বঙ্গ-নিউজ ডটকম:২০ বছর ধরে ঈদুল ফিতরের আগে, রমজান মাসজুড়ে বিরোধী দল হুংকার দিয়ে আসছে, ‘ঈদের পর কঠোর আন্দোলন।’ কোনো কোনো বছর আন্দোলন কিছুটা কঠোর হয়েছে অর্থাৎ হরতাল ও জ্বালাও-পোড়াও হয়েছে, কোনো কোনো বছর হুংকারটি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। তবে হুংকারে সরকার তটস্থ হয়েছে, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের ঘুম চলে গেছে, ধরপাকড় হয়েছে। এই হুংকার অবশ্য এখন মানুষের এবং সরকারের গা-সহা হয়ে গেছে, অথবা হয়ে যাওয়ার কথা।
কিন্তু এ বছর এই হুংকারের পেছনে বেশ একটা শক্তির জোগান দেখা যাচ্ছে, অর্থাৎ এই গর্জনের পেছনে বর্ষণের কমতি নেই। এই মুহূর্তে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোট যে শক্তিশালী অবস্থানে আছে, বিশেষ করে পাঁচ সিটি করপোরেশনে বড় ধরনের জয়ের পর, তাতে এই হুমকিকে খাটো করে দেখার কোনো কারণ নেই। এ পর্যন্ত রমজান মাসটি রাজনীতির হানাহানি এবং রক্তপাত থেকে মুক্ত ছিল। কিন্তু এ বছরই এ দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এই পবিত্র মাসে জামায়াতে ইসলামী পর পর চার দিন সহিংস হরতাল করল, ১১ জন মানুষ খুন হলো, অনেক মানুষ আহত হলো। মানবতাবিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধের নানা অভিযোগে অভিযুক্ত দলটির নেতাদের মুক্তির জন্য হরতাল করাটা তাহলে রমজানের পবিত্রতা রক্ষার চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চার দিনের এই হরতালে দলটির নেতাদের বিরুদ্ধে দেওয়া রায়ে কোনো পরিবর্তন হলো না, তাঁদের অবস্থার কোনো ইতরবিশেষ হলো না, কিন্তু ১১ জন মানুষ অকারণে মৃত্যুবরণ করল, ১১টি পরিবার তাদের প্রিয়জন হারাল। এই ১১ পরিবারের জন্য এবারের এবং আগামীর সব ঈদ অর্থহীন হয়ে দাঁড়াল। তবে যে বিষয়টি আমাদের অবাক করেছে, তা হলো কোনো দলই রমজান মাসে দেওয়া হরতালের প্রতিবাদ করল না, এমনকি ইসলামের হেফাজতকারীর দাবিদার হেফাজতে ইসলামও না, যদিও জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে তাদের আদর্শগত বিরোধ রয়েছে বলে দাবি করেন এর নেতারা। অর্থাৎ ১৮-দলীয় জোটের সবাই এবং হেফাজতে ইসলাম এই হরতালকে সমর্থন করল। ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও এবং রক্তপাত থেকে রমজান মাসকেও রেহাই না দেওয়াটা এ দেশের রাজনীতিতে একটা নতুন মোড় ফেরার ঘটনা বলেই ধরে নেওয়া যায়।
ঈদের পর আন্দোলন যে কঠোর হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই আন্দোলন ১৮-দলীয় জোট করবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে; জামায়াতে ইসলামী এর সঙ্গে যোগ করবে এর নেতাদের বিরুদ্ধে দেওয়া আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রায়ের প্রতিবাদে আন্দোলন; হেফাজতে ইসলাম যোগ করবে এর ১৩ দফার দাবি। গত ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আমরা সারা দেশে যে ভয়ংকর সহিংসতা দেখে এসেছি, যার বলি হয়েছে ১০০-এর বেশি মানুষ, ধ্বংস হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অসংখ্য স্থাপনা, পুড়েছে ট্রেনের বগি, বাস এবং অন্যান্য যানবাহন, উপড়ে ফেলা হয়েছে রেললাইন, কাটা পড়েছে ২০ হাজারের মতো গাছ, আগামীর কঠোর আন্দোলনে এর পুনরাবৃত্তি দেখার জন্য হয়তো আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। কোনো কোনো কাগজে লেখা হয়েছে, অক্টোবর থেকে লাগাতার আন্দোলন হবে। অর্থাৎ ৪৮ অথবা ৭২ এমনকি ৯৬ ঘণ্টার হরতাল হতে পারে, রাজপথ-রেলপথ অবরোধ হতে পারে, ঢাকা-চট্টগ্রামে ৫ মের শাপলা চত্বরের মতো সমাবেশ হতে পারে। ওই দিন ঢাকার অনেক জায়গায়, বিশেষ করে বায়তুল মোকাররম ও মতিঝিল এলাকায় যে ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তিও হতে পারে। অর্থাৎ এক ব্যাপক ধ্বংসলীলা এবং অরাজকতা দেখার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। অথচ এই ধ্বংসলীলার জন্য যে অবিশ্বাস্য মূল্য আমাদের দিতে হবে, তার সম্পূর্ণটাই বর্তাবে সাধারণ মানুষের ওপর। এক অর্থনীতিবিদ আমাকে জানালেন, যদি সাম্প্রতিক ধ্বংসযজ্ঞের মতো বিপর্যয় আগামী চার-ছয় মাস দেশজুড়ে চলে, তাহলে দেশটির প্রবৃদ্ধি থেকে ১ থেকে দেড় শতাংশ আমরা চোখের সামনে হাওয়া হয়ে যেতে দেখব।
