Apu Rahman,
বঙ্গনিউজ ডটকমঃ25-07-2013
অমিতাভ বচ্চনের জীবনী লিখে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন সাংবাদিক সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়। সেটা ১৯৮৬ সাল। অমিতাভ হিসাব করে বলেছিলেন, একই প্রস্তাব এর আগেও তিনি পেয়েছেন ১২ বার। তার পরও একসময় সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়কেই জীবনী লেখার ভার দিয়েছিলেন। ১৯৯৫ সালে সে বই প্রকাশিত হয় কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স থেকে। এরপর কাজের সূত্রেই বহুবার অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে দেখা হয়েছে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তাঁরই কিছু কথা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে তিনটি লেখা লিখছেন প্রথম আলোর দিল্লি প্রতিনিধি সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় কিস্তি
জাভেদ আখতার কোনো রকম ভণিতা না করেই জানতে চেয়েছিলেন, অমিতাভকে নিয়ে আমি কেন আগ্রহী। আমার অবাক উত্তর ছিল, ‘কারণ, তিনি অমিতাভ!’ মুম্বাইয়ের আরব সাগরের কিনারায় নারকেলগাছের ছায়াঢাকা হোটেলের আটতলার এক কামরায় জাভেদসাব সে সময় লুকিয়ে স্ক্রিপ্ট লিখছেন। অমিতাভ বচ্চনেরই সিনেমা জাদুঘর-এর। ঘরের বাইরে প্রোডাকশনের লোকজন যেন তীর্থের কাক। লেখা শেষ হলেই ছোঁ মেরে চোঁ-চোঁ দৌড়। নাহলে পরের দিনের শুটিং মাঠে মারা যাবে। জাভেদসাব শব্দহীন হেসে ইশারায় অপেক্ষা করতে বলে কলম তুলে নিলেন। ঘাড় গুঁজে আধঘণ্টা লিখে কলম বন্ধ করে বললেন, ‘আজকাল আর পুরো স্ক্রিপ্ট একসঙ্গে লেখা হয় না গল্প ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে।’
আমাকে আরও অবাক হওয়ার সুযোগটাও জাভেদসাব দেননি। তাঁর সময় বড়ই দামি। সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘উত্তরটা উত্তর হলো না হে। হেঁয়ালি হলো।’ জাভেদ আখতার নড়েচড়ে বসলেন। ‘মুম্বাইয়ে এক শ হিরো আছে। দিলীপসাব আছেন, দেব আনন্দ আছেন, মনোজকুমার আছেন, রাজেশ খান্না আছেন। তাঁদের নিয়ে বই কেন নয়? কেন অমিতাভ? এই উত্তরটাই আমি চাইছি।’
আমি ফস করে বললাম, ‘কারণ অনেক। তবে একটা বড় কারণ হলো, অন্য অনেকের মতো অমিতজিকে নাম বদলাতে হয়নি। তিনি যা, ঠিক সেভাবেই পর্দায় এসেছেন এবং শাসন করছেন। কিন্তু আপনার কাছে আসার আসল কারণ হলো, অমিতজি মনে করেন, তাঁর সাফল্যের পেছনে সেলিম-জাভেদ জুটির অবদান বিরাট।’
জাভেদসাব খানিকক্ষণ সম্পূর্ণ চুপ থেকে বললেন, ‘তোমাকে নিয়ে আমার কিন্তু চিন্তা হচ্ছে। অমিতকে আমি নানাভাবে বিশ্লেষণ করতে পারি। কিন্তু মানুষ নিজেকেই সবচেয়ে বেশি চেনে। যেমন ধরো আমি। আমি কেমন লোক, সে আমি ছাড়া আর কেউ কি ভালো বলতে পারবে? পারবে না। অমিতও নিজেকেই সবার চেয়ে ভালো চেনে। কিন্তু সেসব জানতে তোমাকে তো ওর মুখ থেকে কথা বের করতে হবে? এত কথা অমিত বলবে? পারবে ওর মুখ থেকে কথা বের করতে?’
