ হয়।
এই প্রেক্ষাপটেই কূটনীতিক মহলে বাংলাদেশের বন্ধু বলে পরিচিত দেব মুখার্জি হিন্দুতে বলেছেন, ‘কিছু অপরাধবোধও কাজ করছে। বাংলাদেশ ভারতের জন্য যেসব কাজ করছে, তার বিপরীতে তিস্তার পানি বণ্টন ও সীমান্ত চুক্তি নিয়ে প্রতিশ্রুতি ভারত এখনো পূরণ করতে পারেনি।’
দারিদ্র্য বিমোচনসহ সামাজিক উন্নয়ন ও অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের সাফল্যের কথা উল্লেখ করে তিনি মন্তব্য করেছেন, জরিপের ফলাফলে তার প্রতিফলন থাকতে পারে।
জরিপে ভারতের দুই নিকট প্রতিবেশী সম্পর্কে বিপরীত চিত্রই ফটে উঠেছে। ৪৮ শতাংশ উত্তরদাতা বাংলাদেশকে বিশ্বস্ত বন্ধু বলে মত দিলেও ৫৪ শতাংশ বলেছেন, পাকিস্তানকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না। তবে ১৪ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, পাকিস্তান ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং একটি পর্যায়ে দেশটির ওপর আস্থা রাখা যায়। জরিপে চীনের বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। ৩৩ শতাংশ মনে করেন, চীনকে বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু ৩১ শতাংশ মনে করেন, চীনকে মোটেই বিশ্বাস করা যায় না।
সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রার স্বীকৃতি মিলেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকেও। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও জিন ড্রেস তাঁদের যৌথ বই গ্লোমি ওয়ার্ড-এ লিখেছেন, ‘মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশের কাছে ভারতের অনেক শিক্ষণীয় আছে।’
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দিল্লি সফরটি সরকারি পর্যায়ের ছিল না। বেসরকারি সফরে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় জটিল ও দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা একটি সমস্যার সমাধান যে সম্ভব নয়, তা কূটনীতির অ আ পড়া মানুষও জানেন। কিন্তু দীপু মনির সফরের আগে মানুষের মধ্যে এমন ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে এবারই একটা কিছু হয়ে যাবে। সে কারণেই হয়তো সফর শেষে হতাশার সুরটি বেশি বেজেছে।
এই জরিপ থেকে যে সত্যটি বেরিয়ে এসেছে তা হলো, বাংলাদেশ বন্ধু হিসেবে অত্যন্ত বিশ্বস্ত। তারা যে কথা দেয়, সে কথা রাখে। কেবল ভারত নয়, প্রতিবেশী-দূরবর্তী কিংবা ছোট-বড় সব দেশের কাছে দেওয়া কথা বাংলাদেশ রাখার চেষ্টা করে। স্বাধীনতার পর গত ৪২ বছরে বাংলাদেশ কারও সঙ্গে গায়ে পড়ে ঝগড়া করেনি। দুই বৃহৎ প্রতিবেশী চীন ও ভারত—উভয়ের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলেছে দেশটি।
এ প্রসঙ্গে এ কথাটি বলা জরুরি যে আমরা আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কারও দাবার ঘুঁটি হতে চাই না। আমরা যেমন সবার বিশ্বস্ত বন্ধু হতে চাই, তেমনি আমাদেরও পাশে চাই বিশ্বস্ত বন্ধুকে। কূটনীতিতে একতরফা বন্ধুত্ব হয় না। দেব মুখার্জির ভাষায়, বাংলাদেশ বন্ধুত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। এখন ভারতের পালা।
কলকাতার বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার শিরোনাম করেছে, দীপু মনি খালি হাতে ফিরে এসেছেন। কিন্তু সেই খালি হাতে ফিরে আসার জন্য নিশ্চয়ই বাংলাদেশকে দায়ী করা যাবে না।
বাংলাদেশ সময়: ৫:১৯:৫০ ৪০২ বার পঠিত