ওই অর্থনীতিবিদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার কোনো কারণ নেই। রাজনীতি কতটা সহিংস, স্বার্থপর এবং প্রতিহিংসামূলক হতে পারে, তা তো কয়েক মাস ধরে নতুন করে আমরা দেখে আসছি।
আগামী চার-ছয় মাস যদি আমরা শুধু ‘কঠোর কর্মসূচি’ দেখতে থাকি, তাহলে তার অভিঘাত আমাদের অর্থনীতি, সমাজ, শিক্ষা তথা জাতীয় জীবনে কীভাবে পড়তে পারে, তার একটা হিসাব আমরা সহজেই নিতে পারি। যদি দেশের প্রবৃদ্ধির এক-দেড় শতাংশ হাওয়া হয়ে যায়, তাহলে এত দিনের অনেক অর্জনও হাওয়া হয়ে যাবে। অর্থনীতিতে ধস নামবে, বেকারত্ব বাড়বে, অনেক ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠবে, যোগাযোগ এবং অন্যান্য খাতে বিপর্যয় নেমে আসবে, বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব ঘটবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে এবং স্কুল থেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার ক্ষেত্রে দেখা যাবে এক মারাত্মক বিপর্যয়। অর্থাৎ বাংলাদেশ বিশ্বে তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলেই একটি রুগ্ণ এবং বিপর্যস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হবে। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়ে উগ্রবাদের প্রভাব বাড়ে, মাদকের থাবা আরও করাল হয়, মানুষের জীবনের স্বস্তি উঠে যায়। আফ্রিকার অনেক দেশে এ রকম বিপর্যয়ে যে বড় ক্ষতি হয়েছে, তা হলো, এদের অনেক দক্ষ শ্রমিক ও পেশাজীবী বিদেশে কাজ নিয়ে চলে গেছে, ফলে দেশগুলো মেধাশূন্য হয়েছে। যে দেশ থেকে মেধাবী লোক চলে যায়, যে দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে, সামাজিক সহিংসতা বাড়ে, মেয়েরা ঘরে বন্দী হয়ে থাকে, সে দেশটি একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পথে যায়। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ বলতে প্রায় কিছুই নেই, এর জনসংখ্যা বিশাল। যদি এই দেশে বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয় নামে, এর অবস্থা আফ্রিকার অনেক দেশ থেকেও খারাপ হয়ে যাবে।
তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট চার-ছয় মাসের কঠোর আন্দোলন শেষে ক্ষমতায় গেল। তার সঙ্গে যাবে জামায়াতে ইসলামী এবং হেফাজতে ইসলাম। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ওপর দাঁড়িয়ে এ জোটটি তখন কোন পথে দেশটির মুক্তি খুঁজবে? বিএনপিকে তখন হেফাজতের ১৩ দফাও মেনে নিতে হবে, যেহেতু এর প্রতি ইতিমধ্যেই পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন খালেদা জিয়া। যে দেশের অর্থনৈতিক যোগাযোগ, সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে, প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৪-৪.৫-এ, শিক্ষা কার্যক্রম বিপর্যস্ত এবং সামাজিক সুস্থিরতা অপসৃত, সে দেশকে জুলাই ২০১৩-এর অবস্থায় নিয়ে আসতেই তো তখন জোটটির বছর দুই লেগে যাবে, প্রবৃদ্ধিকে ৬-এর ওপরে তুলতে তো রীতিমতো আলাদিনের চেরাগের প্রয়োজন হবে। সে রকম একটি অসম্ভবও সম্ভব হতে পারে যদি দেশটিতে শান্তি থাকে। কিন্তু বিরোধী দলে গিয়ে আওয়ামী লীগ, যার প্রতি দেশের ৪০ শতাংশ মানুষের সমর্থন যে আছে, তা তো নানা নির্বাচনে প্রমাণিত, নিশ্চয় বাধ্য ছেলের মতো বসে থাকবে না। ১৮-দলীয় জোটের ‘কঠোর আন্দোলন’ যদি আওয়ামী লীগ তখন শুরু করে, এই জোটের দাওয়াই তারা দ্বিগুণ কার্যকারিতায় প্রয়োগ করতে থাকে, তখন কী হবে?
