রম্যরচনা-২
আমার কবিতা পড়া,অর্থ বুঝা,ইত্যাদি নিয়েও রয়েছে ভীষণ অজ্ঞতা। তবুও পড়ি। কারণ জ্ঞানী গুণী বুদ্ধিজীবি অনেকেই পড়েন। তাই আমাকেও একটু বিজ্ঞ ব্যক্তি সাজার প্রবল বাসনা। কিছু মোটা ভলিয়মের বই সংগ্রহ করা এবং সময় পেলেই গম্ভীর ভাব নিয়ে একটু আধটু কবিতা পড়া এই আরকি। অনেক সময়েই ভেবেছি বড় বড় কবিরা এতো পরিশ্রম করে এতো সময় ব্যয় করে কেন লিখেন। পাঠকগণ আবার আগ্রহ নিয়ে পড়েন। অনেক কবিকে দেখেছি শশ্রুমন্ডিত ঢিলেঢালা পায়জামা মোটা খদ্দরের পান্জাবি পরিহিত কাঁদে আজানুলম্বিত একটা কাপড়ের ব্যাগ, খুব সাদাসিধে জীবন যাপন। তাহলে কেন সেধে সেধে এই পথে পা বাড়ানো ? বুঝতে পারিনা। অবশ্য বাংঙ্গালী মাত্রই কিছু না কিছু কবিতা লিখেছেন জীবনে। দু এক লাইন হলেও লিখেছেন। যারা লিখাপড়া জানতেন না,তাঁরা মুখে মুখে হলেও ছড়া,কবিতা, গান ইত্যাদি তৈরী করে মানুষের মনোরঞ্জন করেছেন। বাউলদের কথাতো বলাই যেতে পারে। যেমন আব্দুল কুদ্দুস বয়াতী,শাহ আব্দুল করিম বয়াতী প্রমূখ। কবি লালন ফকির, গগন হরকরা ওনারাও খুব সম্ভব নিরক্ষর ছিলেন। তাঁদের গানে নাকি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুগ্ধ হয়ে ছিলেন। কুষ্ঠিয়ার শিলাইদহে অবস্থানকালে উক্ত দু জনের গানে বিমূহিত হয়েছিলেন। সেই সংগীতের ধারায় কিছু গান ও সাহিত্য সৃষ্টি করেছিলেন। আমাদের জাতীয় সংগীত” আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভাল বাসি” গানটি নাকি গগন বাবুর একটি গানে অনুপ্রাণিত হয়ে কবিগুরু রচনা করে ছিলেন। কবিগুরু তখন যে রচনাগুলো সৃষ্টি করেছিলেন,তা পাঠক-সমালোচক সকলের নিকট সমাদৃত হয়ে ছিল। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও কম যান না। বাংলায় প্রথম সার্থক উপন্যাস সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। তাও নাকি ছিল পাশ্চাত্য সাহিত্যের ধারা,অর্থাৎ, রোমান্টিকতা, সাসপেন্স, ইত্যাদি সবই ঐ অনুপ্রেরণা থেকে নেয়া। বাংলা গানের সুর ও বাণী,বাংলা নাটক-সিনেমার স্ক্রীপ্ট,নাচের মুদ্রা কলা ইত্যাদি বিদেশীদের অনুকরণ করে আমাদের দেশে অনেকে অর্থ,খ্যাতি যশ সবই অর্জন করেছেন। কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যেও আরবী,ফার্সী,হিন্দী এ সবের উপাদান তাঁর তথা বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু অজ্ঞ মনে প্রশ্ন জাগে ,আমরা করলে তাকে নকল করা বলা হবে কেন ? পরীক্ষার হলে আতঙ্কগ্রস্থ থাকতাম, কখন গার্ড এসে নকল ধরে। কখন এক্সটারনাল আসে,কখন ফ্লাইং গার্ড আসে। তা হলে পরিণতি ভয়াবহ। এক্সপেল,উইথহেল্ড বা বহিস্কার কত শাস্তিই না কপালে জুটবে। এখানেও মনে প্রশ্ন জাগে যে,যারা কড়া গার্ড দেন, তারা কি জীবনে কোনদিন এই কর্মটি করতেন না। আরও অবাক হই,যখন দেখি যে সরকারী ভাবে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় যে,সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের জন্য কিছু ” নকল নবীস “আবশ্যক। তা হলে নকলে বাধা দেওয়া কেন ?
