আল-আমিন সালমানঃসুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার হাওর জনপদের দূর্গম ও অবহেলিত ভাটির রাজধানী মধ্যনগর।বর্ষাকালে মধ্যনগর কে দুর থেকে দেখলে হাওরের উপর ভাসমান একটি ছোট দ্বীপের মতো মনে হয়।
হাওর অধ্যুষিত এই জনপদের অনেক গৌরব ও সংগ্রামের প্রসিদ্ধ ইতিহাস রয়েছে।কথিত আছে বিট্রিশ উপনিবেশ শাসনামলে মধ্যনগর বাজারটির নাম ছিল আনন্দনগর।কালের পরিক্রমায় আনন্দনগর নামটি পরিবর্তন হয়ে মধ্যনগর হিসেবে পরিচিতি লাভ করে ।ব্রিটিশ উপনিবেশ শাসনামলে তৎকালীন গৌরিপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ১৮৮৫ -১৯২০ খ্রিঃ এই সময়ের মধ্যে মধ্যনগর বাজারের মাঝখানে মানুষের পানি পান করার জন্য একটি পুকুর খনন করেন।পুকুরের মাটি দিয়ে বাজারটি চারদিকে সম্প্রসারণ করা হয়।যেটি এখনও বাজারের মাঝখানে কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে। এছাড়াও এই হাওর জনপদের শিক্ষার উন্নয়নে তৎকালীন সময়ে গৌরীপুরে জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ১৯২০ সালে তার মাতা বিশ্বেশ্বরী রায় চৌধুরীর নামানুসারে মধ্যনগর বিশ্বেশ্বরী মাইনর স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাকালে তিনি প্রতিষ্ঠানের স্থান ও খেলার মাঠসহ ৫.৬০ একর জমিসহ নগদ অর্থ প্রদান করেছিলেন।বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানটি মধ্যনগর বিশ্বেশ্বরী হাইস্কুল এন্ড কলেজ নামে পরিচিত ।মধ্যনগর থানা ৪ টি ইউনিয়ন (মধ্যনগর, চামরদানী, বংশীকুন্ডা (দঃ) ও বংশীকুন্ডা (উঃ)) নিয়ে গঠিত। ২২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের হাওরের রাজধানী খ্যাত মধ্যনগরে বর্তমানে প্রায় ২লক্ষ লোকের বসবাস।
শিক্ষার জন্য ৮৪ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১০ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১ টি কলেজ রয়েছে।দুটি পশুর হাট, ৮ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা,বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ রামসার সাইট খ্যাত টাংগুয়ার হাওরের এক তৃতীয়াংশ যার অবস্থান মধ্যনগর অঞ্চলে।
এই জনপদ থেকে সরকারী কোষাগারে প্রতি বছর রাজস্ব আদায় করে জলমহাল থেকে প্রায় ১ কোটি ৩২ লাখ টাকা , মধ্যনগর বাজার থেকে প্রায় ৬০ লাখ টাকা,মহিষখলা থেকে ২৫-৩০ লাখ টাকা। শুধু মধ্যনগর বাজারের ৫০ লাখ মন ধান বছরে বেঁচা কেনা হয়।দুটি খাদ্য গুদামে চাল ধান মজুদ প্রায় ১৩০০ টন ও ১৫০০ টন (প্রায়)।
প্রান্ধধিক জীবন কৃষ্ণ সরকারের লিখিত বিভিন্ন সুত্রে জানা যায় , মহান মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ১৯৭৪ সালে তৎকালীন পররাষ্ট্র্র মন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ Anti Dacoit Police Camp (ADPC) হিসেবে মধ্যনগরে পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করেন।যা পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ একটি থানায় প্রতিষ্ঠিত করা হয়।অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এই ভাটির জনপদের কথা চিন্তা করে দূর্গম অঞ্চল বিবেচনায় ২০০১ সালের ৯ মে তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখহাসিনা’র সভাপতিত্বে রাষ্ট্র্রের প্রশাসনিক পূনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি (নিকার-NICAR-National Implementation Committee for Administrative Reform) এর ৮৬তম বৈঠকে মধ্যনগর উপজেলা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়। কিন্তু বিএনপি জামাত জোট সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২০০৩ সালের ১৮ ই জানুয়ারি নিকার’র ৮৮তম সভায় মধ্যনগর উপজেলা বাস্তবায়নের প্রস্তাবটি বাতিল করে দেন।