বঙ্গ-নিউজ ডটকম:মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বা অভিযোগে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা বিচারের কাঠগড়ায়। অভাবিত সহিংস প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির নেতাদের একটি অংশ কারাগারে, বাকিরা পলাতক। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ঘোষিত ছয় রায়ের পাঁচটিতেই পুরো দল অপরাধী সংগঠন হিসেবে প্রমাণিত। সেই সূত্রে রাজনৈতিক দল হিসেবে এর নিবন্ধন ঝুঁকিতে পড়েছে। তৈরি হয়েছে নিষিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকিও।
জামায়াতে ইসলামী। বিশ্লেষকদের ভাষায়, দলটি এখন যেন অন্ধকার সুড়ঙ্গে হামাগুড়ি দিয়ে চলেছে। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দলটি এখন পরিচালিতও হচ্ছে অনেকটা অন্তরালে থেকে। হিংসাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে দলটি কেবল গণতান্ত্রিক রীতিনীতির বিরুদ্ধেই যায়নি, বরং এর প্রতিক্রিয়ার ধরন সন্ত্রাসী বা জঙ্গি সংগঠনের মতো বলেও অনেকে সমালোচনা করছেন।
১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত তিনবার নিষিদ্ধ হয় জামায়াত। এর মধ্যে ১৯৫৯ ও ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রতিষ্ঠার পর অন্য সব ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে জামায়াতও নিষিদ্ধ হয়। সাত বছর পর জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৯ সালের ২৫ মে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ পায় জামায়াত।
স্বাধীনতার ৪২ বছর পর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এখন দলটির শীর্ষস্থানীয় তিন নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড এবং দুই নেতা গোলাম আযমের ৯০ বছর ও আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। দলের আমির মতিউর রহমান নিজামীর মামলার কার্যক্রম মাঝামাঝি পর্যায়ে রয়েছে। অপর চার নেতা এ কে এম ইউসুফ, আবদুস সুবহান, এ টি এম আজহারুল ইসলাম ও মীর কাসেম আলীর প্রাক্-বিচার কার্যক্রম চলছে।
মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতার পাশাপাশি রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন করে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ নানা অপরাধের সঙ্গে দলটির নেতারা যুক্ত ছিলেন বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হয়েছে।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দিয়ে নেতাদের মুক্তির জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে গিয়ে জামায়াত নিজেই এখন অস্তিত্বের সঙ্গে লড়াই করছে। দলের ২১ সদস্যের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের ১২ জন কারাগারে, সাতজন বিভিন্ন মামলার আসামি হয়ে আত্মগোপনে আছেন। বাকি দুজনের একজন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতাদের প্রধান আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক। তিনি আইনি বিষয়াদি ছাড়া দলীয় অন্য কোনো কর্মকাণ্ডে সক্রিয় নন। অপরজন ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবু নাছের মো. আবদুজ জাহের, তিনিও দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে দূরে আছেন। দলের ঢাকা মহানগর কমিটির সবাই আত্মগোপনে। পলাতক থেকেই দল চালাচ্ছেন মধ্যম সারির নেতারা। ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কাকরাইলে পুলিশের সঙ্গে সহিংস সংঘর্ষের পর থেকে দলের কেন্দ্রীয় ও মহানগর কার্যালয় বন্ধ রয়েছে।
জানতে চাইলে জামায়াতের রাজনীতির অন্যতম পর্যবেক্ষক ও সাবেক সচিব শাহ আবদুল হান্নান বলেন, ‘খুব কম দলই এ রকম অস্বাভাবিক পরিস্থিতির শিকার হয়েছে। এর পরও নিম্ন ও মধ্যম সারির নেতারা তাঁদের সাধ্যমতো বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এতে করে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে একধরনের দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে।’