প্রশ্ন জাগে, যখন দেখি দেশে শিক্ষিত বেকার ছেলেময়ে চাকুরী না পেয়ে গভীর হতাশা গ্রস্থ। জীবনের প্রতি বিষন্ন, সহজলভ্য নেশার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। অসৎ কর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ছে,তখন শুনি অতিরিক্ত সচিব, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক,অতিরক্ত পরিচালক, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরও কত কি। আসলের চেয়েও অতিরিক্ত। এই ব্যবস্থা কি না রাখলে চলতো না। না আমি নদীর রচনা লিখতে গিয়ে অবধানতা বশত গরুর রচনা লিখা শুরু করে দিয়েছি। ভেবেছিলাম কবিতা নিয়ে লিখবো।
আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, কবিতা আমি কম বুঝি। শুধু কবিতা কম বুঝি, আর সর্ব বিষয়ে আমি সব জান্তা তাও কিন্তু নয়। যখনই কোন বিষয়ে জানতে চেষ্টা করি দেখি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। তখন অনুমান করি আমি কত অজ্ঞ । এভাবেই জীবনের বেশীর ভাগ সময় অতিক্রম করে ফেলেছি।
তবে সবচেয়ে বড় যে সমস্যা তাহলো কবিতার মর্মার্থ বুঝা। অর্থ নিয়ে ব্যাখ্যা। এক এক জন বিজ্ঞ ব্যক্তির ব্যাখ্যা এক এক রকম। কারো সংগে কারো ব্যাখ্যার কোন সাদৃশ্য খুঁজে পাইনা। এমনকি কবিরা নিজেও বিভিন্ন আকারে ইংগিতে বুঝাতে চেষ্টা করেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন। কবিগুরুর সোনার তরী,সেও নাকি নেহায়ৎ ধান কাটার কথা নয়। দুই পাখি-তাও নাকি স্বাধীনতার কথা পরাধীনতার কথা ইত্যাদির পার্থক্য নিয়ে লিখা। তবে কবি গুরুর একটি কথার অর্থ কিছুটা আঁচ করতে বোধ হয় পেরেছি। তা হলো ” সহজ করে বলতে তোমরা কহ যে, সহজ কথা যায় না বলা সহজে “। অর্থাৎ সহজ অর্থ খোঁজার চেষ্টা বৃথা। তিনি আরও অনেক উপদেশ মূলক কথা বলেছেন,। যেগুলো বিজ্ঞ জনদের ভাববার উপকরণ হলে হতেও পারে, তাই তুলে ধরছি- ” নিজের গুনহীনতার বিষয়ে অনভিজ্ঞ এমন নির্গুণ শতকরা নিরানব্বই জন, কিন্তু নিজের গুণ একেবারেই জানেনা এমন গুণী কোথায় “? তিনি বলেছেন,” নিজের অজ্ঞতা সম্বন্ধে অজ্ঞানতার মতো অজ্ঞান আরতো কিছু নাই”। তিনি এমন অনেক উপদেশ দিয়ে গেছেন। যার অর্থ খুঁজে বের করা আমার মতো অভাজনের কর্ম নয়। তুলে ধরছি, যদি বিজ্ঞ পাঠগণ কোন অর্থ এর মধ্যে থেকে আবিষ্কার করতে পারেন।
“ নিন্দা করতে গেলে বাইরে থেকে করা যায়, কিন্তু বিচার করতে গেলে ভিতরে প্রবেশ করতে হয় “।
” তর্কের বেলায় গৃহিনীর যুক্তিকে অকাট্য বলে কাজের বেলায় নিজের যুক্তিতে চলাই সৎ পরামর্শ ” ।
” লোকে ভুলে যায় দাম্পত্যটা একটা আর্ট, প্রতিদিন ওকে নতুন করে সৃষ্টি করা চাই “।
“স্বামীরা প্রেমিক হতেে অবশ্যই রাজি,তবে সেটা নিজের স্ত্রীর সাথে নয়। নিজের স্ত্রীর প্রেমিক হবার বিষয়টা কেন যেন তারা ভাবতেই চায় না “।
” মনরে আজ কহ যে,ভাল মন্দ যাহাই আসুক,সত্যেরে লও সহজে “।
” নিজের অজ্ঞতা সম্বন্ধে অজ্ঞানতার মতো অজ্ঞান আরতো কিছু নাই “।
