স্বাধীনতা যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে অর্থাৎ ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টির পর মূলতঃ আমরা ৫টি জেনারেশন বা
প্রজন্ম পেয়েছি৷ অর্থাৎ ১৯৭১ সালে যাদের জন্ম তারা স্বাধীন বাংলাদেশের ১ম জেনারেশন৷ আরেকটু সহজভাবে বলা যায়,
এই প্রজন্ম তাদের এস.এস.সি পাশ করেন ১৯৮০ থেকে ১৯৮৯ এর মধ্যে ৷ সুতরাং এবার আমরা সহজেই বলতে পারি,
“স্বাধীন বাংলাদেশের ১ম জেনারেশন হছ্ছে তারা,যারা তাদের এস.এস.সি এবং এইচ.এস.সি কমপ্লীট করেছেন ১৯৮০ থেকে
১৯৮৯ সালের মধ্যে ৷ একইভাবে, যারা তাদের এস.এস.সি এবং এইচ.এস.সি কমপ্লীট করেছেন ১৯৯০ থেকে ১৯৯৯ সালের
মধ্যে, তারা স্বাধীন বাংলাদেশের ২য় জেনারেশন ৷ একইভাবে যারা তাদের এস.এস.সি এবং এইচ.এস.সি কমপ্লীট করেছেন
২০০০ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে, তারা স্বাধীন বাংলাদেশের ৩য় জেনারেশন এবং সেই একইভাবে যারা তাদের এস.এস.সি
এবং এইচ.এস.সি কমপ্লীট করেছেন ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে, তারা স্বাধীন বাংলাদেশের ৪র্থ জেনারেশন ৷এবং
একইভাবে পরবর্তীতে আসবে ৫ম জেনারেশন, ৬ষ্ঠ জেনারেশন, ৭ম জেনারেশন, ৮ম জেনারেশন ইত্যাদি ইত্যাদি”৷অর্থাৎ
বর্তমানে বাংলাদেশে ৪টি জেনারেশন বসবাস করছে ৷ নাহ্ , ঠিক তাও নয় , ৫টি জেনারেশন বসবাস করছে এবং এই ৫ম
জেনারেশন যারা তাদের এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি কমপ্লীট করবেন ২০২০থেকে ২০২৯ সালের মধ্যে যারা এখন তাদের
শৈশবকাল পার করছে ৷গত কলামে আমি আরো লিখেছিলাম, “বাংলাদেশে এখন সবজায়গায় ২য় প্রজণ্মের নাগরিকগন
অর্থাৎ ২য় জেনারেশন প্রচন্ডভাবে অবহেলিত, নিগৃহীত৷ কারণ , বাংলাদেশ এখন শুধু ১ম প্রজণ্মের নাগরিক অর্থাৎ ১ম
জেনারেশন এবং ৩য় প্রজণ্মের নাগরিক অর্থাৎ ৩য় জেনারেশন নিয়ে বিজি”৷ তাই আমি মনে করি, অথোরিটি লেভেল থেকে
‘বাংলাদেশ’ কে নিয়ে আরো গভীরভাবে ভাববার ও দেখবার দৃষ্টিভঙ্গিটুকু আরেকটু পাল্টাতে হবে৷ অনেক জনগন,
জনগনের কাঙ্ক্ষিত ভালোবাসা, জনগনের অর্জন,জনগনের ত্যাগ-তিতিক্ষার সমন্বয়ে গঠিত ও অর্জিত আমাদের এই
ভালোবাসার বাংলাদেশ৷তাই আমরা যদি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটুকু পাল্টাই, তাহলেই দেখতে পাবো , এদেশে কাউকে আর
অবহেলিত হতে হছ্ছে না অর্থাৎ আমরা যদি এদেশের জনগনের এ্যাচিভমেন্টটাকে জেনারেশন-ওয়াইজ এবং একই সাথে
জেনডার-ওয়াইজ সেলিব্রেট করি (ব্যাপারটা অনেকটা এইরকম , একই ক্লাশের যেমন কয়েকটি সেকশন থাকে এবং প্রতিটা
সেকশনেই আবার ১ম, ২য়, ৩য় পজিশন থাকে এবং ‘এ’ সেকশনের ১ম কে কখনো কখনো ‘বি’সেকশনের ১ম –এর সাথে
তুলনা করা যাবে না ঠিক তেমনি এক জেনারেশনের এ্যাচিভমেন্টকে অন্য জেনারেশনের এ্যাচিভমেন্টের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা
যাবে না অর্থাৎ প্রফেসর ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর প্রজণ্মের সেরা, ব্যাপারটি মিডিয়াতে খোলা চোখে দেখলে এইরকম দাড়ায় -
সুবর্না মুস্তফা তাঁর প্রজণ্মের সেরা ৷ বিপাশা হায়াত তাঁর প্রজণ্মের অর্থাৎ ১ম জেনারেশনের সেরা, তারিন তার প্রজণ্মের
অর্থাৎ ২য় জেনারেশনের সেরা এবং এটি চিরণ্তন সত্য যে , দুই বা তিন বা চার সেরাদের সাথে সেরাদের কখনো তুলনা
চলেনা ) , তাহলে কোথাও কোনো ইগনর বা দ্বন্দ্ব বা অতৃপ্তিবোধ থাকে না ৷ একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের আদর্শ ও যথাযথ
উন্নয়নের জন্য সকলের অবদান ও মেধাকে সেলিব্রেশন করা প্রয়োজন ৷ আমাদের কোনো অধিকার নেই, একটি
