স্বপন চক্রবর্তী,বঙ্গ-নিউজ; ঢাকা একটি স্বপ্নের শহর। এর জনসংখ্যা খুব দ্রুতই বেড়ে চলছে। সারা দেশ থেকে অসংখ্য জনস্রোত এসে ভীড় করছে এই শহরে। কেউবা স্থায়িভাবে আর কেউবা অস্থায়ী ভাবে বসবাস করছে। আছে কেউ বস্তিতে,আর কেহ অট্টালিকায়। ভাসমান মানুষের সংখ্যাও একেবার নগন্য নয়। জীবীকার সন্ধানে এসেছেন অনেকে। অনেকে চাকুরীর কারনে।আবার কেহ ব্যবসা সংক্রান্ত কারণেও এসেছেন। এই সব কারণে বর্তমান সময়ে ঢাকা অত্যন্ত ব্যস্ততম নগরী। বিশ্বের মধ্যেও অন্যতম জনবহুল একটি ব্যস্ত নগরী। ইদুল আজহা উপলক্ষ্যে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও অনেকটা ফাঁকা হয়ে উঠেছিল এই শহর। ইদুল আজহা উপলক্ষ্যে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও অনেকটা ফাঁকা হয়ে উঠেছিল এই শহর। করোনা সতর্কতার কারণে কিছুদিন আগে থেকেই শহরটি নীরব হতে থাকে।ঢাকা (ইংরেজি: Dhaka, পূর্বে Dacca) দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। আবার সাময়িক ভাবে জনশূন্য এই নগরী ইদ শেষে জনাকীর্ণ হতে চলেছে। এই গ্রামগঞ্জের ঢাকাবাসী মানুষ শিখরের টানে ইদ উদদযাপন করতে গ্রামে গেলেও চিরায়ত জনবহুল নগরী আবার কানায় কানায় পূর্ণ প্রায়। এই যাতায়াতের পথে সহ্য করে এক অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। জীবন হারায় অনেকে।
এই ঢাকা মহানগরী এখন মেগা সিটি । কিন্তু সুদুর অতীতে বসতি ছিল খুবই কম। উন্নত ছিলনা জীবন যাত্রার মান। মানুষের এতো আগ্রহ বা আকর্ষণ ছিলনা ঢাকা শহরের প্রতি। কিন্ত এখন আর তেমনটি নেই।
যদিও আধুনিক ঢাকা শহরের বিকাশ ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ শাসন আমলে ।
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি নগরায়ণ হয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, ঢাকায় গত ৪০ বছরে লোকসংখ্যা বেড়েছে ১ কোটি ৫২ লাখ। যেখানে ১৯৭৪ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আদমশুমারিতে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১৬ লাখের মতো। ২০৩০ সাল নাগাদ ঢাকা বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম মেগাসিটিতে রূপান্তরিত হবে। বছরে ঢাকা শহরে নতুন করে ৬ লাখ ১২ হাজার লোক যুক্ত হয়। দিনে যুক্ত হয় ১৭শ’ মানুষ। ঢাকা মহানগরীতে প্রতিবছর ১ লাখ ২০ হাজার বাসগৃহ প্রয়োজন। কিন্তু তার চাহিদা পূরণ করা কঠিন। ডেভেলপাররা সরবরাহ করতে পারে ২৫ হাজারের মতো। তাও মূলত উচ্চবিত্তের জন্য।
ঢাকা শহরে যতটুকু জলাভূমি ছিল, তা গত ৪০ বছরে ৭৫ শতাংশ হারিয়ে গিয়েছে। এসব জলাভূমি ভরাট করে বাড়িঘর স্থাপন করা হয়েছে। যে কারণে ঢাকার জলাবদ্ধতার সমস্যা রয়েছে। ওদিকে নদ-নদী দখলদারিত্ব করেছে ৪৯ হাজার ১৬২ জন। তার মধ্যে ঢাকার তুরাগ নদ, বুড়িগঙ্গা নদী দখলদারিত্বে প্রায় ধ্বংসের পথে।
নানা প্রতিষ্ঠান ক্লিনিক, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে রাজধানী ঢাকা তার নান্দনিকতা হারিয়েছে। ঢাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪৮টি। সর্বোচ্চ সংখ্যক ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলও ঢাকায় রয়েছে। ঢাকায় কলেজ রয়েছে ২২২টি। মাদ্রাসার ২৮ শতাংশ অর্থাৎ ৩০ লাখ ৩০ হাজার শিক্ষার্থী ঢাকায় পড়াশোনা করে। অথচ ভারতের নয়াদিল্লিতে ১০টি পাবলিক এবং বাকিগুলো অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়। তার চেয়ে তিন গুণ বড় পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে ১৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাতটি বেসরকারি। ঢাকার চেয়ে সাতগুণ বড় জাপানের রাজধানী টোকিওতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৪১টি। ঢাকায় বিভিন্ন কারখানা রয়েছে ১ হাজার ৫৫৫টি ।
পরিসংখ্যানে জানা যায়, রাজধানী ঢাকায় ৮ লাখ ৫৩ হাজার ৩০৪টি যানবাহন চলাচল করছে। এর মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ি ২ লাখ ৩০ হাজার ৩৩টি। সিটি করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী ঢাকায় নিবন্ধিত ৩ লাখ রিকশা চলাচল করে। অথচ ঐতিহ্যবাহী টমটম নামে খ্যাত দূষণমুক্ত ঘোড়ার গাড়ি রয়েছে প্রায় ৭০ থেকে ৭৩-এর মধ্যে। বিআরটিএ’র হিসাব মতে, সিএনজির সংখ্যা ১৩ হাজার।
বিশ্বের অন্যতম বসবাসের অযোগ্য একটি শহর এই ঢাকা মহানগরী। ব্রাসেলস, বার্লিন, বার্সেলোনা অথবা ধরা যাক ডালাস, দিল্লি বা দোহা। জীবনযাত্রার ব্যয় হিসেব করলে এসব নগরীর তুলনায় ঢাকা নগরীর অবস্থান কোথায়?