বছর খানেক পর ফের একবার জাভেদসাবের সঙ্গে দেখা। একগাল হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হে, কাজ এগোচ্ছে?’ আমি কানে কানে বললাম, ‘আপনি ঠিকই বলেছিলেন। তাঁর পেট থেকে কথা বের করার চেয়ে কঠিন কাজ এই দুনিয়ায় আর বোধ হয় কিছু নেই। তিনি যতটুকু বলবেন, ততটুকুই নিতে হবে। ঠিক চিনের মতো। যতটুকু ওরা দেখাবে তার বাইরে কিছু দেখার জো নেই।’
জাভেদসাব আমার পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, ‘অমিত একটা অদ্ভুত ছেলে। কথা বলে এনার্জি নষ্ট করে না। এনার্জি ও জমিয়ে রাখে। ওকে কেউ অপমান করলে অভিনয় দিয়ে তার জবাব দেয়, ঝগড়া করে নয়।’
এর অনেক দিন পর একদিন শুটিং তাড়াতাড়ি প্যাক আপ হয়েছে। অমিতজিকে বললাম, আজ অনেকটা বেশি সময় কথা বলা যাবে। তিনিও সায় দিলেন। ডিনারের পর আমরা তাঁর বাড়ির বৈঠকখানায় বেশ গুছিয়ে বসলাম। কার কার সঙ্গে কথা হলো, আর কার কার সঙ্গে কথা বলতে চাই, কীভাবে এগোচ্ছি জানতে চাইলেন। আমি বললাম, ‘তিনজনের সঙ্গে কথা বলা খুব জরুরি। রেখা, রাজেশ খান্না ও বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং। প্রথমজনের সঙ্গে আপনার নাম জড়িয়ে রয়েছে আজও। দ্বিতীয়জন এ দেশের প্রথম সুপারস্টার, আপনি তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করেছেন এবং সেটা তিনি নাকি আজ পর্যন্ত হজম করতে পারেননি। আর তৃতীয়জন আপনাকে রাজনৈতিক কারণে ব্যবহার করেছেন বলে আপনার বিশ্বাস। আপনার এযাবৎ অর্জিত সম্মানে কালির ছিটে লাগিয়েছেন।’
সেদিন পূর্ণিমা। ‘প্রতীক্ষা’য় বসার ঘরের কাচের দরজাজোড়া পর্দা সরিয়ে টলটলে চাঁদকে যেন আবাহন করলেন অমিতাভ। হানাদারের মতো হুড়মুড়িয়ে ফুটফুটে জ্যোৎস্না ঘরে ঢুকে হুটোপাটি করতে লাগল। অমিতাভ কাচের দরজা হাট করে খুলে দিলেন। সামনে সবুজ ঘাসের লন। আমি জুতা খুলে ঘাসের ওপর হাঁটতে হাঁটতে বললাম, ‘ভিপি সিংকে চিঠি দিয়েছি। রাজি হবেন কি না জানি না। রাজেশ খান্না ও রেখা আপনাকেই ঠিক করে দিতে হবে।’ অমিতাভ ‘হুম’ গোছের একটা শব্দ করলেন। তারপর নিঃশব্দ পায়চারি।
আমার মনে জাভেদসাবের বলা কথাটা ভেসে উঠল। কথাটা পেড়েই ফেললাম। অমিতাভ মৃদু হাসলেন মাত্র। অনুচ্চে বললেন, ‘যা যা জানতে চেয়েছ বলেছি। আরও যা যা জানতে চাইবে জানাব। তবে জাভেদসাবের প্রশ্নটা কিন্তু ভাইটাল। হোয়াই মি?’ পায়চারি থামিয়ে অমিতাভ আমার দিকে ঘাড় ঘোরালেন।
আমি উত্তরটা এভাবে সাজালাম, ‘আনকনভেনশনাল লুক নিয়ে আপনি শুধু সফলই নন, আপনার উত্থান থেকেই শুরু একটা নতুন যুগ। ১ নম্বরে ওঠাই নয়, এত বছর ধরে জায়গাটা ধরেও রেখেছেন। আপনি বিদ্যাসাগর মশাইকে ভুল প্রমাণ করেছেন। যাঁরা উপকার করেছেন, তাঁদের আপনি পাল্টা সাহায্য করেছেন। রাজনীতিতে ঢুকেও হেলায় রাজনীতি ছেড়েছেন। নিজে লড়াই করে নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করেছেন। কিন্তু এসবের বাইরেও দুটো কারণ আছে।’
অমিতাভ গম্ভীরভাবে তাকিয়ে রইলেন। আমি বলি, ‘আপনি এখনো সনাতন ভারতীয়ই থেকে গেছেন। এত বড় হয়েছেন, এত বয়স হয়েছে, এত নাম-যশ-অর্থ-প্রভাব-প্রতিপত্তি, তবু মা-বাবাকে আলাদা করেননি। তাঁদের সঙ্গেই আছেন, এক ছাদের তলায়, এক হাঁড়ি নিয়ে। আর অন্য কারণটি? আপনাকে নাম বদলাতে হয়নি অন্য অনেকের মতো।’ ফটফটে জ্যোৎস্নায় অমিতাভ ও আমি নীরবে ভিজতে লাগলাম।
নীরবতা ভেঙেছিলাম আমিই। ‘আপনাকে আপনিই সবচেয়ে বেশি চেনেন। আমি চেনার চেষ্টা করছি মাত্র। যদি একটুও চিনে থাকি, তা হলে মনে হয় আপনি যথেষ্ট কনজারভেটিভ।’
অমিতাভ বচ্চন হেঁটমুন্ড হয়ে ঘনঘন মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘কনজারভেটিভ? না না, আমি একেবারেই কনজারভেটিভ নই। বলতে পারো আমি ট্র্যাডিশনাল। এই উপমহাদেশের জল-মাটি-হাওয়ায় মাখামাখি পুরোপুরি ট্র্যাডিশনাল এক সাধারণ মানুষ।’
বাংলাদেশ সময়: ৫:৩৪:২০ ৫১৪ বার পঠিত