১। সশস্ত্র বাহিনীতে করোনা চিকিৎসায় যখন আমার দায়িত্ব শুরু হল কোয়ারান্টাইনের অংশ হিসেবে আমার মায়ের বাড়িতে যাওয়া তখন থেকে বন্ধ। একই নগরীতে থাকি। মোবাইলে কথা হয়। তখনও করোনা ঢাকায় রুদ্ররুপে প্রকাশ করে নি। মা শুধু আমাকে নিজের নিরাপত্তার কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন।’চিকিৎসক হিসেবে এই ভয়াল রোগের থাবা থেকে মানুষকে বাঁচাতে লড়বার সৌভাগ্য তাঁর সন্তান পেয়েছে’ এই আত্মতৃপ্তি মায়ের ছিল। আমি যেন বিভ্রান্ত না হই তাই নিজের অসুস্থতার কথা খুব একটা বলতেন না। বরং আমিই তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলাম তাঁর বয়স, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগের কথা। মা মৃদু হাসেন। উল্টো আমাকে নির্ভাবনার কথা শোনান।
২।
‘ পিঁপড়ার ভয়ে মা না থুইলা মাটিত
কোলে নিয়া বুক দিয়া জগতে বিদিত
আশক্য আছিলুঁ মুই দুর্বল ছাওয়াল
তান দয়া হন্তে এই ধড় বিশাল। ‘
—–শাহ মোহাম্মদ সগীর
সগীর মনে হয় প্রায় ৬০০ বছর আগে দিব্য চোখে মা আর এই অর্বাচীনকে দেখতে পেয়েছিলেন।ছোটো বেলায় আমি ছিলাম লিকপিকে ।এটা ওটা অসুখ লেগেই থাকতো। ক্লাশে বন্ধুরা আমার খর্বাকৃতি নিয়ে খেপাতো। আমি প্রায় ক্লাশ থেকে বাসায় ফিরে কাঁদতাম।মা বলতেন, ‘তুই বড় হবি বাবা। ওদের থেকে অনেক বড়।’সেইসব সাথীরা হারিয়ে গেছে। সেই শুকনো ছেলেটি সামরিক বাহিনীতে কমিশন পেয়ে গেলো। ভাটিয়ারী মিলিটারি একডেমিতে ইংরেজি বিতর্ক হত। আমি শুধু বুঝি আমার নিউরনে মা শক্তি যোগাচ্ছেন।কোথা থেকে আসতো অমিয় সব শব্দমালা! প্রতিপক্ষের ট্রেইনি অফিসারদের যুক্তি সহসাই খন্ডিত হত শানিত প্রত্যুত্তরে। সবাই একসারিতে যখন দাঁড়াতাম দেখতাম বিশাল ধড় নিয়ে লম্বায় প্রায় সবাইকে ছাড়িয়ে গেছি । মা, দেখ, পিঁপড়ার ভয়ে তুমি মাটিতে রাখো নি, তোমার সেই ছেলে অস্ত্র হাতে ট্রেনিং করে!
৩।অনেকের মতই আমার জীবনেও কষ্টের দিন ছিল। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে থিসিস করবার সময় ভয়ানক অনিশ্চয়তা আমাকে ঘিরে ধরলো। আমি সরকারি কোয়ার্টার ছেড়ে মায়ের বাড়িতে চলে এলাম।রাতে বুড়োখোকাটা মায়ের সাথেই ঘুমাতো ।থিসিস ডিফেন্ড করছি, অভয় বানী দেয়া মায়ের স্মিত হাসিমাখা মুখটা মনে পড়লো। বুঝি, বুকে হাজার হাতির সাহস। আমার মুখ দিয়ে অনর্গল কথা বেরুচ্ছে। পরীক্ষা শেষে গাইড আমাকে বিজয়ের বার্তা জানিয়ে দিলেন।
৪।মায়ের কিছু ‘প্যাশন ‘ ছিল। যৌতুকে দায়গ্রস্ত কন্যাদের বিয়ের ব্যবস্থা করা। দূর সম্পর্কের আত্মীয়, এমন কি অচেনা বেশ কিছু কন্যাকে পাত্রস্থ করেছেন ব্যপক ঝুঁকি আর গাঁটের পয়সা খরচ করে। কারও মৃত্যুর সংবাদ শুনলে সেই বাড়িতে যাওয়া চাইই চাই। মুর্দা ধোয়ানোর কাজটি করতে মরহুমাদের অনেক নিকটজনই নানা ছুতায় পাশ কাটিয়ে গেলেও মা মুর্দা ধোয়ানোর পবিত্র কাজটি করতেন পরম মমতায়।
৫।জীবনের বাঁকে বাঁকে ঝড় বন্যা এসেছে। আমি জানি একজোড়া চোখ সারারাত অশ্রুজলে ভিজেছে।জায়নামাজে দু’হাত তুলে সন্তানের মংগল কামনা করেছেন। একদিনের কথা বলি। বিশেষ কিছু কাগজ মায়ের কাছে ছিল। সেগুলি হটাৎ করে সেদিনই দরকার হল। সম্ভবত ড্রাইভার ছুটিতে ছিল। মা ধড়মড় আসতে যেয়ে পথে রক্তাক্ত হলেন।সেই ক্ষত লুকিয়ে মা আমার পাশে হাজির। হাজার সূর্যের আলোতে অন্ধকারের বিরুদ্ধে আরেকবার জ্বলে উঠলাম।
৬।সন্মিলিত সামরিক হাসপাতালের আই সি ইউতে মায়ের লাইফ সাপোর্টে থাকা ৫ দিন ছুঁয়েছে। তাঁর কষ্ট হচ্ছে।কর্তব্যরত চিকিৎসক আমার দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালেন। আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ি। মা ‘ ডেডবডি ‘হয়ে গেলেন ।করোনা যুদ্ধে ক্লান্ত বাবা আজ সকালে রিলিজ হয়ে বাসায় ফিরেছেন।বোনটারও করোনার চিকিৎসা চলছে।আমার পাশে আমার একমাত্র ভাই, মামা। কাকে আমি সবার আগে বলবো ‘ মরিলে কান্দিস আমার দায় রে, যাদুধন! ‘
৭।হয়ত নিষ্ঠুর পৃথিবী আমাকে আরও অনেক কঠিন দিনের মুখোমুখি করাবে । সেটিই জীবন।কিন্তু,শেষ পর্যন্ত মাটি কামড়ে লড়াই করাটা মা - ই শিখিয়েছেন।আমি আমার ১০ বছরের শিশু সন্তানের দিকে তাকাই। কি নির্ভরতায় তার মায়ের পাশে ঘুমাচ্ছে! বড্ড ঈর্ষা। জীবনের চলার পথে আমার প্রাপ্তির খাতাটিও নেয়াত কম ভারী সেটি বলা যায় না!ললাট ভবিষ্যতে আরো কিছু দিতেও পারে। কিন্তু’ মা’ কে কখনই আর ফেরত দেবে না।মায়ের ডেথ সার্টিফিকেটটা যখন আমাকে তুলে দেওয়া হল তখনও মনে হচ্ছিল এটি অন্য কারো।ভুল করে আমার কাছে চলে এসেছে।
জীবন এতো ছোটো ক্যানে, মা?
লেখকঃ মেজর ডা. খোশরোজ সামাদ
ক্লাসিফাইড স্পেশালিষ্ট ফার্মাকোলজি
আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজ
বাংলাদেশ সময়: ১৪:২৯:৪৫ ৭১০ বার পঠিত #মেজর ডা. খোশরোজ সামাদ