বঙ্গ-নিউজ ডটকমঃকালকেউটের ফণায় নাচছে লখিন্দরের স্মৃতি/ বেহুলা কখনো বিধবা হয় না, এটা বাংলার রীতি।’ কালনাগের বিষে নীল লখিন্দরকে সুস্থ করে তুলতেই দেবতাদের স্বর্গে যেতে হয়েছিল মর্ত্যের বেহুলাকে। মনসামঙ্গল কাব্যের বেহুলা-লখিন্দর চিরভাস্বর বাংলার মানুষের মনে।সাভারের বেদেপল্লীতে দেখা মেলে কালনাগের। কালো রঙের শরীরে যেন লাল রক্তের ছোপ ছোপ, রয়েছে সোনালি রঙ। কালনাগ আবারো লখিন্দরকে মারণ ছোবলে বেহুলাকে বিধবা করতেই যেন ছটফট করছে সাপুড়ে জহিরউদ্দিনের হাতে।
জহিরউদ্দিনের আরেক হাতে থাকা সবুজ পঙ্খীরাজকে ছোবল দিতে একটু পরপরই ফণা তুলছে কালনাগ। সাপুড়ে জানায়, এই সেই কালনাগ- যার দংশনে বিধবা হয়েছিল বেহুলা। সারারাত জেগেও বাঁচাতে পারেনি চাঁদ সওদাগরের ছেলেকে।
কালনাগের বাস কালীদহে। মনসা যেবার কালনাগকে ডাকতে লোক পাঠিয়েছিল, কালী কালী ডাক শুনে রাগে থর থর করে কেঁপেছিল কালীয় নাগ। ফণা উচিয়ে ফস ফস করে গর্জন করে উঠেছিল। কালনাগ বলেছিলো- ‘আজি মম বিক্রম দেখিবে ত্রিসংসার/ বিষ বরিষণে পুড়ি করি ছারখার’।
জহিরউদ্দিন আর তার ভাই রাহজউদ্দিন জানায়, এ কালনাগের বিষেই সবচেয়ে বেশি প্রাণ যায় সাপুড়েদের। এই সাপটি তারা ধরেছিল দিনাজপুরে, বছর ৪ আগে।
চাঁদসদাগরের ছিল ছয়টি পুত্র। দেবী মনসার ক্রোধে একে একে ছয়টি পুত্রই বাসর ঘরে কালনাগের ছোবলে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। বিদেশ বিভুইয়ে চাঁদের সদাগরী নৌকাডুবির ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়। দেবী মনসার কোপানলে পড়ে নানা নির্যাতন ভোগ করে সর্বশান্ত হয়ে শেষে চাঁদ সওদাগর দেশে ফেরেন। সদাগর দেশে ফেরার ঠিক দশ মাস দশ দিন পর, চাঁদের ঘর আলোকিত করে তার আরেকটি পুত্রের জন্ম হয়। অনেক পাঁজি পুঁথি দেখে একটি শুভক্ষণে চাঁদের বংশের শেষ প্রদীপের নাম রাখা হলো লখিন্দর…
বেহুলা আর লখিন্দরের বাসর অষ্টধাতু দিয়ে মোড়ানো। তবে কালু কর্মকারকে দিয়ে ঘরে সিঁদুরের চিহ্ন দিয়ে ছোট ছিদ্র করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু হায়! স্বামীকে বাঁচাতে নির্ঘুম বেহুলা সুন্দরী। বাইরে অনেক পাহারাদার।
কালনাগের অনুরোধে নিদ্রাদেবী সবার চোখে ঘুম ঢেলে দিয়েছিল।
জহিরউদ্দিন বলেন, যাকে দংশন করবে বলে ঠিক করে, প্রতিজ্ঞা পালন না করে থামে না কালনাগ। নিদ্রাদেবীকে বলে সকলকে ঘুম পাড়িয়ে দেয় সে।
ঘুমের ঘোরে হঠাৎ করেই লখিন্দরের পা নাগের গায়ে লেগে যায়। কালনাগ বিশাল ফণা দোলাতে থাকে। ‘সাক্ষী করে কালীনাগ যত দেবগণ/ আপনার দোষে যায় যমের ভুবন’।
দেবতা, চন্দ্র-সূর্য , বসুমতী, দিন-রাত সবাইকে সাক্ষী মানে কালনাগ। প্রদীপের ঘি সারা লেজে মেখে নেয়। তারপর সাবধানে লখিন্দরের আঙুলের ওপর লাগায়। এবারে দংশন করতে বাধা নেই। নিজের সব বিষ ও মনসা মায়ের দেয়া পাঁচতোলা বিষ জিহ্বার কাছে এনে কালনাগ দংশন করে লখিন্দরকে।
বেহুলাকে ডেকে বলে, ‘সত্বর ওঠো প্রিয়া কামড়াল কিসে/ সর্বাঙ্গ পুড়িয়া উঠে কালকূট বিষে’।
এমনই বিষ কালনাগের! জহিরউদ্দিন বলেন, গত বছরই রাজশাহীতে কালনাগের বিষে প্রাণ গিয়েছিল তাদের সতীর্থ সাইফুদ্দিনের। দশ গেরো দিয়ে, বিষ নামানোর চেষ্টা করেও নামানো যায়নি। পরে ডাক্তার বৈদ্য দিয়েও কাজ হয়নি। ছটফট করতে করতে মারা গিয়েছিল সাইফুদ্দিন।
যেমন ছটফট করেছিল লখিন্দর। বলেছিল, ‘ওঠ ওঠ বেহুলা গো কত নিদ্রা যাও/ কালীনাগে খেল মোরে চক্ষু তুলি চাও’।
বাংলাদেশ সময়: ২১:১৩:৪০ ১৩২২ বার পঠিত