বুক রিভিউ: যদ্যপি আমার গুরু
লেখক: আহমদ ছফা।
——————————————————————
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি-১৯৯৮
প্রকাশনা: মওলা ব্রাদার্স।
১৯৭০ সাল। বাংলা একাডমী তিন বছরের ফেলোশিফ প্রোগ্রামে প্রার্থীদের কাছ থেকে আবেদন পত্র আহবান করে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করলো। ঠিক তখনই বিখ্যাত লেখক ও সাহিত্যক আহমদ ছফা বন্ধুদের অনুরোধে দরখাস্ত করে বৃত্তিটা পেয়ে গেলো। এখন দরকার একজন অফিসিয়াল থিসিস সুপার ভাইজার। বন্ধুদের পরামর্শে অধ্যক্ষ আব্দুর রাজ্জাকের বাড়ীতে আহমদ ছফা উপস্থিত হয়। এরপর থেকে দীর্ঘ সাতাশ বছর পর্যন্ত গুরু-শিষ্যের কাজকর্ম ও কথোপকথনে উঠে আসে তৎকালীন সমাজ কাঠামো, রাষ্ট্র ব্যবস্থা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, ও বিভিন্ন মনীষীদের জীবনাচরণ। লেখক আহমদ ছফা সেই স্মৃতি গুলোকে ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন। জ্ঞানতাপস আব্দর রাজ্জাক হ্যরন্ড লাস্কির সাথে থিসিস, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যক্ষ ও পরে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দেশি বিদেশী জ্ঞানী-গুনী পন্ডিতরা তার বাড়ীতে আসা যাওয়া করতো। হেনরি কিসিঞ্জার, ভারতের হাইকমিশনার,শহীদ সোহরাওয়ার্দী লোকদের সাথে ছিল তার গভীর সম্পর্ক। জ্ঞানের সাধনায় তিনি ছিলেন মৃত্যু অবধি চির কুমার। সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ও অন্যের প্রতি ছিলেন পরোপকারী। আহমদ ছফা তার বইয়ের ভান্ডার দেখে অভিভূত হন। ছফা বলেন: “দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা নির্মাণে, নিষ্কাম জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে, প্রচলিত জনমত উপেক্ষা করে নিজের বিশ্বাসের প্রতি স্থিত থাকার ব্যাপারে প্রফেসর অাব্দুর রাজ্জাকের মত অামাকে অন্য কোন জীবিত বা মৃত মানুষ অতোটা প্রভাবিত করতে পারেনি”। প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক ঢাকাইয়া বুলিতে কথা বলতেন এবং অহমদ ছফাকে ‘মৌলবি আহমদ ছফা’ বলে ডাকতেন। রাজ্জাক স্যার বলেন: ” কোন এলাকার হাবভাব বোঝার জন্য দুটো জিনিস দেখতে হয়- তারা কি খায় আর কেমন বই পড়ে”। অল্প বয়সী নিয়াজ মোর্শেদকে দাবা খেলার ট্রেনিং দেওয়ার আলোচনা, অমর্ত্য সেনের সঙ্গে অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কিংবা শেক্সপিয়ারের লেখার সমালোচনা, এমনকি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে রাজ্জাক সাহেবের স্মৃতি কথাও উঠে এসেছে বইটিতে। লেলিন-মাক্স, হেনরি কিসিঞ্জার, ধর্মনিরপেক্ষতা, এসব নিয়ে নতুন করে পাঠক হ্রদয়ে ভাবার ইচ্ছা জাগাবে আহমদ ছফা ও অাব্দুর রাজ্জাক স্যারের কথোপকথনে। রাজ্জাক স্যার সবসময় চাইতেন অন্যের মধ্যে জ্ঞানের স্পৃহা জাগরত করতে। তিনি বই পড়া প্রসঙ্গে খুব দারুন একটা কথা বলেছেন, ” পড়ার কাজটি অইল অন্যরকম। অাপনে যখন মনে করলেন, কোন বই পইড়্যা ফেলাইলেন, নিজেরে জিগাইবেন যে বইটা পড়ছেন, নিজের ভাষায় বইটা আবার লিখতে পারবেন কিনা। আপনের ভাষায় জোর লেখকের মতো শক্তিশালী না অইতে পারে, অাপনের শব্দ ভান্ডার সামান্য অইতে পারে, তথাপি যদি মনে মনে অাসল জিনিসটা রিপ্রোডিউস না করবার পারেন, ধইর্যা নিবেন আপনের পরা অয় নাই”। তার শিল্পকলার প্রতি ছিল গভীর অনুরাগ। তিনি শিল্পী জয়নুল আবদীন, এস এম সুলতানের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ছফা ও রাজ্জাক স্যারের আলোচনা থেকে বুঝা যায়, রাজ্জাক স্যার ঈশ্বরচন্দ্র, জসীমউদ্দীন, নজরুল, মুনীর চৌধুরী প্রমুখ ব্যক্তিদের প্রশংসা করেছেন অকুণ্ঠচিত্তে। অন্যদিকে বঙ্কিমচন্দ্রের রাজা রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের করেছেন সমালোচনা। তিনি ছিলেন দ্বি-জাতি তত্ত্বে বিশ্বাসী ও মুসলিম লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক। ইসলাম ধর্মকে একমাত্র দুনিয়া ও অাখেরাতের সমন্বয়ক ধর্ম হিসেবে তিনি মনে করতেন। রাজ্জাক স্যারের ভালোবাসায় সিক্ত ছফা, বইটা লেখার উদ্দ্যেশ্য গুরুর মহত্ব বর্ণনা কিংবা আব্দুর রাজ্জাক স্যারের নানান প্রশ্নের বাখ্যা প্রদান করা অনেকে মনে করতে পারেন, কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, ছফার উদ্দেশ্য হল, এই অসাধারণ মানুষটির সান্নিধ্যের স্বাদকে অন্যোর কাছে ভাগাভাগি করা। গুরু শিষ্যের জ্ঞানগর্ভে বিরচিত ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইটি যদিও পৃষ্টা সংখ্যা ১১০টি তবুও মনোজাগতিক পরিবর্তন ও জ্ঞানে সমৃদ্ধ বইটি না পড়লে পাঠকবৃন্দ এর মর্ম উপলব্ধি করতে পারবেন না। তাই পাঠকবৃন্দের প্রতি বিশেষ অনুরোধ এই লকডাউনে বইটির হ্যার্ড কপি না পারলেও অন্তত সফ্যট কপি অবশ্যই আপনারা পড়ে নিবেন। পরিশেষে শেষ করব ‘যদ্যপি আমার গুরু’র দুইটা লাইন দিয়ে, ” আমি বললাম বাংলার ভবিষৎ সম্পর্কে কিছু বলেন। স্যার বললেন, বাংলার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমি আর কি কমু। সে তো আপনাগো উপর”
রিভিউ : জাকির হোসাইন।
শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: jakirhosain8999@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৮:০৬:০৯ ১০৫৬ বার পঠিত #বুক রিভিউ: যদ্যপি আমার গুরু