খালেদা জিয়া ক্ষমতায় গেলে পরিবর্তনের রাজনীতি করার ঘোষণা দিয়েছেন, লন্ডনের এক দলীয় সমাবেশে তারেক রহমান সুশাসনের একটি রূপরেখা দিয়েছেন। ভালো কথা। কিন্তু এসব বাস্তবায়নের জন্য শুধু ১৮ দলের সমর্থন থাকলে চলবে না, থাকতে হবে ব্যাপক রাজনৈতিক সমঝোতা, শান্তি, সুস্থিরতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী দলগুলো কঠোর আন্দোলনে নামলে তাদের ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে এসব অর্জন করা যাবে না। তা ছাড়া, আরও বড় প্রশ্ন যা: এত যে কঠোর আন্দোলন এত দিন ধরে, বিশেষ করে, গত ৫ ফেব্রুয়ারির পর থেকে হলো, তাতে কি কিছু লাভ হলো? দেশের ক্ষতিসাধন ছাড়া? সরকার কোনো ছাড় দিল? যুদ্ধাপরাধীদের একটা সাজাও মওকুফ হলো? হেফাজতের ১৩ দফার একটি দফাও গৃহীত হলো? সরকারের পতন হলো? তাহলে? তাহলে কি এটি প্রমাণিত হয় না, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এসব কঠোর আন্দোলন সরকারের পতন ঘটায় না, যেহেতু জনগণের ম্যান্ডেট নিয়েই সরকার গঠন করে একটি দল বা জোট। কঠোর আন্দোলন বরং যা করে—কুঠার হয়ে দেশটির পা-ই শুধু কাটে। দেশটির রক্তক্ষরণ হয়। মানুষে মানুষে বিভেদ ও শত্রুতা সৃষ্টি হয়। উগ্রপন্থার বিস্তার হয়। নৈরাজ্য সর্বগ্রাসী হয়।
কঠোর আন্দোলন শেষ পর্যন্ত দেশের এবং দেশের গরিব মানুষের বিপক্ষেই যায়।
বিরোধী দলের যে রকম এই সত্যটি উপলব্ধি করা উচিত যে কঠোর আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আত্মঘাতী এবং দেশধ্বংসী হয়ে দাঁড়ায়, সরকারেরও স্বীকার করা উচিত, কঠোর আন্দোলন এড়ানোর দায় প্রধানত তার, বিরোধী দল শুধু শুধু আন্দোলন করছে, এটি ভেবে বসে থাকার কোনো কারণ নেই এবং আন্দোলন যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্বটিও তার।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে দাবি নিয়ে বিরোধী দল কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে, তার প্রতি জনসমর্থন আছে, শুধু যে কয়েকটি পত্রিকার জরিপে এর সত্যতা মিলেছে, তা নয়, গত পাঁচটি সিটি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীদের বিজয়ও এ বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। সরকার দাবি করছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অসাংবিধানিক। সরকারের দাবি অবশ্যই সঠিক, যেহেতু সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিধান আর নেই, কিন্তু সংবিধান একবার যেমন সংশোধন করা গেছে, আরেকবারও করা যাবে, তত্ত্বাবধায়ক, নির্বাচনকালীন—যেকোনো নামেই তাকে ডাকা হোক, একটা নিরপেক্ষ ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন করা গেলে তা হবে জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন। আওয়ামী লীগ একসময় যেসব যুক্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করেছিল, সেগুলো এখনো বিদ্যমান। আমাদের বিশ্বাস, নির্বাচনকালীন দলীয় সরকারের পরিবর্তে নির্দলীয় সরকার নিয়ে আলোচনা শুরু হলে কঠোর আন্দোলন থেকে বিএনপি-জামায়াত জোটকে বেরিয়ে আসতেই হবে। তাতে উপকৃত হবে গণতন্ত্র, বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষ।
বাংলাদেশের মানুষ আন্দোলন-ক্লান্ত, উদ্বিগ্ন এবং বিপর্যস্ত। তারা চায় শান্তি, প্রগতি এবং সামাজিক সুস্থিরতা। এসব নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকার এবং বিরোধী দল, উভয়ের। এ জন্য সংলাপের বিকল্প নেই, সমঝোতার বিকল্প নেই। যদি আমরা সবাই দেশটাকেই সবার আগে জায়গা দিতে পারি, তাহলে সংলাপের এবং সংলাপের সাফল্যের একটা সম্ভাবনা তৈরি হবে। তা না হলে, কঠোর আন্দোলন এবং দমন-পীড়নের চক্রে পড়ে আমরা শুধু পিছিয়ে পড়তে থাকব।
বাংলাদেশ সময়: ৫:০৮:৫৮ ৪৩০ বার পঠিত