উপজেলা বাস্তবায়নের লক্ষে বিভিন্ন সময়ে গুনী,সামাজিক,সাংস্কৃতিক সংগঠন মন্ত্রী,প্রধানমন্ত্রী,জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারক লিপি দিয়ে আসছেন।তন্মধ্যে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে ২৩/১০/২০১৬ প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় বরাবর,২৪/০৯/২০১৭, বিভাগীয় কমিশনার বরাবর,২৬/৯/২০১৭ জেলাপ্রশাসক বরাবর, ৯/১১/১৭ প্রধানমন্ত্রী বরাবর,৩০/১১/১৭ প্রধানমন্ত্রী বরাবর,২৬/৪/১৮ জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। দাবিটি সমর্থন জানিয়ে সুপারিশ করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, সাবেক সংসদ সদস্য এডভোকেট সৈয়দ রফিকুল হক সুহেল,সাবেক সংরক্ষিত সংসদ সদস্য শাহানা রব্বানী।
গেল বছরের ২০ এপ্রিল মধ্যনগর থানা মাঠে আয়োজিত সুমেশ্বরী ও উব্দাখালী নদীতে সেতু নির্মানের ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন অনুষ্ঠানে এলজিআরডি মন্ত্রী তাজুল ইসলাম মধ্যনগর উপজেলা বাস্তবায়নে আশ্বাস দেন।একই মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য,স্থানীয় সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, সংরক্ষিত মহিলা সংসদ সদস্য এডভোকেট শামীমা শাহরিয়ার।
গত ৩১ শে আগষ্ট ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন তার ফেইসবুক টাইমলাইনে উপজেলা বাস্তবায়নের আশ্বাস ব্যক্ত করায় মধ্যনগর থানার ৪ টি ইউনিয়নের প্রায় ২ লক্ষ মানুষ সত্যি সত্যি উপজেলা বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখছে।
উপজেলা বাস্তবায়নের আন্দোলন কে তরান্বিত করতে নতুন করে মধ্যনগর উপজেলা বাস্তবায়ন পরিষদ গঠন করা হয়েছে।যেখানে সভাপতি হয়েছে ন এডভোকেট আব্দুল মজিদ ও সাধারণ সম্পাদক অমরেশ রায় চৌধুরী।
মধ্যনগর থানা আ.লীগের দপ্তর সম্পাদক মোঃ আলা উদ্দিন বলেন,
হাওর অধ্যুষিত এই এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য মধ্যনগর উপজেলা বাস্তবায়ন সময়ের যৌক্তিক দাবি। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্মশত বার্ষিকীতেই মধ্যনগরবাসীর জন্য সেরা উপহার হবে উপজেলা বাস্তবায়ন। আমরা ২ লক্ষ মানুষ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখের দিকে এই প্রত্যাশায় থাকিয়ে আছি।
আদিবাসী ট্রাইবাল চেয়ারম্যান আশুতোষ হাজং বলেন,আমাদের মহিষখলা থেকে ধর্মপাশার দুরত্ব ৫০ কিলোমিটারের উপরে।উপজেলা সদরে আসা-যাওয়া প্রায় দেড় হাজার টাকার মতো খরচ হয়। এই কষ্টের লাঘব ঘটানোর জন্য মধ্যনগর উপজেলায় উন্নীতকরণ জরুরি।
কলামিস্ট জীবন কৃষ্ণ সরকার বলেন,সামাজিক,রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ভূগোলিক তথা সব ফ্ল্যাটফর্মেই মধ্যনগর অঞ্চলটি উপজেলা হওয়ার দাবিদার।তাছাড়া মধ্যনগর উপজেলা হলে প্রশাসনিক তথা অর্থনৈতিক দিক থেকে সরকারই বেশি লাভবান হবে।তাই আসন্ন নিকার’র বৈঠকেই মধ্যনগর উপজেলা বাস্তবায়ন হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।”
এই বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান আশ্বাস দিয়ে বলেন, আগামী নিকারের বৈঠকে মধ্যনগর উপজেলা বাস্তবায়নের বিষয়টি তুলে ধরা হবে।এই বছরেই ভাটির জনপদ মধ্যনগর উপজেলা বাস্তবায়ন করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ২২:৩৭:৫৩ ৬৯৬ বার পঠিত #মধ্যনগর উপজেলা বাস্তবায়ন