জেনারেশনের এচিভমেন্টকে সেলিব্রেট করতে গিয়ে অন্য একটি জেনারেশনের এচিভমেন্টকে ইগনর করা ৷ আমি আমার
পূর্বের কোনো একটি কলামে, এও বলেছিলাম- “প্রতিটি প্রফেশনের জন্য আলাদা –আলাদা এসোসিয়েশন থাকা জরুরী এবং
একজন ব্যক্তি যতগুলো কাজ করবেন, তিনি ততগুলো এসোসিয়েশনের মেম্বার হবার যোগ্যতা রাখবেন” ৷ তাহলেও
কোথাও কোনো এচিভমেন্টকে ইগনর করা হয়না ৷ এদেশের প্রতিটি নাগরিক এবং সেই নাগরিকের প্রতিটা অর্জনই এদেশের
জন্য সম্পদ, এদেশের জন্য গৌরবের ও সম্মানের ৷ বাংলাদেশকে একটি আদর্শ রাষ্ট্র তথা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার
বাংলাদেশ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে হলে ‘বাংলাদেশ’ কে নিয়ে আমাদের এভাবেই ভাবতে হবে ৷
এবারে মূল টপিকে আসি ৷ যেহেতু,১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার
মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃতির প্রচেষ্টা চলছিল দীর্ঘ প্রায় দুইযুগেরও বেশী সময় ধরে ৷ তাই সেই সময়টাতে
বাংলাদেশে বেড়ে উঠেছিল ২য় ও ৩য় প্রজন্ম ( যাদের জণ্ম মুক্তিযুদ্ধের প্রায় একদশক পরে) এবং তখনকার সময়ে,
সবকিছুর পাশাপাশি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসটি জেনে সঠিকভাবে বেড়ে ওঠা এবং নিজেকে একজন
দেশপ্রেমিক তথা সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলাই ছিল এই দুই প্রজণ্মের জন্য আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ ৷ অপরদিকে, বাকী
১ম,৪র্থ এবং ৫ম জেনারেশনকে এই যুদ্ধটি কখনোই করতে হয়নি কারন-তাদের বেড়ে ওঠার সময় অলরেডী মুক্তিযুদ্ধের
পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় এবং বই-পত্রের কোথাও ইতিহাস-বিকৃতির কোনো ঘটনা নেই ৷তারা চাইলে কিংবা না চাইলেও
অতি সহজেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসটি জানতে পারছে ৷ বাংলাদেশের ২য় প্রজণ্মের নাগরিক হিসেবে সে
যুদ্ধে আমাকে নামতে হয়েছিল প্রতিনিয়ত ,জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে ৷ আমি জেনেছি ‘বাংলাদেশ’ সৃষ্টির তথা ‘ বাংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’অনেক অনেক কষ্ট করে , বিভিন্ন লাইব্রেরী থেকে বই কালেক্ট করে অথবা বই কিনে
অথবা আমার বাবা-মা ও সিনিয়রদের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে করে কারন তখন সরাসরি বই-পত্রে
একসঙ্গে পরিস্কারভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিপিবদ্ধ আকারে পাওয়া যেতো না৷ একেকদিন একেকটি ব্যাপার
জানতাম৷
যেমন- আমার শৈশবে ও কৈশরে বহুদিন পর্যন্ত ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবসের ঘোষনাটি আমি বিকৃতভাবে
জানতাম এবং তখনকারকার আমলের তৈরী নাটক-মুভিগুলোতেও সে ঘোষনাটি অস্পষ্টভাবে শুনতে পেতাম
৷২৬ মার্চ’ ১৯৭১ এ, যথাক্রমে চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথমে এম এ হান্নান এবং
পরবর্তীতে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এর লেখা- “স্বাধীনতার ঘোষনা
পত্র” টি তারা তাদের নিজেদের মতো করে ‘বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই’ পাঠ করেন অর্থাৎ ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে
সকলের মতো তারাও ‘বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব্’ মেনে নিয়েছিলেন (যদিও পরব্তীতে এই ঘোষনা-পাঠ নিয়েই
ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা করা হয়েছিল) ৷পাঠকদের জ্ঞাতার্থে সেই ঘোষনাটি নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চে বাংলাদেশের জনগনের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু :