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর প্রথম বছরটি নির্বিঘ্নে ছিল জামায়াত। ২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে করা একটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে। পরে তাঁদের নামে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। বস্তুত তখন থেকেই দলটির ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেওয়া শুরু করে সরকার।
এরপর দলের কয়েকজন নেতার মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলে গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে সহিংস প্রতিক্রিয়া জানানো শুরু করে জামায়াত ও তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। বিশেষ করে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর অন্তত ২৮টি জেলায় ব্যাপক সহিংসতা চালায় তারা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও প্রতিকার কমিটির সভায় উপস্থাপিত হিসাবে ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ মার্চ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাত সদস্যসহ ১১৬ জনের প্রাণহানি ঘটে।
সর্বশেষ ১৪ জুলাই ট্রাইব্যুনাল দলের সাবেক আমির গোলাম আযমের মামলার রায় ঘোষণার তারিখ ধার্য করার পর হরতাল ডেকে আবার পুলিশের সঙ্গে সহিংসতায় জড়ায় জামায়াত-শিবির। দুই দিনের হরতালে নয়জন নিহত হয়। সব মিলিয়ে দলটি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরনের ভীতি ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।
অবশ্য সাঈদীর মামলার রায়ের পর জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা সারা দেশে যেভাবে আগ্রাসী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার ফলে বর্তমানে অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন তাঁরা। এ কারণে দলের তাত্ত্বিক নেতা হিসেবে পরিচিত গোলাম আযম ও অপর নেতা আলী আহসান মুজাহিদের মামলার রায়ের পর সেভাবে রাস্তায় দাঁড়াতে পারেননি তাঁরা।
জামায়াতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, সরকারই তাদের সহিংসতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। সরকার তাদের গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক অধিকার হরণ করেছে। দলীয় কার্যালয় বন্ধ করে দিয়েছে। কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে দিচ্ছে না। এমনকি জামায়াতের নারী কর্মীরা জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করতে গেলে তাঁদেরও গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে প্রায় ছয় হাজার নেতা-কর্মী জেলে আছেন বলে দাবি করেন তাঁরা। সারা দেশে কয়েক লাখ নেতা-কর্মীকে মামলার আসামি করা হয়েছে।
তবে দলটির মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার সম্পাদক আবুল আসাদ মনে করেন, ‘নিপীড়ন যত কঠিনই হোক, এর শেষ হবেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে জামায়াতের উচিত হবে গণতান্ত্রিক পথেই গণতন্ত্রকে উদ্ধারের চেষ্টা করা। শেষ পর্যন্ত এ পথেই প্রতিকার আসবে।’
অবশ্য উদ্ভূত পরিস্থিতিতে হরতাল বা রক্তক্ষয়ী সহিংস আন্দোলনের শেষ ফল কী, তা নিয়ে জামায়াতের ভেতরে নানামুখী আলোচনা হচ্ছে। দলের নীতিনির্ধারকদের একটি অংশ মনে করছে, একাত্তরের ক্ষত মুছে এর দায় থেকে দল ও নেতাদের উদ্ধার করে আবার ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। এ অবস্থায় মানবতারিরোধী অপরাধের বিচারের মুখোমুখি হওয়া নেতাদের নেতৃত্ব থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে একসময় দলের ভেতরে যে ভাবনা ছিল, তা আবার সক্রিয় হয়েছে বলে জানা গেছে। দলটির কেউ কেউ মনে করছেন, এ ব্যাপারে আগেই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল।
জানতে চাইলে জামায়াতের ঢাকা মহানগর কমিটির সহকারী সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম
বঙ্গ-নিউজ কে বলেন, ‘আমরা রায়কেন্দ্রিক এবং সরকারবিরোধী সামগ্রিক আন্দোলন করছি। কর্মীরা মনে করে, এখন পিছিয়ে আসলে আমরা কেউ থাকব না। তাই কর্মীরা যেকোনো মূল্যে এ সরকারকে রুখবেই।
বাংলাদেশ সময়: ১২:৩৫:২৩ ৩৯৫ বার পঠিত