” কলস যত বড়ই হোক না , সামান্য ফুটা হলেই তাহার দ্বারা আর কোন কাজ পাওয়া যায় না “। তখন যাহা তোমাকে ভাসাইয়া রাখে তাহাই তোমাকে ডুবায় “।
“মানুষের একটা বিশেষ খাতা আছে,তার আলগা পাতা;সেটা যা,তা লেখার জন্য,সে লেখার দামের কথা কেউ ভাবেও না। লেখাটা তার লক্ষ্য,কথাটা উপলক্ষ্য”।
এই সবের বিশ্লেষণের সাধ্য আমার নেই, বুঝার সাধ্যও নয়। শুধু অনেক ক্ষেত্রে সবিরোধিতা বলে মনে হয়েছে আমার নিকট। সবার কাছেই হবে তা আমি মনে করিনা। একটা কথা পড়ে ছিলাম, একটি ফুলের উপর প্রজাপতি অহেতুক উড়ে বেড়ায়। তারা কিছুই সংগ্রহ করতে পারে না। কিন্তু মৌমাছি সেই ফুল থেকে মধু আহরণ করে। আর মাকড়শা সেখান থেকে বিষ সংগ্রহ করে জাল তৈরীর জন্য।
কবিতা বুঝার জন্য বিশেষ করে আধুনিক কবিতা বুঝার জন্য একটা ” ডাইজেস্ট ” সংগ্রহ করেছিলাম। তার ব্যাখ্যা হজম করার মতো ক্ষমতা কই। আরও দুর্বোধ্য। এই প্রসঙ্গটা একটু পরে বলছি। আগে দুই জন কবি,মনে হয়েছে খুব ভাল কবিই হবেন। কারণ বহু পাঠক পড়ে অনেক সুন্দর সুন্দর মন্তব্য করেছেন। একজন শ্যামল সরকার আর দ্বিতীয় জন হলেন ইফতেখার আলম। প্রথম জনের কবিতা- ” ভালবাসা অন্তরের গভীরে “। এটার মধ্যে ভালবাসা খুঁজতে গিয়ে গলধঘর্ম অবস্থা । রীতিমত Instrument Box সংগ্রহ করতে হয়েছে। ডিসেক্টিং করে করে বাম অলিন্দ, দক্ষিণ অলিন্দ, বাম নিলয় দক্ষিণ নিলয়, হার্ট হৃদয় সব খুঁজে দেখে চেষ্টা করেছি ভালবাসাকে দেখতে। এমন একটা কবিতা বোধ হয় কবি সৈয়দ শামশুল হক লিখে ছিলেন- “পরাণের গহীন ভিতরে “। তবে অর্থের ফারাক আছে।
ইফতেখার আলমের কবিতা - “মহেন শেখের বাড়ী ” । ভালো লাগলো। কিন্তু কালের বিবর্তনে বা কিছুদিন পর যদি কবি বা সমালোচকেরা বলেন, না এটা নেহায়ৎ নদীর ভাঙ্গন নয়। মহেন শেখের স্বপ্ন ভঙ্গের নয় । যদি বলে বসেন,এটা ছিল জীবন সায়াহ্নের কবির একটা চিন্তা। তিনি জীবন নদীর তীরে এসে কালের স্রোতে বয়সের প্রচন্ড গতিবেগে তাঁর দন্ত পড়েছে। চুল পেকেছে । তিনি ভাঙ্গনের একদম তীরে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। অবশেষে একদিন সব শেষ হয়ে যাবে। -তখনই হবে সমস্যা। তখন কি কবির বিরুদ্ধে মিথ্যা বলার অভিযোগে কোন মোদ্দমা দায়ের করা যাবে ? কবিরা বলে ঠ্যাং ভেঙ্গে দিবে, কিন্তু আঘাত করে বসে মাথায়। তাই কবিতা বুঝার চেষ্টা শুধুই পন্ডশ্রম বলে মনে হয়।
শুধু যে অর্থের মারপ্যাঁচ তা হলেও সহ্য করা যায়। কালের বিবর্তনে অনেক অনর্থও হয়। যেমন পল্লীকবি জসীম উদ্দীন লিখেছেন, ” ডাব্বা হুঁকাও চলিয়াছে ছুটি এর হাতে ওর হাতে,নানান রকম রশিও বুনান হইতেছে তাঁর সাথে “-পল্লী বর্ষা। এটাতো বর্তমান আইনে সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরনের লঙ্গন। আইন লঙ্গনের দায়ে অবশ্য কবিগুরুও পড়তেন,তা যদি হতো বর্তমান সময়ে । কারন নাবালিকা কন্যাকে বিবাহ তিনি করেছিলেন। আবার নাবালিকা কন্যাদেরকে বিবাহও দিয়েছিলেন। কাজেই সব কিছুই যোগোপযোগী ভাববো কেমনে।
বাংলাদেশ সময়: ২০:১৯:৫৪ ৯৫৯ বার পঠিত # #আধুনিক বাংলা কবিতা #আমার অজ্ঞতা #বাংলা কবিতা #রম্যরচনা