অন্তত বিদেশিদের জীবনযাত্রার খরচ যদি ধরেন, তাহলে ঢাকা নগরী এদের সবার উপরে, অর্থাৎ ঢাকা অনেক বেশি ব্যয়বহুল নগরী।
মার্কার নামের একটি সংস্থা আবারও বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল নগরীগুলোর তালিকা প্রকাশ করেছে। ২০৯টি নগরীর সেই তালিকায় বিশ্বের অনেক উন্নত এবং ধনীদেশের বড় বড় নগরীকে পেছনে ফেলে ঢাকার অবস্থান ৬৬ নম্বরে।
বাংলাদেশের মতো একটি অনুন্নত এবং পিছিয়ে থাকা অর্থনীতির একটি দেশের রাজধানী শহর কেন এতটা ব্যয়বহুল? সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে এক নজরে দেখে নেয়া যাক ব্যয়বহুল নগরীগুলোর তালিকায় কাদের অবস্থান কোথায়।
মার্কার ব্যয়বহুল নগরীর এই সূচক তৈরি করে কোন নগরীতে বিদেশিদের জীবনযাত্রার খরচের তুলনা করার জন্য। মোট দুশটি আইটেমের ব্যয় বিবেচনায় নেয়া হয়। এর মধ্যে আছে বাসস্থান, যাতায়ত, খাবার, বিনোদন থেকে শুরু করে নানা কিছুর দাম। এক কাপ কফি, এক বোতল পানি, এক লিটার পেট্রোল বা এক লিটার দুধ। মানদন্ড হিসেবে ধরা হয় নিউ ইয়র্ক নগরীকে। আর খরচের হিসেব তুলনা করা হয় মার্কিন ডলারে।
জানা যায়, আগে ২০১৮ এবং ২০১৭ সালে যানজটে ঢাকার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। তার আগে ২০১৬ সালে ঢাকার অবস্থান ছিল তৃতীয়। কিন্তু মাত্র তিন বছর আগে ২০১৫ সালে ঢাকা ছিল অষ্টম। বসবাস অযোগ্যতায় তিন বছরে দুই ধাপ উন্নতি হলেও যানজটের দিক দিয়ে চার বছরে আট ধাপ অবনতি হয়ে আমরা প্রথম হয়ে গেছি। বিভিন্ন দেশের রাজধানী এবং গুরুত্বপূর্ণ ২০৭টি শহরকে বিবেচনায় নিয়ে এ তালিকা প্রণয়ন করেছে নামবিও। এ ক্ষেত্রে তারা সময় অপচয়, অদক্ষতা ও কার্বন-নিঃসরণকে আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘নামবিও’র প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স-২০১৯-এ একটি তথ্য উঠে এসেছে। নামবিওর তথ্য বিবেচনায় নিয়েছে। বিশ্বের অনিরাপদ নগরীর তালিকায়ও ঢাকা পঞ্চম।
এই তালিকাটিও করেছে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। ডিজিটাল নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, অবকাঠামোগত নিরাপত্তা এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকে বিবেচনায় রেখে এ তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসেবার দিক থেকে ঢাকা চতুর্থ অনিরাপদ নগরী। আর ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় ষষ্ঠ অনিরাপদ নগরী ঢাকা। কিছুদিন আগে আরেক রিপোর্টে আমরা জেনেছিলাম, বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিত রাজধানী ঢাকা, সবচেয়ে দূষিত বাংলাদেশ। ২০১৮ সালে বিশ্ব বায়ুর মান যাচাই করে দেওয়া রিপোর্ট থেকে এমন তথ্যই উঠে এসেছিল।