Message to the People of the Bangladesh and to the People of the World :
“Pak-Army suddenly attacked EPR base Pill-khana and Rajarbag Police line killing lakhs of
people. Street-Battle still going on in the every streets of Dacca, Chittagong. The Human
world are invited for help to the Bengali-Nationalism. Our freedom fighters are gallantly fighting
with the enemies for their freedom.
May Allah bless you”.
He added, “This may be my last message , from today –Bangladesh is independent. I call
upon the people of Bangladesh , wherever you might be and with whatever you have, to
resist the army of occupation to the last. You fight must go on until the last soldier of the
Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is
achieved”.
-Sheikh Mujibur Rahman, 26 th March’1971
(Source: ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ প্রকাশিত “বাংলাদেশ সংবাদ” ম্যাগাজিন থেকে) ৷
এবারে তৎকালীন সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমানের পাঠ করা ঘোষনাটি , যেটি তিনি চট্রগ্রামের
বেতার কেন্দ্র থেকে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান” এর পক্ষে পাঠ করেছিলেন৷ এই ঘোষনাটি আমাদের এই
কারনে জানা দরকার যে, আমাদের দেশের বেশীরভাগ মানুষ নাকি জানেন যে, সেইসময় জিয়াউর রহমান
স্বাধীনতার যে ঘোষনাপত্রটি পাঠ করেন, তাতে নাকি বঙ্গবন্ধুর নামটি ছিল না :
“I, Major Zia, On behalf of Our Great Leader ,the Supreme Commander of Bangladesh-Sheikh
Mujibur Rahman, we hereby proclaim Independence of Bangladesh. And that the Government
headed by Sheikh Mujibur Rahman has already been formed. It is further proclaimed that
Sheikh Mujibur Rahman is the sole leader of elected representatives of seventy five million
people of Bangladesh, and the Government headed by him is the only legitimate Government of
the people of the Independent Sovereign State of Bangladesh, which is legally and
constitutionally formed, and is worthy of being recognized by all the Government of the World. I ,
therefore, appeal on behalf of our Great Leader Sheikh Mujibur Rahman to the Governments of
all the democratic countries of the World, specially the Big Powers and the neighboring
countries to recognize the legal Government of Bangladesh and take effective steps to stop
immediately the awful genocide that has been carried on by the army of occupation from
Pakistan. May Allah help us. Joy Bangla”.
Maj. Ziaur Rahman
27 th March’1971
আমরা সকলেই জানি, একটা সময়ে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্হান মিলে একটি দেশ ছিল যাকে
‘উপমহাদেশ’ বলা হতো ৷ বিভিন্ন রকম ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বৈষম্যগুলো যখন উপমহাদেশের এই
তিনজাতির মধ্যে প্রকট হয়ে ওঠে এবং জাতিতে –জাতিতে বিভেদ সৃষ্টি হতে থাকে, তখনই উপমহাদেশ ভেঙ্গে
তিনটি জাতি তথা তিনটি রাষ্ট্রের জন্ম হয় ৷ (চলবে)
তথ্যসূত্র : বুকস্ , ইন্টারনেট ৷
ফারহানা আকতার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, লেখক এবং গবেষক ৷
বাংলাদেশ সময়: ০:২৫:৩৭ ১২৩৫ বার পঠিত #নতুন #প্রজন্ম #মুক্তিযুদ্ধ