বাতাসে ক্ষুদ্র কণিকার উপস্থিতির পরিমাণ হিসাব করে বায়ুদূষণের মাত্রা হিসাব করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ডব্লিউএইচও স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিবেচনা করে বাতাসে ক্ষুদ্র কণিকার গড় মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে সর্বোচ্চ ১০ মাইক্রোগ্রাম নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। কিন্তু ঢাকার বাতাসে এই কণিকার মাত্রা ২০১৮ সালে প্রতি ঘনমিটারে পাওয়া যায় ৯৭ দশমিক ১ মাইক্রোগ্রাম, যা নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে থাকা পাকিস্তান ও ভারতের বাতাসে ক্ষুদ্র কণিকার মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে যথাক্রমে ৭৪ দশমিক ৩ ও ৭২ দশমিক ৫ মাইক্রোগ্রাম ছিল। এই বায়ুদূষণের জন্য দায়ী করা হয় ঢাকার আশপাশের ইটভাটা, ঢাকার নির্মাণকাজ, যানবাহনে ব্যবহৃত জ্বালানি, বর্জ্য পোড়ানো ইত্যাদি। ঢাকার এই অধঃপতন নিয়ে অনেকের গবেষণা রয়েছে। তন্মধ্যে থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের করা এক তালিকায় নারীদের জন্য সবচেয়ে খারাপ মহানগরের মধ্যে বিশ্বে সপ্তম স্থানে আছে ঢাকা। যৌন সহিংসতা বিবেচনায় নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ; এখানে বাংলাদেশের স্থান চতুর্থ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা জিপজেটের করা পর্যবেক্ষণের ফলাফল অনুযায়ী বিশ্বে সবচেয়ে শারীরিক ও মানসিক চাপের শহরগুলোর মধ্যে সপ্তম স্থানে আছে ঢাকা।
বাসযোগ্যতার দিক থেকে হোক, নিরাপত্তার দিক থেকে হোক, নারীর জন্য বা মানসিক চাপের প্রশ্নেই হোক, সব ক্ষেত্রেই ঢাকার স্থান একেবারে নিচের দিকে। কিন্তু সব দিক থেকে তলানিতে থাকা ঢাকাকে টেনে তুলবে কে?
তীব্র যানজট, একটু বৃষ্টিতেই পুরো শহর ডুবে যাওয়া, গাড়ির হর্ন, ধুলা, এমন হাজারো কষ্টের শহর ঢাকা৷ কিন্তু তারপরও দেশের জনসংখ্যা না বাড়লেও ঢাকার জনসংখ্যা কিন্তু দিন দিন বেড়েই চলেছে৷ কেন?
৬৪ জেলার দেশ বাংলাদেশ৷ সবশেষ আদমশুমারি বলছে, মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটির একটু বেশি৷ অথচ, ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের পরিসংখ্যান বলছে, শুধু ঢাকা শহরেই বাস করছেন প্রায় ২ কোটি মানুষ ৷
সম্পদের চেয়ে জনসংখ্যা যখন বেশি হয়ে যায়, তাকেই বলে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ৷ পুরো দেশের হিসেবে সে আশংকা আপাতত বাংলাদেশ ঠেকাতে পারলেও, ঢাকা কিন্তু বিশ্বব্যাপী এখনও উদাহরণ হয়েই আছে ৷
নাগরিকদের সঠিকভাবে সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ঢাকাকে ভাগ করা হয়েছে দুই সিটি কর্পোরেশনে৷ কিন্তু তাতে যে কোনো লাভই হয়নি, সেটা আবারও প্রমাণ হয়েছে এবারের বর্ষায়৷ সড়কে নৌকার চলাচল রীতিমতো ঢাকার সেবা ব্যবস্থাকে পরিণত করেছে কৌতুকের সামগ্রীতে ৷
একদিন জনসংখ্যা নিয়ে একজন ভারতের সাংবাদিকের সাথে ৷ ঢাকাকে তিনি দিল্লির সাথে তুলনা করলেন ৷ পত্রিকা দেখে পরিবেশ ও সেবা সংক্রান্ত যে খবরগুলো পাওয়া যায়, তাতে নির্দ্বিধায় বলা হয়ে ছিল, ঢাকার অবস্থা দিল্লির মতো এতোটা খারাপ হয়নি এখনও ৷
বাংলাদেশ সময়: ২১:০১:৫৮ ৮০৫ বার পঠিত #আগেকার ঢাকা #আগেকার বাংলাদেশ #জনবহুল নগরী ঢাকা #ঢাকা নগরী #ব্যস্ততম ঢাকা